কর্ষক প্রধান বাঙলার ইতিকর্তব্যতা

লেখক
একর্ষি

বিশ্বেপপগ্য কৃষি অঞ্চলগুলির মধ্যে বাঙলার কৃষিক্ষেত্রগুলি অন্যতম৷ বাঙলা তথা ভারতের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে কৃষি থেকে৷ আজও দেশের সিংহভাগ মানুষ রুজি-রোজগারের জন্যে কৃষির সঙ্গে যুক্ত৷ প্রাচীনকালে এদেশের রাজারা কৃষির উন্নতির জন্যে চিন্তাভাবনা করতেন ও বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করতেন৷ ব্রিটিশ শাসকরা সর্বাধিক রাজস্ব আদায় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করলেও কৃষির উন্নতির জন্যে কিছু করেননি৷ এ নিয়ে স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে কর্ষক আন্দোলনও কম হয়নি৷ স্বাধীনোত্তর কালে কৃষি বিদ্যালয় স্থাপন, সেচ ব্যবস্থার প্রচলন, রাসায়নিক সারের ব্যবহার, উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার, জমিদারি প্রথার বিলোপ, বর্গা আইন প্রচলন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও শুরু হয়েছে৷ তথাপি প্রচার চলছে এখনকার কৃষি অলাভজনক৷ সাধারণ চাষী বলছে চাষ করে লাভ নেই৷ কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে চাষ থেকে মাথা পিছু আয় ও মোট  আয় তো অনেক বেড়েছে৷ অথচ সাধারণ চাষীর ভাগ্য যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে৷ ব্যাপারটা কী?

বিষয়টা হ’ল একটা জটিল কর্কট রোগ৷ ভেতরে একটা গভীর রহস্য যা এ যাবৎ সর্বসাধারণের চোখের সামনে উদ্ঘাটিত হয়নি৷ প্রথমেই বলতে হয় বাঙলার কৃষির কতকগুলি মৌলিক সমস্যা আছে৷ নানা কারণে সেদিকে নজর পড়েনি বা দেখা হয়নি৷ প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটা হ’ল বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে আধুনিক সমাজে কর্ষকের কোনও সামাজিক মর্যাদা নেই৷ আবার দুই-এক কলম লিখতে-পড়তে পারা মানুষের এই মানসিকতা তৈরী হয়েছে যে চাষে কোনও জব স্যাটিস্ফ্যাকশান (মনের মত কাজ) নেই৷ ‘‘চাষীর ছেলে দু’চারটে বই পড়ার পর সে আর লাঙ্গল ঠেলতে চায় না৷ সে বাবু হতে চায়৷ চাষের কাজকে সে ছোট মনে করতে থাকে৷’’ ---বাঙলা ও বাঙালী (পৃষ্ঠা-৩১৯)৷ দৈহিক শ্রম নির্ভর কাজ ছোট কাজ৷ বৌদ্ধিক শ্রম নির্ভর কাজ সম্মানের কাজ৷ তাছাড়া আজকের অর্থ সর্বস্ব সমাজে মান-মর্যাদা-ষ্ট্যাটাস নির্ধারণ হয় অর্থের মাপকাঠিতে৷ চাষ কাজে বর্তমানে সাধারণ চাষীদের সেই আর্থিক স্বচ্ছলতাও নেই৷ তাই কৃষি ও কর্ষককে সামাজিক মর্যাদায় বা উচ্চকোটির ষ্ট্যাটাসে উন্নীত করতে না পারলে কৃষি-কর্ষকের দিনবদল সুদূর পরাহত৷

দ্বিতীয় মৌলিক সমস্যা হ’ল---প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোকের কৃষির ওপর নির্ভরতা৷ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাঙলার মসনদ দখলের পূর্বে বাঙলা কৃষিতে মোটামুটি ৪০ ভাগ নিযুক্ত ছিল৷ ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধ৷ ১৭৬৭ সালে  অর্থাৎ দশ বছর পর ওই শতকরা ছবিও দাঁড়াল প্রায় ৮০ ভাগ৷ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার বাঙলার ছোট-মাঝারি-বড় সমস্ত কলকারখানা ধবংস করে দিল৷ অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে সমস্ত লোক ভীড় করল এসে কৃষিতে৷ সেই ‘অনুপাত’ আজও বজায় আছে৷ আধুনিক সন্তুলিত অর্থনীতির নিরিখে (ব্যালান্স ইকনমি) কৃষিতে ৪০ ভাগের বেশী লোক থাকাটা সমৃদ্ধ-সুস্থ অর্থনীতির পরিপন্থী৷ ব্যালান্স ইকনমি বলছে কৃষিতে থাকবে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ, শিল্পে থাকবে ৩০ থেকে ৫০ ভাগ, ২০ ভাগ থাকবে অন্যান্য পেশায়৷ কাজেই কৃষি থেকে লোক অন্যত্র (শিল্পে) নিয়োগ না করতে পারলে কৃষি ও কর্ষকদের জীবনে অন্ধকার৷ তৃতীয়ত কৃষির উন্নতি-অবনতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সিড়ি ভাঙ্গা অঙ্কের মত জমির জটিল মালিকানা স্বত্ব বা ব্যবস্থাপনা৷ প্রজাস্বত্ব বা উৎপাদন বা ভোগের অধিকার স্বত্ব৷ জমি প্রকৃতির দান, ঈশ্বরের সৃষ্টি৷ মানুষ জমি সৃষ্টি করেনি৷ মানুষ তাকে চাষযোগ্য করেছে মাত্র৷ হিন্দু যুগ থেকে ব্রিটিশ শাসক শুরুর পূর্ব পর্যন্ত সকল প্রকার জমির চূড়ান্ত মালিক ছিল রাজা বা সম্রাট৷ চাষ-বাসের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব থাকত প্রাদেশিক শাসক কর্তা বা বিভাগীয় প্রধান বা সামন্ত প্রভুদের পরগণাদারদের ওপরে৷ খাজনার বিনিময়ে প্রজারা পেত প্রজা স্বত্ব৷ ব্রিটিশ এসে নির্দষ্ট রাজস্ব সুনিশ্চিত করতে চালু করল জমিদারী তন্ত্র৷ চালু হ’ল পাঁচশালা-দশশালা নানা বন্দোবস্ত৷ জমির প্রজাস্বত্ব গেল ঘুচে৷ জমির মালিকানা থেকে প্রজাকে উৎখাত করা হ’ল৷ জমির মালিক জমিদার নিজে চাষ করে না৷ সৃষ্টি হ’ল পত্তনিদার, দেপত্তনিদার, সে পত্তনিদার---জোতদার-নানা স্তরের মধ্যসত্বাভোগী ঠিকাদারি স্বত্ব৷ তারপর জোতদার, প্রান্তিক চাষী, বর্গাদার, ক্ষেত খামার নানা প্রজাতির স্বত্বাধিকার৷ স্বাধীনতার পর জমিদারতন্ত্র রোধ হলেও জোতদারী মহাজনী শোষণ আজও বর্তমান৷ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জমির খণ্ডীকরণ চলতে থাকে৷ ব্যষ্টিগত মালিকানায় চাষের সঙ্গে সঙ্গে চলে বর্গাচাষ বা চুক্তির ভিত্তিতে চাষ৷ জমির খণ্ডীকরণের ফলে আলের জন্য প্রচুর জমি নষ্ট হয়৷ নানা কারণে বর্গা চাষে বর্গাদারের আন্তরিকতার অভাবে উৎপাদন মার খায়৷ পল্লীগ্রামের প্রজাদের শোষণ বঞ্চনা ও দুরবস্থার পেছনে মালিকানা ব্যবস্থাই  গভীরভাবে ছড়িয়ে আছে৷

চতুর্থ কথা হ’ল, উৎপাদন ও উপভোক্তা ---এই দুইয়ের মধ্যে কয়েক স্তরের মধ্যসত্বাভোগীর উপস্থিতি কৃষি ব্যবস্থাকেই বেহাল করে দিয়েছে৷ (দালাল, ফড়ে, পাইকার, আড়তদার, মহাজন, মিল মালিক) চাষীর ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না৷ লাভের কড়ি চাষীর ঘরে পৌঁছায় না কৃষি নির্ভর ও অকৃষি শিল্প৷

পঞ্চমতঃ বিষয়টি হ’ল চাষীর প্রয়োজনীয় জলের অভাব৷ বাঙলার কৃষি মৌসুমী বৃষ্টিপাত নির্ভর৷ কিন্তু বর্তমানে গড়ে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে৷ তার ওপর মৌসুমী বৃষ্টিপাতের অনিশ্চিততা৷ অসম বণ্টন ও প্রয়োজন ও সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সময়মত বৃষ্টিপাতের অভাব কৃষি উন্নয়নের বড় বাধা৷ চাহিদানুগ বিকল্প সেচ ব্যবস্থাও সেভাবে গড়ে ওঠেনি৷ উপরন্তু বহু নদীনালা, খালবিল, দীঘি, পুকুর হয় শুকিয়ে গেছে নয়তো মজে গেছে৷ আবার বহু নদী গতিপথ পরিবর্তন করে দূরে সরে গিয়েছে৷ চলছে বিশ্ব উষ্ণায়ন৷ নির্বিচারে বনভূমি ধবংস করার ফলে ভৌম জলের স্তরও নেমে গেছে৷ জনবিস্ফোরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৃষিজ দ্রব্যের যোগান দিতে কর্ষকের নাভিঃশ্বাস উঠছে৷

প্রসঙ্গত আরও কিছু কথা না বললেই নয়৷ সবার অলক্ষ্যে সেগুলো সামবায়িকভাবে কৃষির ভূত-ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করে চলেছে৷ জগৎ তো পরিবর্তনশীল৷ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বে কৃষি-সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণা বদলাচ্ছে৷ বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের যোগান দিতে গিয়ে  পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেক  কিছুই ভাঙ্গাগড়া চলছে৷                                                                                           (ক্রমশঃ)