ক্রমবর্ধমান নারী–নিগ্রহ ঃ সমস্যার সমাধান কোথায়

লেখক
অবধূতিকা আনন্দগতিময়া আচার্যা

‘রাজ্যে রাজ্যে নারী–নিঃগ্রহ, বধূহত্যা, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে৷ এই সমস্ত রোধের জন্যে দেশে অনেক আইন রয়েছে, নূতন নূতন আইন তৈরীও হচ্ছে৷ কিন্তু সমস্যা আগের মতই রয়েছে৷ উদাহরণস্বরূপ দিল্লির গণধর্ষণ কাণ্ডের প্রসঙ্গ আনা যায়৷ এই ঘটনার পর দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠল৷ কঠোর আইন–প্রণয়ণের দাবী উঠল৷ সংসদেও সর্বসম্মতিক্রমে নারী নির্যাতন রুখতে কঠোর আইন আনার দাবী উঠল৷ কঠোর আইন পাশ করাও হ’ল৷ কিন্তু পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তনই পরিলক্ষিত হচ্ছে না৷ তাহলে এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? এই সমস্যার সমাধানের জন্যে প্রথমে সমাজ–সচেতনা বৃদ্ধি৷ আইন দোষীদের শাস্তি দেবে৷ কিন্তু এই ধরনের  অপরাধের সম্ভাবনা রুখতে মুক্ত সমাজ–চেতনার বৃদ্ধিই সার্বিক কার্যকরী৷

সমাজে পণপ্রথার বিরুদ্ধে আইন হচ্ছে, কিন্তু দেশের বহু শিক্ষিত মানুষ, প্রায় অধিকাংশই, কন্যাপক্ষের কাছ থেকে পণ আদায় করে৷ তাহলে কী ধরণের শিক্ষা তাঁরা পেয়েছেন?

এটা ঠিক, বর্তমান শিক্ষা মূলতঃ অর্থ–উপার্জনের শিক্ষা৷ কী করে ছেলে–মেয়েরা বেশী অর্থ–উপার্জন করতে পারবে – বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সেটাই লক্ষ্য৷

প্রকৃত শিক্ষা মানুষের মধ্যে একটা আদর্শবোধ জাগিয়ে তুলবে৷ অন্ধবিশ্বাস, কু–সংস্কার, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা – এসব থেকে মানুষকে মুক্ত করবে৷ মানুষের মনকে প্রসারিত করবে৷ তাকে সংকীর্ণ আত্মসুখের সংকীর্ণ গণ্ডী থেকে বের করে এনে বিশ্বমুখী করবে৷ আমি কেবল নিজে ভাল খাব, ভাল পরব, ভালভাবে থাকব, ভোগ–বিলাসে ডুবে থাকব – তা নয়, আমি সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলব৷ সবার কল্যাণের সঙ্গে নিজের কল্যাণকে মিলিয়ে দেব৷ এই প্রকৃত শিক্ষা মানুষের এই চেতনা আনবে৷

আর এই যে যথার্থ সমাজচেতনা বোধ যাকে প্রাউটের ভাষায় বলা হয় ‘সম–সমাজতত্ত্ব’ ৷ এর প্রেরণার স্থায়ী উৎস কী? জীবনের আদর্শ যদি ভোগবাদ হয়, তা হলে তা শেষ পর্যন্ত আত্মসুখতত্ত্বের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করবেই৷ তখন অন্যের ভাল–মন্দ, ব্যথা–বেদনার অনুভূতির চেয়ে নিজের ভালমন্দ সম্পর্কে–ই মানুষকে অতিমাত্রায় সচেতন করে তুলবে৷ এটাই স্বাভাবিক ও মনস্তত্ত্বসম্মত৷ তাই ভোগবাদ যেখানে জীবনের আদর্শ সেখানে সমাজকে কলুষমুক্ত করার শত চেষ্টা শেষ–পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে৷

তাই এই ভোগবাদের সংকীর্ণ আবর্ত থেকে অধ্যাত্মবাদে  উত্তরণ ঘটাতে হবে৷ আজ যে শুধু এক দুই রাজ্যে নয় – গোটা দেশে  – তথা সমগ্র মানব সমাজের সর্বাত্মক অবক্ষয়  – তার প্রধান কারণ হ’ল অধ্যাত্মবিমুখতা৷

আর তথাকথিত বাহ্যিক ধর্মীয় আচার–নুষ্ঠানের সঙ্গে প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার কোনোমাত্র সম্পর্ক নেই৷ আধ্যাত্মিকতার মূল কথা হল, আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন৷ আর তা করতে গেলে মনকে অন্তর্মুখী করে ব্রহ্মের দিকে – ঈশ্বরের দিকে চালিয়ে দেওয়ার ঐকান্তিক প্রয়াস চাই৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে চাই সবকিছুকে ব্রহ্মের বিকাশরূপে দেখা৷ এই ঐকান্তিক প্রয়াসই মানুষের মনকে সূচী–শুভ্র করে তুলবে ও সবার প্রতি যথাযথ কর্তব্য করার প্রেরণা যোগাবে৷ আত্মসুখ–তত্ত্বের তখন সমসমাজতত্ত্বে তথা নব্যমানবতায় উত্তরণ ঘটবে৷ এছাড়া সমাজকে কলুষমুক্ত করার কোনো পথ নেই৷

তাই দেশে নারী–নির্যাতন সহ সমস্ত প্রকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্যে একদিকে যেমন কঠোর আইন চাই, তার সঙ্গে সঙ্গে ভোগবাদ নয়, অধ্যাত্মবাদকে জীবনের আদর্শ করে এক সর্বাঙ্গ সুন্দর সমাজ গড়ার জন্যে সবার আন্তরিক প্রয়াস চাই৷