কোনটা লিখব---ৰাংলা  নাকি ৰাংঙলা, ৰাংঙালি নাকি ৰাংঙালী

লেখক
শঙ্কর দাশ

আজকাল বাংলা বানানের ক্ষেত্রে এক দারুণ অরাজকতা চলছে৷ এক চরম বিকৃতি চলছে৷ যে যার খেয়াল খুশী মত বানান লিখে চলেছেন৷ বানানের এই বিকৃতি যানবাহন, সাইনবোর্ড, ফ্ল্যাক্স, হোর্ডিং, ক্যাশ-মেমো, বই-পুস্তক সর্বত্রই নজরে পড়ছে৷ বানানের ক্ষেত্রে যার যার খেয়ালীপনা যেমন চলছে তেমনি চলছে কাউকে অন্ধ অনুসরণ, অন্ধ অনুকরণ৷ এ কথা বাংলা বানানের ক্ষেত্রে যেমন চলছে, তেমনি চলছে বাংলা বিশেষ্যপদের ইংলিশ বানানের ক্ষেত্রেও৷ কী খেয়ালে কোন এক সরকারী কর্মকর্র্ত ত্রিপুরার একটি জেলা সিপাহীজেলা বানানটি ‘Sepahijala’’ লিখে দিলেন তো কারোর আর প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না যে,‘Se’’ দিয়ে সিপাহীজলা বানান হলে বিশালগড় বানানও Beshalgarh হবে না কেনো, যেখানে be-এর উচ্চারণই হলো ‘‘বি’’? অথবা বিশালগড় বানান Bishalgarh হলে সিপাহীজলা Sipahijala  হবে না কেনো?

এই যুক্তি তো অন্য কোনো সরকারী কর্মচারীগণ করেনই না, বরং Sipahijala লিখলে ‘‘ভুল’’ বানান বলে ঠিক করে লিখতে সুপরামর্শ দিয়ে থাকেন অনেকেই৷ অর্র্থৎ বানানের ক্ষেত্রে এক চরম বিশৃঙ্খলা চলছে৷ এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত মহান ভাষাবিজ্ঞানী শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের খুবই প্রণিধান যোগ্য একটি উদ্ধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক হবে৷ তিনি বলেছেন, ‘‘ৰানানের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা নিয়মানুবর্ত্তিতা মেনে চলা উচিত, নইলে বিশৃঙ্খলা দেখা দের্ে৷ সে বিশৃঙ্খলা সাহিত্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, আর সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত করবে সমাজ-চেতনাকে৷’’ (প্রভাতরঞ্জনের ব্যাকরণবিজ্ঞান-তৃতীয় খণ্ড পৃঃ ১০৬৩)৷ তাই বানানের ক্ষেত্রে   একটা বিধিবদ্ধ নিয়মনীতি মেনে চলতেই হবে৷ কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, স্কুলের পাঠ্যক্রমে শুদ্ধ বানান শেখার একটা অধ্যায় থাকলেও আজকাল আর তা পড়ানো হয় না৷ ‘‘ণত্ব বিধান ষত্ব বিধান’’ পড়ানো---সে তো বহুকাল আগেই পটল তুলেছে৷ বরং সুকলগুলোতে এমনও বলা হয়ে থাকে, হ্রস্ব ই-কার (ি) বা দীর্ঘ ঈ-কার (ী) যে কোনো একটা দিয়ে লিখলেই চলে৷ বলি, ‘‘নারী’’ আর ‘‘নারি’’ শব্দের অর্থ কি এক?

‘‘এ জ্বালা আর সইতে নারি’’ আর ‘‘তিনি একজন বিদুষী নারী’’- এই দুই নারি আর নারীর মানে কি এক? এখন আমরা ‘‘বাংলা’’ নাকি ‘‘বাঙলা’’ নাকি ‘‘বাঙালী’’ লিখব এসম্পর্কে কয়েকজন মনীষীর কিছু উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরছি৷ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘‘ পথের দিশা’’ কবিতাতে লিখেছেন, ‘‘বাঙলা দেশও মাতল কি রে?’’ (সঞ্চিতা, ডি.এম, লাইব্রেরি, প্রথম প্রকাশ- অক্টোবর ১৯২৮, পৃঃ ১১২) এখানে দেশ তথা বাসস্থান হিসেবে বানানটা ‘‘বাঙলা’’৷ ‘‘বাংলা’’ নয়৷ ‘বঙ্গ’ শব্দটিতে সংস্কৃতে অন্তঃস্থ ‘ব’৷ এর একটি মানে রাং (টিন) ধাতুজাত পদার্থ অপর মানেটি হচ্ছে বাঙলা (বর্গীয়-)৷ সংস্কৃত ‘‘বঙ্গ’’ (বানানটি অন্তঃস্থ-‘ব’ দিয়ে) থেকে প্রাকৃতে  ‘ৰঙ্গ’ (বর্গীয়-ৰ‘’ দিয়ে) (মনে রাখতে হবে এটি সংস্কৃত বানান নয়, প্রাকৃত বানান)৷ পৃথিবীর কয়েকটি নামজাদা ভাষাতে এই ‘বঙ্গ’’ (অন্তঃস্থ-ব) শব্দ থেকেই দেশটির, তার মানুষের ও তার ভাষার নামকরণ করা হয়েছে৷ তাই সেগুলো বর্গীয় ৰ‘’৷

যেমন লাতিনে ‘‘ৰাঞ্জাল’’, চীনা ভাষায় ‘‘ৰাঞ্জালা’’, তুর্কীতে ‘‘ৰাঙ্গালা’’, ফার্সী-উর্দুতে ‘‘ৰাঙ্গাল’, ইংরেজীতে ‘‘নেগ্যাল’’ ও খোদ ৰাংলা ভাষায় ‘‘ৰাঙলাদেশ’’, ‘‘ৰাংলাভাষা’’, ‘‘ৰাঙ্গালী’’৷ ‘‘ঙ্গ’’ শব্দটি অতি প্রাচীন৷ ‘‘ৰাংলা’’ শব্দটিও অর্বাচীন নয়৷ কিংবদন্তি এই যে অঙ্গ, ঙ্গ (অন্তঃস্থ-ব), কলিঙ্গ নামধেয় তিন ভ্রাতা পাশাপাশি তিনটি রাজ্য শাসন করতেন ও তাঁদের নামানুসারে দেশগুলির নাম হয়েছিল৷ সংস্কৃত ‘‘ঙ্গ’’ ও প্রাকৃত ‘‘ঙ্গ’’ শব্দের অর্থ ব্যাপকার্থে গোটা াঙলাদেশ অর্থাৎ বঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্র, সমতট, মিথিলা-এই পঞ্চ গৌড়কে নিয়ে গৌড়দেশ বা াঙলাদেশ৷’’ (সূত্র ঃ প্রভাতরঞ্জনের ব্যাকরণ বিজ্ঞান-দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৫২৪)৷ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘‘আমরা’’ কবিতায় লিখেছেন--- ‘‘মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে আমরা বাঙ্গালী বাস করি সেই তীর্থে-বরদ বঙ্গে,--- জ্ঞানের নিধান আদি বিদ্বান কপিল সাঙ্খ্যকার এই বাঙলার মাটিতে গাঁথিল সূত্রে হীরক-হার৷ ‘‘বাঙালী’’ অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ঙ্কর, জ্বালিল জ্ঞানের দীপ তিববতে ‘‘বাঙালী’’ দীপঙ্কর৷

কিশোর বয়সে পক্ষধরের পক্ষশাতন করি ‘‘বাঙালী’’র ছেলে ফিরে এল দেশে যশের মুকুট পরি’৷ ‘‘বাঙলা’’র রবি জয়দেব কবি কান্ত কোমল পদে করেছে সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চন-কোকনদে৷’’ এখানে বাসস্থান হিসেবে ‘‘বাঙলা’’ ও অধিবাসী হিসেবে ‘‘বাঙালী’’ বানানগুলো লক্ষ্যনীয়৷ বিশ্বখ্যাত অধ্যাপক তথা ভাষা-গবেষক শ্রী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,‘‘বাঙলাদেশে বা বাঙালীদের মধ্যে ও বাঙলার  বাইরে বহু অবাঙালীর মধ্যেও একটা এই ধরণের বিশ্বাস দাঁড়িয়ে গিয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন আর বিশ্বভারতীতেই আধুনিক ভারতবর্ষের সংস্কৃতি তার সবচেয়ে লক্ষণীয় রূপ নিয়েছে৷’’ (সূত্রঃ সংস্কৃতি শিল্প ইতিহাস, প্রবন্ধের নামঃ সংস্কৃতি,পৃঃ ১, প্রকাশনী-জিজ্ঞাসা, চতুর্থ প্রকাশঃ জানুয়ারী, ২০০৩)৷

শুধু তাই নয়,  শ্রী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সর্বত্র বাঙালী বানানটা দীর্ঘ ঈ-কার (ী) দিয়েই লিখেছেন৷ এখানেও বাসস্থান হিসেবে ‘‘বাঙলা’’ ও অধিবাসী হিসেবে ‘‘বাঙালী’’ বানান সুস্পষ্ট৷ বাংলা ভাষায় নির্ভরযোগ্য ও শেষ ভরসাযোগ্য অভিধান ‘‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’’ মহাগ্রন্থের প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালী বানানটা হ্রস্ব-ই-কার (ি ) এবং দীর্ঘ-ঈ-কার (ী)  দিয়ে লিখলেও উপমালাগুলো  তিনি দীর্ঘ-ঈ-কারের তুলে ধরেছেন৷ যেমন তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি উপমা তুলে ধরেছেন এইরকম--- ১) ‘‘সাত কোটি সন্তানের, হে মুগ্দ জননী!     রেখেছ ‘বাঙালী’ ক’রে মানুষ কর নি৷’’ ২) ‘‘বাঙালীর পণ.... সত্য হউক হে ভগবান৷’’ এখানেও দেখা যাচ্ছে ‘বাঙালী’ বানানটা দীর্ঘ-ঈ-কার দিয়েই লেখা হয়েছে৷ কিন্তু কী কারণে জানি না আজকাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বানানের উপরও কলম চালিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনী তাঁর বই ছেপে চলেছে৷ কোন কোন প্রকাশনী আধুনিক বানান রীতি অনুসৃত হয়েছে বলে ভূমিকাতে স্বীকার করেন৷ কোন কোন প্রকাশনী তাও করেন না, কবিগুরুর বানানের ওপর ছুরি চালিয়ে দেন বিনা বাধায়৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের কথাকে পুনরাবৃত্তি করে বলা যায়,এই বানান বিশৃঙ্খলা সাহিত্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে৷

আশুতোস দেব প্রণীত ‘Dev's’’ শব্দবোধ অভিধান এ বাঙালি/বাঙালী উভয় বানান থাকলেও ‘‘বাঙালী’’ বানানটাই অধিক  লক্ষ্য করা যায়৷ ‘‘প্রাউট’’ প্রবক্তা মহান দার্শনিক তথা বিশ্বখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার (তিনি বিশ্বের ২০০ ভাষার তুলনামূলক বর্ণবিজ্ঞান, শব্দের বুৎপত্তি, উৎসারণ ও বিবর্ত্তন নিয়ে প্রায় সাড়ে আট হাজার পৃষ্ঠার আলোচনা করেছেন) তাঁর লেখায় সর্বত্রই তিনি ৰাঙালী’’ বানানে বরাবরই দীর্ঘ-ঈ-কার দিয়ে লিখেছেন৷ ৰাঙলা ও ৰাঙালী বানানে গীয় ‘‘’’ দিয়েই লিখেছেন৷ কেন গীয় ‘‘’’? এ নিয়ে প্রবন্ধের প্রথম দিকে তাঁর একটি ক্ষুদ্র উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে৷ ‘‘ঙ্গ’’ বানানে অন্তস্থঃ ‘‘ব’’ আর গীয় ‘‘’’ এর পার্থক্যটি তাঁর উদ্ধৃতির শেষ লাইনটির পুনঃপাঠে আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে আশা করি৷ তিনি বাসস্থান অর্থে ‘‘ৰাঙলা’’, অধিবাসী অর্থে ‘‘ৰাঙালী’’ ও তাদের মুখের ভাষাকে ‘‘ৰাংলা’’ (তিনেতেই গীয়-) বানানেই লিখেছেন৷ তাঁর বিরচিত ও সুরারোপিত প্রভাতসঙ্গীতের  দু’টি উদ্ধৃতি তুলে ধরা যাক৷ ১)

‘‘ৰাঙলা আমার দেশ, ৰাঙলাকে ভালবাসি৷

ৰাঙলার দুঃখে কাঁদি, ৰাঙলার সুখে হাসি৷৷

ৰাঙলার ভাই-বোনেরা মোর খেলারই সাথী,

ৰাঙলার হিয়া অমরা ঢেলে যায় প্রীতি নিতি৷

ৰাঙলার ফুল-ফল-জল, প্রভাতের স্মিত শতদল, 

যুগান্তরের নিরাশার কুয়াশা দিক নাশি৷

ৰাঙালীর যত আশা, ৰাঙালীর প্রিয় ভাষা,

বিশ্বৈকতাবাদে ফিরে পাক প্রত্যাশা৷

ৰাঙালীর ছেলেমেয়েরা ৰাঙালীর বোধিপসরা,

সার্থক হোক হে-প্রভু মহতের ভাবে মিশি৷৷

 

২) মধুর চেয়েও আরো মধুর আমার ৰাংলা ভাষা,

আমার প্রাণের ভাষা৷ (সূত্রঃ ৰালা ও ৰাঙালী, পৃঃ ৪৪০/৪৪১)

সুতরাং উপরোক্ত ৰাঙালী মনীষীদের উদ্ধৃতি সহযোগে এই আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, বাসভূমি অর্থে ‘‘ৰাঙলা’’ ও তার অধিবাসী অর্থে ‘‘ৰাঙালী’’ ও তাদের   ভাষা অর্থে ‘‘বাংলা’’ বানান লেখাটাই বাঞ্ছনীয়৷ মনীষীদেরকে অনুসরণ করাই যথার্থ বিচার বলে আমি মনে করি৷ সুতরাং দীর্ঘ-ঈ-কারে ‘‘বাঙালী’’ বানানটা ভুল তো নয়-ই বরং এটাই অধিকতর শুদ্ধ৷ সর্বশেষে একটা জাত্যভিমানগত যুক্তি দিয়ে আমার আলোচনা শেষ করব৷ ‘‘হ্রস্ব’’ শব্দের অর্থ খাটো, ক্ষুদ্র, কম, লঘু, হালকা ইত্যাদি৷ ‘‘দীর্ঘ’’ শব্দের অর্থ লম্বা, অধিক, বেশী, দূরপ্রসারিত, বহুকালব্যাপী ইত্যাদি৷ তাই হ্রস্ব ই-কারে       (ি ) ‘‘বাঙালি’’ বলতে এমন একটা মিনমিনে, ম্যাড়ম্যাড়ে জাতিকে বোঝায়, যার না আছে শৌর্য, বীর্য, বীরত্ব, না আছে পৌরুষ৷ আর দীর্ঘ-ই-কারে ( ) ‘‘বাঙালী’’ বলতে  এমন এক জাতিকে বোঝায়,যে জাতি শৌর্য, বীর্য, বীরত্ব  আর পৌরুষে ভরা৷

যে জাতি শুধু নিজেরাই নয় সমগ্র বিশ্বকে মানবতার  মুক্তির পথ দেখাতে পারে৷ পঞ্জাবী ভাষার উচ্চারণই প্রমাণ করে পঞ্জাবী-জাতি মনোবলে ও শারীরিকবলে কত বলিয়ান৷ ভাষার উচ্চারণ ও বানানের সঙ্গে একট জাতির  মনস্তাত্ত্বিক সূত্র এটি৷ তাই হ্রস্ব-ই-কারে ‘‘বাঙালি’’ বানানটা শীঘ্রই রহিত হওয়া উচিত৷ হওয়া উচিত দীর্ঘ-ঈ-কারে ‘‘বাঙালী’’৷ মনে রাখতে হবে, একটা ভাষার যথার্থ উচ্চারণ ও বানান যেমন একটা জাতিকে সমুন্নত করতে পারে, তেমনি একটা ভুল উচ্চারণ ও ভুল বানান একটা জাতিকে ধবংসপ্রাপ্তও করে দিতে পারে৷