কৃষিক্ষেত্রে পঁু জি পতিদের অবাধ মুনাফা লুণ্ঠনের সুযোগ

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

কৃষিবিল নিয়ে সংসদ তোলপাড়৷ বিজেপি সরকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধীদের সমবেত বিরোধিতা সত্ত্বেও সহজেই লোকসভায় এই বিল পাশ করে নেয়৷ রাজ্যসভায় কিন্তু এত সহজে এই বিল পাশ করা সম্ভব নয়৷ রাজ্যসভায় বিরোধীরা এই বিলের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে৷

এই পরিস্থিতিতে ৮জন বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করেন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান বেঙ্কাইয়া নাইডু৷

এখন প্রশ্ন কী আছে এই কৃষি বিলে? এক কথায় এই দুটি বিলের মাধ্যমে পুঁজিপতিদের কৃষিতে প্রবেশের অবাধ অধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে৷ এদের মধ্যে একটি হ’ল চুক্তি চাষ সম্পর্কিত৷ আর অন্যটি এ.পি.এম.সি (এগ্রিকালচার্যাল প্রডিউস মার্কেট কমিটি)-এর ক্ষমতা খর্ব করা৷ এই বিল আইনে পরিণত হলে কৃষিক্ষেত্রেও অবাধ মুনাফা লুণ্ঠনের সুযোগ পাবে পুঁজিপতিগোষ্ঠী৷ চাষীরা পুঁজিপতিদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পুঁজিপতিদের পছন্দমত ফসল উৎপাদন করতে বাধ্য হবে ও তা নির্ধারিত মূল্যে ওই পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রয় করতেও বাধ্য থাকবে৷ চাষীরাও দারিদ্র্যের কারণে  এইভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে পুঁজিপতিদের হাতের খেলনা হয়ে উঠবে৷ পুঁজিপতিরাও এই সুযোগে চাষীদের চরমভাবে শোষণ করে চলবে৷

নীলদর্পণের কথা মনে আছে? ভারতে একসময় ব্রিটিশ বেনিয়ারা ভারতের চাষীদের সঙ্গে চুক্তি করে নীল চাষের ব্যবস্থা করেছিল৷ তারপর কীভাবে নীলচাষ নিয়ে ভারতের চাষীদের শোষণ করা হত, শেষ পর্যন্ত  নীল বিদ্রোহ দেখা দেয়, নীলচাষকে কেন্দ্র করে সাহেবদের শোষণ ও অত্যাচারের এই ইতিহাস বর্ণিত হয়েছিল দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকে৷

চুক্তি চাষ হচ্ছে অনুরূপ৷ পুঁজিপতির সর্বাধিক মুনাফার দিকটা চিন্তা করে তাদের পছন্দমত পণ্য উৎপাদন করার উদ্দেশ্যে চাষীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবে৷ যেমন, পুঁজিপতিরা হয়তো মনে করল, আন্তর্জাতিক বাজারে গোলাপ ফুলের চাষ খুবই লাভজনক৷ কারণ এর থেকে নির্যাস বের করে সুগন্ধী দ্রব্য তৈরী হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রয় করলে প্রচুর পরিমাণে লাভ হবে৷ তখন  পুঁজিপতিরা চাষীদের সঙ্গে অগ্রিম চুক্তি করে চাষীদের দাদন দিয়ে তাদের জমিতে গোলাপ ফুলেরই চাষ করাবে, আর তা ওই চুক্তিবদ্ধ পুঁজিপতিদের বিক্রয় করতে বাধ্য থাকবে৷ এরপর দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিলেও পুঁজিপতিরা না  চাইলে তাদের জমিতে ধান,গম বা রবিশস্য উৎপাদন করতে পারবে না৷

এইভাবে চাষীর স্বাধীনতা চলে যাবে, দেশবাসীর ভাগ্যও ওই  মুষ্টিমেয় ধনকুবের পুঁজিপতিদের সিন্দুকে আবদ্ধ হয়ে যাবে৷ এইভাবে দেশে দুর্ভিক্ষ ডেকে আনা হবে৷ বছরের পর বছর পুঁজিপতিদের প্রয়োজনমত চাষ করার ফলে জমিও অনুর্বর ও চাষের অযোগ্য হয়ে  যাওয়ার সম্ভাবনা ৷ এটা হ’ল গ্রামাঞ্চলের ছোট-ছোট মধ্যসত্ত্বভোগী বা মহাজনদের  কবল থেকে উদ্ধার করার নাম করে চাষীদের বড় বড় কর্র্পেরেটদের অর্থাৎ বিরাট বিরাট পুঁজিপতি হাঙরদের মুখের সামনে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা৷

এ.পি.এম.সি অর্থাৎ কৃষিপণ্য বাণিজ্যের নোতুন বিলে কী আছে?  রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রিত কৃষি মাণ্ডি ও সরকারী নির্ধারিত মূল্যের বাইরে খোলাবাজারে পুঁজিপতিরা যাতে চাষীদের উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ কৃষিমাণ্ডিগুলি রাজ্যসরকারের নিয়ন্ত্রাধীন, ফসলের নূ্যনতম মূল্য ও নির্ধারণ করে রাজ্য৷ এতে কৃষিপণ্যগুলির বিক্রির ওপর প্রাপ্য কমিশনের আয় ও মাণ্ডিগুলির আয়ও কমে যাবে৷ অন্যদিকে কৃষিগত দ্রব্যের আন্তঃরাজ্য চলাচলের ওপরও রাজ্যের আর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না৷

বর্তমানে যা চলছে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের কোনও খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেলে ওই পণ্যের বিপণনকে রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করে৷ সংসদের এই বিল আইনে পরিণত হলে রাজ্য সরকারগুলি সে ক্ষমতাও হারাবে৷ অর্থাৎ কৃষি উৎপাদন ও কৃষিপণ্যের বিপণনের ক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম হতে চলেছে৷

এদিন অর্থাৎ ২২শে সেপ্ঢেম্বর ৮জন বিরোধী সাংসদের সাসপেনসনের প্রতিবাদে  সমস্ত বিরোধী সাংসদরা রাজ্যসভা বয়কট করেন৷ এই পরিস্থিতিতে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি সংক্রান্ত বিলও কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যসভায় বিনা বাধায় পাশ করিয়ে নেয়৷ এই বিল আইনে পরিণত হওয়া মানে চাল,ডাল, আলু,পেঁয়াজ প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যগুলিও মজুত করার ক্ষেত্রে আর কোনো ঊধর্বসীমা রাখা হ’ল না৷

এক কথায় কেন্দ্রীয় সরকার সাময়িকভাবে স্থানীয় মহাজনদের হাত থেকে চাষীদের  রক্ষা করার নাম নিয়ে ও চাষীদের আর্থিক অসহায়তায় সাহায্যের প্রলোভন দেখিয়ে কৃষিক্ষেত্রে বড় বড় কর্র্পেরেটদের প্রবেশের দরজা খুলে দিচ্ছে৷ রিলায়েন্স, আম্বানি শিল্পগোষ্ঠী, পতঞ্জলি, হিন্দুস্থান লিভার প্রভৃতিকে এবার কৃষিক্ষেত্রে অবাধ মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে৷