কর্ষকদের আন্দোলন শোষণ মুক্তির জন্যে

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

ভারতে বিগত কয়েকমাস ধরে কর্ষক বিদ্রোহ এখন নোতুন একমাত্রা পেতে চলেছে৷ সম্প্রতি ভারতের সংসদের কোন কক্ষেই আলাপ-আলোচনা না করে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অভিমত জানারও কোনরকম তোয়াক্কা না রেখে, বর্তমানের মোদী শাহ জমানা দেশের ‘‘কৃষি ও কর্ষক-স্বার্থ বিরোধী’’ যে আইন তিনটে পাশ করিয়ে নিলেন, এ থেকেই প্রমাণ করিয়ে দিলেন যে, মোদিজীর ভারতে ‘গণতন্ত্র’-টা ‘বাৎকী বাৎ’ মাত্র৷ এছাড়া মানুষকেই বেওকুফ বানাবার এক সুচিন্তিত কৌশলমাত্র৷ বিশেষ করে মোদী শাহ জমানার এই পদক্ষেপ বিগত শতাব্দীর ‘ইন্দিরাজী জমানাকেও’ হার মানিয়েছে৷ কেননা ইন্দিরাজী ভারতের সংসদ ও কেবিনেটকে পাত্তা না দিয়ে ঘুমে রেখে দেশে আচম্‌কা ‘জরুরী অবস্থা’ ঘোষণা করেছিলেন সেটার পেছনে ছিল ইন্দিরাজীর ব্যষ্টি-স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ্ রাখাটাই মূল উদ্দেশ্য৷ আর, মোদীজী যা’ করলেন ‘কৃষি ও কর্ষক স্বার্থ বিরোধী’ তিন-আইন পাশ করিয়ে নিয়ে চরম স্বৈরাচারিতাকে অবলম্বন করে সেটা শুধু যে, অপুত্রক মোদিজীর কিংবা শাহ্‌জীর (হলেও হতে পারে তা-ই নয়) স্বার্থরক্ষার খাতিরেই শুধু তা কিন্তু নয়৷ এ কাজটা তিনি করেছেন--- ভারতের বেনিয়া গোষ্ঠীর স্বার্থে---বিত্তশালী ব্যবসায়ীগণের তথা পুঁজিপতিদেরই স্বার্থে৷ অবশ্য,এতে করে যতই বিড়াল তপস্বী ভাব তারা ধরুন না কেন প্রকৃতির জগতে বাতাস ছাড়া যেমন গাছের পাতারা নড়ে না, তদ্রূপ স্বার্থ-ব্যতিরেকে মোদিজীরাও যে এত বড় দাপট দেখাতে চাইলেন তাও হতে পারে না বলেই বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি বলে গ্রহণীয়৷ তবে প্রশ্ণটা হল, কী তবে মোদীজীদের নিজস্ব স্বার্থ বা বদ-কৌশল থাকতে পারে? উত্তরটি কিন্তু খুবই সহজ৷ সেটা খুঁজে  বের করতে হলে আমাদের পেছন ফিরে একটু তাকাতেই হচ্ছে৷

আসুন না, আমরা বেশী দূরে না তাকিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে একটু তাকাই৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা বিশেষ মুহূর্তে এসে গান্ধীজীরা ‘‘বিদেশী বর্জন’’ ও ‘‘স্বদেশী দ্রব্য’’ ব্যবহারের ডাক দিয়েছিলেন৷ আর সেই আন্দোলনটাকে লুফে নিয়েছিলেন--- ভারতের তৎকালীন পুঁজিপতি, শিল্পপতি, বড় বড় ব্যবসায়ীরা৷ এরও বড় কারণটা ছিল ইংরেজ-রাজত্বে ম্যাঞ্চেষ্টারের বস্ত্র-শিল্পকে হার মানিয়ে এদেশের টাটা-বিড়লা-গোয়েঙ্কা প্রমুখদের ব্যবসাকে চাঙ্গিয়ে তোলা আর তাদেরই মিলজাত গুজরাট-সুরাট-আমেদাবাদের বস্ত্রশিল্পের খাতে জোয়ার এনে দেওয়া৷ তারই সুবাদে মোটা কাপড় আর মোটা ভাতের পক্ষে জিগির তুলে খদ্দেরের চাহিদা বৃদ্ধি করে তোলা, কেননা বাঙলার মসলিনের দফাও আগেই রফা হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের ইষ্টইন্ডিয়া কোং-এর দাপটে৷ ওই সময়ে অহিংসপন্থী গান্ধীজীও কিন্তু নিষ্কর্মা হয়ে বসেছিলেন না৷ তাঁর স্বরাজ্য আর স্বাবলম্বনী গ্রাম-জাগরণের চিন্তাধারা তখনও মস্তিষ্কে ছিল কিনা জানা না গেলেও, তিনি নিজেও বিড়লার বাসভবনে ভোজের আমন্ত্রনে উপস্থিত ছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে৷

তারও পরে, স্বাধীনতার নামে যেদিন দেশ ভাঙার চক্রান্ত নিয়ে মহীরুহরা রাত্রিজাগরণ করেছিলেন, সেই রাতের গোপন বৈঠকেও ব্রিটিশের মনোনীতরা ছাড়া এ দেশীয় কতিপয় ক্ষমতালোলুপ, স্বার্র্থন্ধ, বড় বড় পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী, অভিজাত ভূ-স্বামীগণ হিন্দুত্ববাদ আর মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্ব করতে জড় হয়েছিলেন--- এছাড়া শ্রমজীবী-কৃষিজীবী-ভুখা তথা গরীবগুর্র্ব ভারতের কোনই প্রতিনিধিত্ব ছিল না৷ যে কারণে ব্রিটিশের প্রদর্শিত পথ ধরেই তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া শুধু পলিটিক্যাল ক্ষমতা হস্তান্তরটাকেই অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বাধীনতাকেই লুফে নিয়ে তামাম ভারতবাসীকে ‘বোকা’ বানিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেরা ক্ষমতা জাহিরের মসনদ দখল করেছিলেন৷ সেদিন যদি রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও পাওয়া সম্ভব হত,তাহলে ভারতবাসী সত্যিকারের স্বাধীনতার আস্বাদন পেতে সক্ষম হতেন৷ বিশেষ করে, স্বাধীনতা-সংগ্রামে যদি ‘‘ব্রিটিশ হঠাও’’ শ্লোগানের পরিবর্তে শোষণ হটাও‘‘শ্লোগান গুরুত্ব পেত, তাহলে--- (ক) দেশ-বিভাজনের প্রশ্ণ উঠত না (খ) শোষকগোষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা সরে যেতে বাধ্য হত (গ) এরই সুবাদে দেশীয় শোষক তথা পুঁজিপতিরা জব্দ হতেন (ঘ) তাহলে ভারতবাসীর ভাগ্যে শোষণ-মুক্তির কর্ষক আন্দোলন, বুভুক্ষু ভারতবাসীদের জন্যে ‘গরীবী হটাও’ আর ‘বেগার কাজ চাই’ ও কর্ষক-আন্দোলনের কিংবা খুবই সম্ভবত ‘বেকার-সমস্যার’ দাবানলের তীব্র দহনজ্বালা পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে ভারতবাসীকে সহ্য করতেও হত না৷ কিন্তু,তা হল না--- হয়ে উঠতে দেয়নি বলে হয়ে হঠেনি৷ এজন্যে দায়ী---বিদেশী বেনিয়া আর দেশীয় বেনিয়া যুগপৎভাবেই উভয়গোষ্ঠী৷

আরও একটু বলতে হচ্ছে৷ ব্রিটিশ-শাসনমুক্ত ভারতে সংবিধানের খসড়া -রচনা কমিটিতেও কিন্তু আপামর অথবা নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত অর্থাৎ---শ্রমজীবী, কর্ষক-সম্প্রদায়, ছা-পোষা বিত্তহীন ভূমিহীন মানুষদের কোনই প্রতিনিধের জায়গা ছিল না৷ তাই, সংবিধানেও রচিত হয়েছিল---একমাত্র উপরতলার (হ্যাভ্‌স-দের) মানুষদের উপরই নজর রেখে৷ যে কারণে প্রদীপের আলোর বিকিরণ যাতে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয় সেটাই সংবিধান-রচয়িতাদের  ধ্যান-জ্ঞান ছিল, কিন্তু আলোর তীব্রতা ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে যে প্রদীপের সলতের নীচে তেলের যোগান নিতান্ত প্রয়োজন, রচয়িতাদের চিন্তাধারায় তার লেশমাত্রও ছিল না৷ এ কারণেই ‘সংবিধান খসড়া-রচনা কমিটির’ চেয়ারম্যান ড. আম্বেদকরজীকে সাংবাদিকরা পরবর্তীকালে প্রশ্ণ করলে প্রত্যুত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন---‘সবাই ভাবে আমি সংবিধান-রচনার জনক৷ তবে আমি যদি জনকই হতাম তাহলে আই শ্যাল বার্ণ ইট আউট৷’

                                                                        (এরপর পরবর্তী সংখ্যায়)