কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি ঃ দর্শন ও দিশা

লেখক
সুকুমার সরকার

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

 আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক স্তরের বিজ্ঞান দিয়েই তার মোকাবিলা  করতে হবে আর এই জন্যই শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর অর্থনৈতিক তত্ত্বে এই বিষয়গুলির অবতারণা করেছেন অর্থনীতিতে এই বিষয়গুলি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ তা কোভিড পরিবর্তিত পরিস্থিতি মানুষকে ভাবতে বাধ্য করেছে।

প্রশ্ণ আসতে পারে অর্থনীতির সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কী সম্পর্ক উত্তরে বলবো, অর্থনীতির সঙ্গে শিক্ষার যেমন সম্পর্ক, তেমন করোনা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলি ব্যাপকভাবে সম্পর্কিত হলেও আজকের আলোচনা সে সব দিকের বিস্তৃত আলোচনা করবো না আজকে আলোচনা করবো প্রাউটের প্রথম সিদ্ধান্ত নিয়ে কেননা, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়দের নোট ছাপানোর নিদান মদ বিক্রির পরামর্শের যৌক্তিকতা কতটা ঠিক বা ঠিক নয় কিংবা কতটা ফলপ্রসূ হবে বা হবে না, তা প্রাউটের এই প্রথম সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যাবে সাধারণ অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যাবে না প্রথমেই দেখা যাক, এই নোট ছাপানোর প্রয়োজনের  কথা কেন আসছে না, সাধারণ মানুষের  হাতে টাকা নেই বলে, তাই টাকার জোগান বাড়াতেই নিয়ম বহির্ভূতভাবে নোট ছাপানোর কথা উঠেছে এখন প্রশ্ণ হচ্ছে,

প্রশ্ণ ঃ কোন্ সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই।

উত্তর ঃ যাঁরা দিন আনেন দিন খান কিংবা যাঁদের স্বল্প আয়ে সংসার চলে।

প্রশ্ণ ঃ কারা দিন আনেন, দিন খান

উত্তর ঃ শ্রমিক শ্রেণীর মানুষেরা

প্রশ্ণ ঃ কারা স্বল্প আয়ের মানুষ

উত্তর ঃ সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার নিম্ন বেতনের কর্মচারিরা বিশেষ করে বেসরকারি সংস্থার নিম্ন আয়ের কর্মচারিরা আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা লকডাউনে এই সমগ্র মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন।

উচ্চবিত্তের মানুষ, ভালো বেতনের সরকারি কর্মচারি, আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ বেতনের বেসরকারি কর্মচারিরা ঘর থেকে বেরোতে না পারার বিলাসিতা আর মৃত্যু ভয় ছাড়া অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে খুব একটা পড়েননি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়দের দাওয়াই প্রথম শ্রেনির মানুষদের জন্য কিন্তু এটা অর্থনীতির মাপকাঠিতে কোনো সমাধান নয় আপদকালীন সমাধানও নয় সুপদকালীনও সমাধানও নয়! প্রথমত, এই মূহূর্তে বিশ্বে খাদ্যসংকট নেই আগামী এক দুই বছর পর্যন্ত খাদ্যের অভাবে পৃথিবীর  কোনো দেশের মানুষের  মরা কথা নয় পৃথিবীতে যথেষ্ট খাদ্য শস্য মজুদ আছে খাদ্য শস্যের অভাব নেই অভাব শুধু যুক্তিসঙ্গত বণ্টনের এই যুক্তিসঙ্গত বন্টনের রাষ্ট্রীয় পলিসি বর্তমানের কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেই নেই আছে দান-খয়রাতি নীতির কথা যুক্তিসঙ্গত  বন্টন আর দান-খয়রাতি যে এক জিনিস নয়, এটা বুঝতে অমর্ত্য অভিজিৎদের আর কতদিন লাগবে প্রাউট দান-খয়রাতিরমূলক অর্থনীতিকে সমর্থন করে না প্রাউট সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ  গ্রহণ ও তার যুক্তিসঙ্গত বন্টনের নীতির ওপর জোর দিয়েছে সুতরাং বিশ্বে যদি খাদ্যাভাব না থাকে, তাহলে মানুষের  না খেয়ে মরার কথা নয় যদি মরে, তাহলে বুঝতে হবে বন্টন নীতির অভাব সুতরাং প্রাউট তত্ত্বের যুক্তিসঙ্গত বন্টন নীতি এই মূহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক দর্শন দিশা।

দ্বিতীয়ত বিষয় হচ্ছে, নগদ অর্থের জোগান , এখানেই প্রয়োজন  প্রাউটের  প্রথম সিদ্ধান্তের প্রয়োগের প্রাউটের প্রথম সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে কোনো ব্যষ্টিই সমবায়িক সংস্থার Collective body) সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না এখন প্রশ্ণ হলো, মানুষ সঞ্চয় করে কেন না, ভবিষ্যতের জন্য ভবিষ্যতের আপদকালীন বিপদ কালীন পরিস্থিতির হাত বাঁচার জন্য তা হলে আজকের  এই এক-দুই মাসের আপদকালে সাধারণ মানুষের এমন কেন হলো কেন সামান্য সঞ্চয়টুকুও তাঁদের কাছে নেই কিংবা বলা ভালো, এ  কোন্ অর্থনীতির হাল হকিকতের মধ্যে দিয়ে তাঁদের দিন কাটছে, বিপদের দিনের জন্য সামান্য সঞ্চয়টুকুও তাঁরা করতে পারছেন না আসলে প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় সে সবের তো কোনো অর্থনৈতিক দিশা নেই প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় সরকারের শ্রমনীতি এতটাই বৈষম্য মূলক, যা কোনো মানদণ্ডেই তুলনা করা যায় না এক চরম পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে আয়ের এক বিরাট ব্যবধান রয়ে গেছে এই ব্যবধানে এক শ্রেণির মানুষের হাতে  প্রচুর টাকা  আর এক শ্রেণির মানুষের হাতে কোনো টাকায় থাকে না মাসের শেষে বা বছরের শেষে সঞ্চয় বলতে কিছুই  করতে পারে না, যা দিয়ে আপদকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে আজকের এই পরিস্থিতির এটিই একটি বড় কারণ শুধু নয়, প্রধান কারণ প্রাউটের প্রথম সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, কোনো ব্যষ্টিই সমবায়িক সংস্থার Collective body) সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না অথচ, সামবায়িক সংস্থার সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া এক শ্রেণির মানুষ এত টাকা সঞ্চয় করেছেন যে, দেশের বেশির ভাগ সম্পদ তাঁদের হাতে কুক্ষিগত ফলে টাকা না আছে সাধারণ  মানুষের কাছে, না আছে রাষ্ট্রের কাছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্র চিরকালই পুঁজিবাদীদের মুখাপ্রেক্ষী পুঁজিবাদীরা শোষণ সহায়ক নির্বাচনে জন্য নেতাদের টাকা দেবেন কিন্তু দেশের আপদকালীন অবস্থায় রাষ্ট্রকে টাকা দেবেন না রাষ্ট্র-প্রধানদেরও বুকের পাটা নেই, পুঁজিপতিদের অর্থ আপদকালীন পরিস্থিতিতে খরচ করে তাছাড়া পুঁজিবাদীরা তো অর্থের একটি বিরাট অংশ দেশেই রাখেন নি বিদেশের ব্যাংকে রেখেছেন টাকা দেশের ব্যাংকে থাকলে দেশের আপদকালীন পরিস্থিতিতে দেশের সরকার খরচ করতে পারলেও পারতো রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে  সঞ্চয় নীতির সুস্পষ্ট দিশা না থাকার কারণে পুঁজিপতিরা রাষ্ট্রের ভয়ে তাঁদের টাকা বিদেশের ব্যাংকে রেখেছেন সেই ভয়ের কারণ দূর করে রাষ্ট্রের উচিত ছিল এমন কোনো নিয়ম করা, যাতে করে পুঁজিপতিরা তাঁদের অর্থ দেশের ব্যাংকেই গচ্ছিত রাখতে পারেন তাতে অন্তত বর্তমানের মতো যে কোনো ধরনের আপদকালীন পরিস্থিতিতে সরকার টাকা ছাপানোর মতো বিপদজনক পদক্ষেপ না করে ওই টাকা দিয়ে টাকার জোগান বাড়াতে পারতো।

এটা তো গেলো একটি দিক অন্য আরেকটি দিক হলো রাষ্ট্রের সকল মানুষের আয়ের ব্যবধান ও আয় ব্যয়ের বৈষম্য সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার বেতন বৈষম্য এতটাই প্রবল যে মানুষের  নূ্যনতম চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে এক শ্রেণির মানুষকে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে মূল বেতন কাঠামো (বেসিক পে) সরকারি বা বেসরকারি সকলক্ষেত্রে  একইে যোগ্যতার কাজের জন্য একই থাকা উচিত ছিল অর্থাৎ একই শিক্ষাগত যোগ্যতার, একই পদের একজন কর্মচারি আর একজন বেসরকারি কর্মচারির মূল বেতন কাঠামো একই থাকবে কেননা,  সরকারি বা বেসরকারি উভয় সংস্থার বেতনের  যতই ব্যবধান থাক প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে একই বাজারে দুইজনকেই যেতে হচ্ছে সেখানে সরকারি  কর্মচারিদের জিনিস কেনার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হয় বেসরকারি সংস্থার কর্মচারিকে ।

(ক্রমশঃ)