‘কৃষ্ণ’ নামের একাধিক ব্যাখ্যা

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

আজ গীতার একটা শ্লোক নিয়ে আলোচনা করব৷ শ্লোকটাকে গাইডিং বা কন্ট্রোলিং শ্লোকও বলতে পার৷ ব্যাখ্যাটা বিস্তৃত ভাবেই করব৷ ধৃতরাষ্ট্রঃ উবাচ (ধৃতরাষ্ট্র বললেন) –

‘‘ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ৷

মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়৷৷’’

এটা হচ্ছে গীতার প্রথম শ্লোক৷ এ সম্বন্ধে আগেও বলেছি, আজ কেবল মুখবন্ধটুকু বলছি৷ বইটার নাম ‘গীতা’৷ ‘গৈ’ ধাতুর উত্তর ‘ক্ত’ প্রত্যয়, স্ত্রিয়াং ‘ঙীপ্’ করে ‘গীতা’৷ ‘গৈ’ ধাতুর মানে গান গাওয়া ব্ধপ্স ব্দনুন্ধগ্গ৷ ‘গীতা’ মানে যা গাওয়া হয়েছে৷ এটা ভাববাচ্য৷ ভাববাচ্যে কী যেন একটা অস্পষ্ট থেকে যায়, তাই এটাকে স্পষ্ট করা দরকার৷ গাওয়া হয়েছে৷ কে গেয়েছে? – না, ‘যা ভগবতা গীতা সা গীতা’ অর্থাৎ ভগবান যা গেয়েছেন৷ এক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ যা গেয়েছেন তা–ই গীতা৷ ‘ভগবতা’ মানে ‘কৃষ্ণেন’, কৃষ্ণের দ্বারা৷ মুখক্ষন্ধে এটাও বলতে হবে, কৃষ্ণ কে?

‘কৃষ্ণ’ শব্দের তিনটে ব্যাখ্যা আছে৷ ‘কৃষ্’ ধাতু থেকে ‘কৃষ্ণ’ শব্দ এসেছে৷ ‘কৃষ্’ ধাতুর একটা মানে হচ্ছে আকর্ষণ করা, সবাইকে টেনে নেওয়া৷ কৃষ্  ন প্রত্যয় করে ‘কৃষ্ণ’ শব্দ নিষ্পন্ন হয় অর্থাৎ যে সত্তা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুকে নিজের দিকে টানছে, আকর্ষণ করছে, বলছে – ‘‘আয়, আয়....আমার কাছে আয়....তোর ভাববার কিছু নেই....তুই আমার কাছে চলে আয়৷ আমি তোর আশ্রয়, আমি তোকে বিপদ থেকে বাঁচাব৷ তোর ঘাবড়াবার কিছু নেই, ভয় পাবার কিছু নেই, আমি তো রয়েছি’’৷ এই কথাটা যিনি বলছেন, সবাইকে নিজের দিকে টেনে আনছেন, তিনিই কৃষ্ণ৷ মন চাইছে কৃষ্ণের দিকে যাব না, তবু মন ছুটে ছুটে সেই দিকে যাচ্ছে৷

বৈষ্ণব কবি বলছেন ঃ ‘‘উচাটন মন না মানে বারণ, শুধু তারই পানে ছুটে যায়’’৷ ভাবছি যাব না, কৃষ্ণের দিকে তাকাব না, তবু কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ তাহলে ‘কৃষ্ণ’ শব্দের মানে হ’ল the supreme attractive faculty.

‘কৃষ্ণ’ মানে আবার কালো রঙও হয়৷ কালো রঙ মানুষের মনকে সব থেকে বেশী আকর্ষণ করে৷ যত রঙ আছে তার মধ্যে কালোর দিকে আগে চোখ পড়ে৷ এই জন্যে কালো রঙকে কৃষ্ণ বর্ণ বলা হয়৷ এক্ষেত্রে এই কথাটা মনে রাখা দরকার যে দ্বাপর যুগে যিনি কৃষ্ণ ছিলেন তিনি কিন্তু কালো ছিলেন না৷

‘কৃষ্ণ’ শব্দের তৃতীয় অর্থ হচ্ছে ‘কৃষি ভূঃ’ বা ‘কৃষিভূঃ’৷ ‘কৃষ্’ ধাতুর মানে হ’ল ‘আমি আছি’ এই ক্ষোধ৷ তোমাদের সকলের মধ্যে ‘আমি আছি’ – এই রকম একটা ক্ষোধ আছে না? ‘‘ম্যায় হুঁ’’, ‘অহং অস্মি’ ‘ঢ ন্দ্বপ্রন্ব্দব্ধ’ – প্রতিটি মানুষের মধ্যে ‘আমি আছি’ – এই ক্ষোধ রয়েছে৷ সেই ‘আমি আছি’–ক্ষোধটায় ধাক্কা লাগলে মানুষ বিরক্ত হয়, চিন্তিত হয়, ক্রুদ্ধ হয়, ভীত–সন্ত্রস্ত হয়৷ এখন এই যে ‘আমি আছি’ ক্ষোধ, এটা ‘কৃষ্’ ধাতু থেকে আসছে৷ আর ‘ভূ’ ধাতুর মানে হ’ল হওয়া, থাকা৷ ‘কৃষ্ণ’ শব্দের মানে হ’ল যিনি আছেন বলে আমি আছি৷ তিনি অর্থাৎ কৃষ্ণ আছেন বলেই জগৎ আছে, জীব আছে৷ কৃষ্ণের যদি অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে জীবের, জগতের অস্তিত্বও থাকত না৷

কৃষ্ণ হলেন পরমপুরুষ৷ পরমপুরুষ না থাকলে জীবেরও অস্তিত্ব থাকত না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও থাকত না৷ তিনি আছেন বলেই জগৎও আছে৷ তাই তাঁকে ‘কৃষ্ণ’ বলা হচ্ছে৷ আমার অস্তিত্ব তাঁর অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল৷ যেমন, ক্ষাঙলা দেশ আছে বলেই না কলকাতা আছে, কলকাতার অস্তিত্ব ক্ষাঙলার অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল৷ সুতরাং সে বিচারে ক্ষাঙলা হ’ল কলকাতার কৃষ্ণ অর্থাৎ ক্ষাঙলা আছে বলেই কলকাতা আছে৷ আবার ভারত আছে বলেই না ক্ষাঙলা আছে৷ ভারত হ’ল ক্ষাঙলার কাছে কৃষ্ণ৷ আবার এশিয়া আছে বলেই না ভারত আছে, তাই এশিয়া হ’ল ভারতের কাছে কৃষ্ণ৷ আর এই পৃথিবীটা আছে বলেই না এশিয়া আছে, তাই পৃথিবীটা হ’ল এশিয়ার কাছে কৃষ্ণ৷ আবার এই যে সৌরমণ্ডল – সূর্য আর গ্রহ–উপগ্রহ নিয়েই এই সৌরমণ্ডল, ব্দপ্সপ্ত্ত্রব্জ ব্দম্ভব্দব্ধন্দ্বপ্প – এটা আছে বলেই না আমাদের এই ক্ষুদ্র পৃথিবীটা আছে৷ তাই সৌরমণ্ডল হ’ল এই পৃথিবীর কাছে কৃষ্ণ৷ আর পরমপুরুষ আছেন বলেই না এই সৌরমণ্ডল–গ্রহ–ন এই সমস্তই রয়েছে৷ সুতরাং পরম পুরুষ হলেন গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কাছে কৃষ্ণ৷ এটা হ’ল কৃষ্ণের তৃতীয় মানে৷ ‘কৃষিভূঃ’ – ‘কৃষ্’ ধাতুর অস্তিত্বের দরুণ ‘ভূ’ ধাতুর অস্তিত্ব অর্থাৎ অস্তিত্বের দরুণ অস্তিত্ব৷

আবার আজ থেকে প্রায় ৩৫০০ বছর আগে দ্বাপর যুগে এক বিরাট পুরুষের জন্ম হয়েছিল মথুরায়৷ তাঁর ক্ষাক্ষার নাম ছিল বসুদেব৷ বসুদেবের ছেলে – এই জন্যে তাঁর একটা নাম হ’ল বাসুদেব৷ তাঁর এক কাকার নাম ছিল নন্দ যিনি গো পালন করতেন, আর তাঁর পিতা বসুদেব ছিলেন জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট৷ মথুরা জেলের জেল–সুপারিন্টেন্ডেন্ট৷ তাঁর এক জ্যাঠামশাই – জ্যেষ্ঠতাত ছিলেন মহর্ষি গর্গ৷ শিশুর যখন জন্ম হ’ল, মহর্ষি গর্গ শিশুর নানান লক্ষণ দেখে গুণাবলীর পর্যালোচনা করে তার নাম রাখলেন ‘কৃষ্ণ’৷ আমাদের আলোচ্য কৃষ্ণ অর্থাৎ গীতার কৃষ্ণ হলেন সেই দ্বাপর যুগের কৃষ্ণ৷

আমি পাশাপাশি এই তিন জনকেই নিয়ে যাব, নিয়ে গিয়ে তারপর একটা পয়েন্টে কয়েনসাইড করিয়ে দেখাব তিন কৃষ্ণই এক৷ তোমরা জান, নরোত্তম দাস ঠাকুর কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শত নাম লিখেছিলেন৷ তিনি এক জায়গায় লিখেছিলেন ঃ

‘‘অনন্ত রাখিল নাম অন্ত না পাইয়া৷ 

            কৃষ্ণ নাম রাখেন গর্গ ধ্যানেতে জানিয়া৷’’