কৃষি বিপ্লব

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

পূর্ব প্রকাশিতের পর

প্রাউটের কৃষি ব্যবস্থায় দালাল বা মধ্যবর্তী ব্যষ্টিদের(intermediary) কোন স্থান থাকবে না৷ যারা নিজের মূলধনকে বিনিয়োগ করে অপরের শ্রমে উৎপাদন করিয়ে মুনাফা লাভ করে তারাই হয় পুঁজিপতি৷ তারা অন্য মানুষের ওপর পরগাছার মত রস চুষে চুষে বেঁচে থাকে৷ কৃষি ক্ষেত্রে যারা মধ্যবর্তীর কাজ করে তারাই কৃষি-পুঁজিপতি৷ তারা অপরকে নিজের জমি দিয়ে চাষ করিয়ে নিয়ে ফসল নিয়ে নেয়৷ ভারতে এই দালাল(intermediary)-ব্যবস্থা ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে৷ জমিদার পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, সেপত্তরিদার, জোতদার, অধিকারী প্রভৃতি ভারতের এই দালালের গোষ্ঠী৷ বর্তমান ভারতের জমিদারী বা বাটাইদার ব্যবস্থার লোপ করা হয়েছে৷ কিন্তু সামন্ততন্ত্রের মনোভাব এখনও দূর হয়নি৷ বর্তমানের এই সামন্তরা জমির প্রকৃত মালিক নয়৷ তারা অপরের কাছ থেকে জমি ‘লীজে’ নিয়ে অপরকে দিয়ে চাষ করিয়ে কিছু ধান জমির মালিককে দেয়৷ ফলে সে জমির প্রকৃত মালিক ও উৎপাদক কৃষক উভয়কেই শোষণ করে৷ এই মধ্যসত্ত্বভোগীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে৷ প্রাউট এই ধরণের মধ্যসত্ত্বভোগীদের সমর্থন করে না৷ ‘‘লাঙ্গল যার জমি তাঁর’’ বা ‘‘ধান বুনে যে, ধান কাটে সে’’ এদু’য়ের কোন নীতিকেই অনুসরণ করা যায় না৷ কারণ এর ফলে পেটি বুর্জোয়ার সৃষ্টি হয়৷ প্রাউটের মতে, কৃষিবিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে সামবায়িক ব্যবস্থায় ব্যষ্টিগত মালিকানা স্বীকার করে নেওয়া যেতে পারে ও ব্যষ্টিগতভাবে শ্রম বিনিয়োগ করে চাষ করবার অধিকারও দেওয়া যেতে পারে৷ কিন্তু সেক্ষেত্রে সমগ্র উৎপাদনের শতকরা ৫০ ভাগ এই মজদুরদের পারিশ্রমিকের জন্যে দিয়ে দিতে হবে৷ যার জমি সে পাবে সমগ্র উৎপাদনের অর্ধেক, যারা তাদের শ্রম দিয়ে উৎপাদন করল তারাও পাবে অর্ধেক ভাগ৷ এই অনুপাত কখনও কমবে না, বরং বাড়তে পারে৷

সমবায়ের পরিচালনার জন্যে যে ব্যবস্থাপক সমিতি(managerial staff) থাকবে তা তৈরী হবে তাদের নিয়ে যাদের এই সমবায়ে অংশ(share) রয়েছে৷ তারা হবে নির্বাচিত৷ এই ব্যবস্থাপক সমিতিকে অনারারি(honorary) করা উচিত নয়৷ তাতে দুর্নীতির সুযোগ থাকে৷ তাই তাদেরও বৌদ্ধিক উপদেশের(intellectual advice) জন্যে ম্যান পাওয়ার(man power) অনুযায়ী বেতন দিতে হবে৷ তাছাড়া যারা সমবায়ের সদস্য তারা ইচ্ছা করলে দৈহিক শ্রমও নিয়োগ করতে পারে৷ কিন্তু তার জন্যেও তাকে আলাদা পারিশ্রমিক দিতে হবে৷ তাই সদস্যরা দু’ধরণের অংশ পাবে---একটি তার জমির পরিমাণ অনুসারে আর দ্বিতীয়টি হ’ল তার শ্রম বিনিয়োগ বাবদ৷ কিন্তু এই অংশ র্দোর জন্যে সমস্ত উৎপাদনকে সমান সমান দু’ভাগে ভাগ করতে হবে অর্থাৎ ৫০ ভাগ শ্রমের জন্যে ও ৫০ ভাগ জমির জন্যে বণ্টন করতে হবে৷ কৃষির উন্নতির জন্যে অনেক সময় টেকনিসিয়ান(technician) বা কৃষি বিশারদের প্রয়োজন হয়ে থাকে৷ তাই উৎপাদক সমবায়গুলি এই ধরণের বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করবেন৷ এর ফলে এই ধরণের শিক্ষিতদের কোর বসে থাকতে হবে না বা গ্রাম ছেড়ে শহরে যেতে হবে না৷ সঙ্গে সঙ্গে কৃষিরও উন্নতি হবে৷ প্রাউট অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী৷ তাই বিশেষ এক স্থানের উন্নতি না করে সর্বত্র যাতে সমানভাবে প্রগতি হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে স্থানীয় সম্পদ ও শক্তি-সামর্থ্যকে প্রথমে নিয়োগ করার পরিকল্পনা নিতে হবে৷ তাই স্থানীয় লোকদের প্রথমে কৃষি-সমবায়ে নিয়োগ করতে হবে৷ বর্তমান ভারতে অনেক উদ্বৃত্ত শ্রম ও ঘাটতি-শ্রম এ দু’ধরণের এলাকা থেকে লোক অন্য অঞ্চলে চলে যায়৷ কিন্তু এই উদ্বৃত্ত শ্রম কথাটাই আপেক্ষিক৷ যেখানে উপযুক্ত অর্থনৈতিক বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া হয়নি, সেখানে শ্রম উদ্বৃত্ত হয়ে যায়৷ সেইর্স শ্রম অন্যত্র চলে যাবার মানেই হ’ল সেই অঞ্চলকে স সময়ের জন্যে অনুন্নত করে রাখা৷ তাই প্রাউটের মতে যেখানে যেখানে উদ্বৃত্ত শ্রম অঞ্চল রয়েছে সেখানে অতি শীঘ্র স্থানীয় শ্রমিকদের চাকুরির বন্দোবস্ত করে দিতে হবে৷ তাতে স্থানীয় অঞ্চলের লোকদের জীবন-যাত্রার মানেরও বৃদ্ধি সম্ভব হবে৷ যদি তা না করে স্থানীয় শ্রমকে অন্যত্র বেরিয়ে যেতে দেওয়া হয় ও মার্কসবাদীদের ‘‘He who sows shall reap’’---এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়, তবে যে সমস্ত চা বাগান বা কয়লা খনি অঞ্চল রয়েছে তার মালিক হয়ে বসবে বাইরের থেকে আগত শ্রমিকবৃন্দ আর স্থানীয় লোক সুযোগ পাবে না৷ এতে অতীব বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে৷ তাই প্রাউটের অভিমত হ’ল---স্থানীয় লোককে প্রথমে সুযোগ দেওয়া উচিত৷ যতক্ষণ না স্থানীয় লোকদের পুরোপুরি নিয়োগ করা যাচ্ছে ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷ পরে মজুরীর চাহিদা না আসা পর্যন্ত নোতুন কোন উন্নতি-মূলক(Fresh Development Programme) কর্মসূচী নেওয়া হবে না৷ স্কেনণ্ডিনেবিয়ান দেশগুলি নোতুন ডেবলপমেণ্ট স্কিম(development scheme) নিচ্ছে না৷ স্থানীয় লোকদের চাকুরির বন্দোবস্ত করার সময় লোকাল সেণ্টিমেণ্টকেও (local sentiment) বিচার করতে হবে৷ যেমন ভারতের কতকগুলি প্রদেশের যে সকল উদ্বৃত্ত বৌদ্ধিক ভূমি (land of surplus intellect) আছে, যারা কেরানীগিরি করে, ৩০ টাকা পেলেও রাজী, কিন্তু কুলীর কাজ করবে না, তাদের সমস্যা তাই ভিন্ন রকমের, তাই তাদের সমস্যাকেও সেইভাবে সমাধান করতে হবে৷ সেই অঞ্চলের শিল্প কারখানায় যত কম পরিমাণ দৈহিক শ্রম লাগে তার ব্যবস্থা করতে হবে৷ এইভাবে বিভিন্ন সোসিও-ইকোনোমিক ইউনিট (socio-economic unit)-এ দেশ-কাল-পাত্র অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের উন্নতির পরিকল্পনা নিতে হবে৷

কৃষির খাজনার জন্যে বর্তমানের যে ব্যবস্থা রয়েচে তা সমর্থন করা যায় না, কারণ তাতে আয়কারী ও কর্ষক উভয়েরই অসুবিধা৷ িরটিশ আমলেও যে জমিদারী ব্যবস্থায় কর আদায়ের ব্যবস্থা ছিল তাও ত্রুটিপূর্ণ৷ জমিদারদের জমির পরিবর্তে বছরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা কর্ষকদের দিতে হ’ত৷ বন্যা হলে া কোন কারণে ফসল না হলেও এই নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দিতেই হ’ত৷ আর জমিদাররা শুধু পরগাছার মত বসে বসে খেত৷

বর্তমানেও জমির পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে কর নির্ধারিত হয়৷ তাই কোন বৎসর ফসল না ফললে সরকারকে করের পরিমাণ হ্রাস করতে হয়৷ আবার শীে ফসল হলে লেবির দ্বারা কর াড়াতে হয়৷ এর ফলে কর্ষকদের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়৷ সব থেকে উত্তম ব্যবস্থা ছিল প্রাচীন হিন্দুযুগে তখনকার দিনে সমস্ত ফসলের ১/৪ অংশ দ্রব্যের মাধ্যমে রাজাকে কর দিতে হ’ত৷ এতে গোরু, ঘোড়া, ভেড়াও দিতে পারতো৷ এতে কর্ষকদের কর দানে কোন অসুবিধা হ’ত না, বর্তমানে নগদ টাকায় খাজনা দিতে গিয়ে ওদের খুব অসুবিধায় পড়তে হয়৷ কারণ সবসময় কর্ষকেরা উপযুক্ত বাজার না পাওয়ার ফলে উৎপাদিত দ্রব্যকে বিক্রী করে নগদ টাকা জোগাড় করতে পারে না৷ তাই, প্রাউটের মতে কর্ষকদের নিকট থেকে প্রকৃত উৎপাদিত ফসলের এক অংশ প্রত্যক্ষ কর আদায় করলে সরকারেরও সুবিধা কারণ বিভিন্ন স্থানে ভবিষ্যতের বিপদ-আপদের জন্য মজুত রাখার সুবিধা হবে৷ প্রয়োজনমত সহজেই দুঃস্থ ব্যষ্টিদের সাহায্যে তা প্রেরণ করা সহজ হবে৷ তাছাড়া শহরের চাহিদাও মেটানো যার্বে

উপর্যুক্ত পদ্ধতি অনুযায়ী ভারতের অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব৷ তাই শুধু বর্গাদাররা জোতদারদের পিটালে বা হত্যা করলেই বা কৃষিবিপ্লবের শ্লোগান দিলেই কাজ চলবে না৷ রচনাত্মক কাজ করে অর্থনীতিকে মজবুত করার মধ্যেই কৃতিত্ব৷ সদ্বিপ্রদের জনস্বার্থের খাতিরে সেই মহান দায়িত্ব নিতে হবে৷