কৃষি বিপ্লব

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ভারতবর্ষের সমস্যা কিন্তু অন্য ধরণের৷ এখানে কৃষিব্যবস্থা তথা শিল্পবিপ্লবের উন্নতি করবার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে৷ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার হয়নি লে তার এত অভাব৷ মূলতঃ ভারতের অর্থনৈতিক সমস্যা দ্বিবিধ৷

১৷ কৃষি ব্যবস্থার  উন্নতি করে একটি বিশেষ সংখ্যক লোককে নিয়োজিত করে এতে খাদ্য-সমস্যার সমাধান করা, ২৷ শিল্প-কারখানার প্রসার করে বর্তমানে জমির ওপর যে অত্যধিক জনসংখ্যার চাপ রয়েছে তা কমিয়ে তোলা ৷ সুতরাং ভারতের সমস্যা সমাধান করতে হলে জমির ক্ষুধা জাগিয়ে অপরের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিলে কিছু হবে না৷ অর্ন্তদেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধিই একমাত্র উপায়৷ সুতরাং যাঁরা ভারতের পথ চীনের কৃষিবিপ্লবের পথ লে চিৎকার করেন তাঁদের চিন্তার গোড়াতেই গলদ রয়েছে৷

ভারতবর্ষে আর একটি রাজনৈতিক শাখা কৃষিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে চান, তাঁদের নীতি হ’ল সমস্ত শক্তি জনগণের হাতে All power to masses)৷ তাঁরা চান প্রত্যেকে কিছু না কিছু জমির মালিক হোক,landless বা জমিহীনভাবে কেউই থাকর্বে না৷ এই সেণ্টিমেণ্ট খুবই সস্তা৷ সেণ্টিমেণ্ট দিয়ে গরীব মানুষকে সহজেই এতে বশীভূত করা যেতে পারে ও তাঁরা জনসাধারণকে এইভাবে লোভ দেখিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির হাতিয়ার করে তুলেছেন৷ কারণ সাধারণ মানুষ এসব কিছুই ােঝে না৷ জমি নেই কিন্তু জমি পর্া একথা ভেবেই সে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে৷ আর এদের নিয়ে রাজনৈতিক নেতাগণ কাজ হাসিল করে নেন, এইভাবে বর্তমানে বিশেষ রাজনৈতিক দল জোতদারদের কাছ থেকে জোর করে জমি কেড়ে  নিয়ে সাধারণ  মানুষদের মধ্যে  ভাগ করে  দেওয়ার পক্ষপাতী৷ তাই বর্র্গদার  ও জমিদারদের  মধ্যে এক সংঘর্ষ তাঁরা সৃষ্টি  করে দিয়ে  মানবদরদী খেতাব  পেয়েছেন৷ এখন দেখা যাক তাঁদের এই অর্থনৈতিক  পরিকল্পনা  কতখানি  ভারতের  অর্থনৈতিক  বিকাশে  সহায়ক হবে৷ প্রথমতঃ অতিরিক্ত জমি যদি  ভূমিহীন  ব্যষ্টিদের  মধ্যে বণ্টন  করে দেওয়া  হয় তবে  প্রত্যেকের  ভাগে  সর্র্বাধিক হলেও  তিন বিঘা চার বিঘা করে জমি  পড়বে৷  এই তিন বিঘা  জমি দিয়ে কখনও  লাভজনক জোত economic holding) সৃষ্টি  হয় না৷ কারণ  এতে আধুনিক  বৈজ্ঞানিক  উপায়ে চাষ করা সম্ভব হয় না৷ যথেষ্ট জমি  আইল সৃষ্টির জন্যে  নষ্ট হয়ে যায়৷ এই দুই কারণে  উৎপাদন  বৃদ্ধি  হওয়া সম্ভব  নয়৷  কিন্তু  উৎপাদন  বৃদ্ধিই এখন একমাত্র প্রয়োজন৷ তাছাড়া এই ধরণের জমি বণ্টনের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে  জমির আয়তন  আরও  ছোট হয়ে যাবে ও সমস্যা ক্রমশঃ বাড়তেই  থাকর্বে৷ দ্বিতীয়তঃ এই ব্যবস্থার দ্বারা  সৃষ্টি হবে  অসংখ্য পেটি বুর্র্জেয়া৷ পেটি বুর্জেয়া তাদেরই  লে  যারা  অর্থনৈতিক  অসুবিধার  জন্যে  বাধ্য  হয়ে  জমি অপরকে  দিয়ে  চাষ করিয়ে শ্রমবর্জিত লাভ (unearned  income) পেতে চায়৷  তিন বিঘা করে জমি  পেলে  প্রথমে মানসিক সন্তুষ্টি  পাওয়া যাবে  টে  কিন্তু  চাষ  করার  পর যখন  দেখা যাবে  যে এই তিন বিঘাতে  তার কোন  উপকার হচ্ছে না তখন  তার মন  দুঃখে  ভরে যাবে৷  এই তিন বিঘা জমি  চাষ  করার জন্যে তার সমস্ত শক্তি, সামর্থ্য ব্যয় করতে হবে৷ ব্যষ্টিগতভাবে চাষ করার ফলে উন্নত  ধরণের  কৃষি পদ্ধতি  প্রয়োগ  করা সম্ভব নয়৷ তাই বিনিময়ে সে যতটুকু  ফসল  পাবে তাতে  পরিবারের ভরণপোষণ সম্ভব  হয়ে উঠবে  না, তখন বাধ্য  হয়ে  সে জমিকে অপরকে দিয়ে  নিজে  অন্য কোন উপায়ে  অর্থ উপার্জনের  ব্যবস্থা  করবে৷ ফলে পুনরায়  জোতদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি হবে   ও এরাই  হবে  পেটি  বুর্জোয়া৷ সুতরাং যাঁরা জোতদারদের ঘৃণা করে, জোতদারদের  ধবংস  করতে  চায়  লে  শ্লোগান  দেন,  তাঁরাই রাজনৈতিক  স্বার্থের  জন্যে আদর্শ থেকে  বিচ্যুত  হয়ে নোতুন  জোতদারদের সৃষ্টি করে চলেছেন৷

তৃতীয়তঃ জমি বন্টনের  আগে  এরা জোতদারদের কাছ থেকে  ধান  কেড়ে  নেওয়া, চুরি করে নেওয়া বা পাকা  ধানে  আগুন  লাগিয়ে দেওয়া প্রভৃতি  ধবংসাত্মক  কাজ করে  জোতদারদের প্রতি  এক প্রতিহিংসার  ইন্ধন  জুগিয়ে থাকে৷  এর ফলে  এই সমস্ত  জোতদারেরা সুরক্ষার  অভাবে  জমির  উৎপাদনে  ক্রমশঃই উদাসীন  হয়ে যাবে৷  এই সবগুলো  কারণ  মিলিয়ে  ভারতের  যে প্রধান  কৃষি সমস্যা তার সমাধান  না হয়ে  বরং সেটা  আরও  বৃদ্ধি পাবে৷

তাই ভারতের  কৃষি সমস্যাকে  দূর করতে হলে  চীনের  পথ  বা ‘‘লাঙ্গল  যার  জমি  তার’’ এই নীতিতে  কিছুই  হবে না৷

 এরজন্যে সমস্ত কৃষি  ব্যবস্থারই আমূল পরিবর্ত্তন  করতে হবে৷  প্রগতিশীল তত্ত্ব অনুসারে  উৎপাদন  বৃদ্ধির  জন্যে  সর্বপ্রথমeconomic holding (আর্থিকভাবে লাভজনক জোত) করার প্রয়োজন৷ Economic holding -এর অর্থ  হ’ল  যেখানে Input  থেকে output  বেশি হয়৷  এই economic unit -এর কোন বিশেষ  আয়তন  নির্র্ধরিত  করা সম্ভব নয়৷ কারণ Input, output,productivity  প্রভৃতির দিকে লক্ষ্য  রাখতে হলে  জমির উর্বরতা, জলবায়ু  প্রভৃতি  সমস্ত  কিছুকে  বিচার  করে’ সর্বাধিক আয়তন optimum size  নির্র্ধরণ করতে হবে৷  আজকাল অনেকে বিশ্বাস  করেন  যে জমির  আয়তন  ছোট  হলেও উৎপাদন  বেশী হয়৷ তা ঠিক  নয়,  উৎপাদন  বেশী হয় ব্যবস্থাপনার সময়মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের তৎপরতার ওপর৷ যদি ব্যবস্থাপনাকে পারদর্শী করে তোলা যায় তবে  বড় বড় খামারগুলিতেও  বেশী উৎপাদন  হতে পারত৷  অবশ্য, ড় খামারই  যে  হতে হবে  তার কোন কথা নেই৷ ৷ মূল কথা  হ’ল যে economic holding  হওয়া চাই৷  রাশিয়ার  মত বড় বড় Collective Farm  করে’ শতকরা পনের  ভাগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হবার পেছনে  কোন বিবেকপূর্ণ  যুক্তি  নেই৷  তাই  উৎপাদনের  দিকে  লক্ষ্য রেখে  ও বড় বড় শোষক  জোতদার  যাতে না  গড়ে উঠতে  পারে  সেদিকে লক্ষ্য  রেখে, জমির  উচ্চতম ও নিম্নতম  আয়তন  নির্ধারিত  ক’রে  দিতে হবে৷ নিম্নতম আয়তন  হবে, একটি বিশেষ স্থানের Economic holding-এর আয়তনের সমান৷ আর সর্র্বাধিক  আয়তন নির্ভর  করবে এই  জমি উর্বরতা, সামাজিক উৎপাদন  ও ব্যবস্থাপনার  পারদর্শিকতাকে বিচার  করে৷ তাই economic holding-গুলি সাধারণতঃ একই সমতলে অবস্থিত জমি নিয়ে গঠিত হবে যাতে করে জলসেচের ও কৃষিকার্যের সুবিধা হয়৷ এইসব কিছুকে মনে রেখেeconomic holding এর আয়তন বৃদ্ধি করতে হবে৷ এহ holding- বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে৷ একই দেশের  মধ্যেও আবার  তার আয়তন  পরিবর্তন  করতে পারে৷ যেমন গাঙ্গেয় উপতক্যার  সমতল  অঞ্চলে  পাঁচ  একর জমিতে  যথেষ্ট  উৎপাদন  হতে পারে,  আবার  লাদাক  বা ছোটনাগপুর  পাহাড়ী এলাকায় ৫০ বিঘাতেও হয়তো  জীবনরক্ষার  মতও  সর্বনিম্ন উৎপাদন  হবে না৷  তাই এই দুই স্থানের  ইকনমিক  হোল্ডিং-এর আয়তন  ভিন্ন ভিন্ন হতে  হবে৷  মনে রাখতে  হবে, শুধু জমি দিয়ে দিলেই  কারোর সমস্যার  সমাধান  হয় না৷  জমির মালিকানাই ড় কথা নয়, ড় কথা হ’ল  জমির উৎপাদন৷

দ্বিতীয়ত ঃ জমির  ব্যবস্থাপনার  ভার একজনের  হাতে থাকলেও আশা  মত  উৎপাদন হয়ে ওঠে না৷ কারণ  ব্যষ্টিগতভাবে  আধুনিক  উপায়ে  চাষ করবার মত উপযুক্ত মূলধন লাগানো সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না৷ তাই জমির উৎপাদন ক্রমশঃ কমতে থাকে৷ তাছাড়া সুস্থ অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ অত্যাবশক৷ এই বিকেন্দ্রীকরণের জন্যে সামবায়িক সংস্থার হাতে কৃষি ব্যবস্থাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত৷ কিন্তু সমবায় প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিতে হঠাৎ করে সমস্ত জমির পরিচালনার ভার ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না৷ কারণ, সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেই জনমণ্ডলীর মিলিত শ্রমে ও বুদ্ধিতে, যে জনমণ্ডলী একই আর্থিক কাঠানোয়, একই প্রয়োজনের তাগিদ নিয়ে বাস করছে ও সমবায় ভিত্তিতে উৎপন্ন বস্তুর তৈরী বাজার মোটামুটি বিচারে হাতের কাছে পাচ্ছে৷ এই তিনটি তত্ত্বের একত্র সমাবেশ না হলে সংস্থাকে আর সামবায়িক সংস্থা বলা চলে না৷ তাই এইভাবে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে ধীরে ধীরে জমির ব্যবস্থাপনা সমবায়ের ওপর ছেড়ে দিতে হবে৷ এর ফলে ব্যষ্টিগত অধিকারের দোষত্রুটি থাকবে না৷ আর যথোপযুক্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়াও অল্পায়াসেই সম্ভব হবে৷ (ক্রমশঃ)