কশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল প্রসঙ্গে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

গত ৫ই আগষ্ট কেন্দ্রীয় সরকার কশ্মীরে ৩৭০ ধারা  ও ৩৫এ ধারা বাতিল করার পর এ নিয়ে  সারা দেশজুড়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তো এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারতের বিরুদ্ধে তোপ দেগে চলেছেন৷ ভারতের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসংঘ, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে এ নিয়ে অভিযোগও করা হয়েছে৷ কিন্তু তাঁরা পাকিস্তানের কথায় কান  দেয়নি৷

কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিভিন্ন নীতি নিয়ে আমাদের মতভেদ  থাকলেও  কশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রযোজনকে অস্বীকার করা যায় না৷ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েও পৃথক সংবিধান পৃথক আইন, পৃথক পতাকা---কেন থাকবে?  একে কেন্দ্র করেই পাকিস্তান কশ্মীরের জঙ্গীদের মদত দান করে  এখানে দিনের পর দিন অশান্তি পাকিয়ে তুলছিল৷

কশ্মীরের ভারতের অন্তর্ভুক্তি প্রশ্ণাতীত৷ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ব্রিটিশ সরকার করদ রাজ্য জন্মু-কশ্মীরের রাজা হরি সিং-কে শর্ত দেয়---হয় তাঁরা ভারতের সঙ্গে, নয় পাকিস্তানের  সঙ্গে যোগদান করুক৷ রাজা হরি সিং-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই পাকিস্তান কশ্মীরের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে অর্থনৈতিক  অবরোধ সৃষ্টি করে৷ কাঠ ও উৎপাদন জাত প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ ও বাণিজ্য বন্ধ  করে দেয়৷  তখন হরি সিং  ভারতের  কাছে  নুন ও কেরোসিন তেল সরবরাহের আবেদন জানায়৷

তারপর হঠাৎ ১৯৪৭ সালের ২২শে অক্টোবর পাঠান হানাদের দিয়ে কশ্মীর আক্রমণ করে ও কশ্মীরের একাংশ দখল করে নেয়৷ তখন হরি সিং ভারতের দ্বারস্থ হন৷ ভারত তখন প্রথম শর্ত দেয়, কশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, তবে তাদের  ভারত সাহায্য করতে পারে৷ ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে রাজা হরি সিং জম্মু-কশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসেবে মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন৷

এরপর কশ্মীর যে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ---এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না৷ তাই এই সময় ভারতের উচিত ছিল পাকিস্তান কর্তৃক দখলীকৃত কশ্মীর অংশও পুনরুদ্ধার করা৷ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  ও সেনাবাহিনী তার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু তাঁর দুর্বল নীতির জন্যে সেই যুদ্ধ-প্রস্তুতিতে জল ঢেলে দেন৷ ফলে কশ্মীরের স্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করা হয়৷

 আর ১৯৫০ সালে সংবিধান প্রণয়ণের সময় ৩৭০ ধারায় ভারতের অংশে থাকা জম্মু-কশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হলেও সেই মর্যাদা স্থায়ী ছিল না৷ সংবিধানেই বলা হয়েছিল, এটা অস্থায়ী ব্যবস্থা৷ ৩৭০ ধারার অন্তর্ভুক্ত ৩নং উপধারায় উল্লেখ আছে রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলে এই বিশেষ মর্যাদা তুলে নিতে পারেন৷ ৩৫-এ ধারার ক্ষেত্রেও তাই৷ ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু-কশ্মীরের প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ ও যোগাযোগ ছাড়া সেখানকার কোনো বিষয়ে কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করতে পারবে না৷ একই রাষ্ট্রের মধ্যে অস্থায়ী ব্যবস্থাকে তো চিরকাল রাখা যায় না৷ তাহলে তো এটি বিদেশী শক্তির ক্রীড়নক হয়ে  উঠবে৷ হয়ে উঠেছিলও তাই৷ ৩৫-এ ধারাতে জম্মু-কশ্মীরের বাসিন্দাদের বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছিল৷ শুধু  তাই নয়, এই ধারা অনুসারে জম্মু কশ্মীরের বিধানসভা স্থির করতে পারে রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা কারা৷ এই ধারার বলে কশ্মীরের বৌদ্ধ ও হিন্দুপণ্ডিতদের ওপর ও স্থানীয় উপজাতিদের ওপর অত্যাচার চলেছে৷

৩৫-এ ধারাতে আরও বলা হয়েছে,,রাজ্যের বাসিন্দা কোনও মহিলা রাজ্যের বাইরে বিয়ে করলে সম্পত্তির  অধিকার  থেকে বঞ্চিত হবেন৷  তাঁর উত্তরাধিকারীদেরও সম্পত্তির ওপর অধিকার থাকবে না৷ স্পষ্টতঃ এই  ধারা মানবাধিকার বিরোধী৷

তাই ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ ধারা বাতিল যথার্থই হয়েছে৷ ভারতের নিরাপত্তা, শান্তি ও বিভিন্ন ধর্মমত নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের উন্নয়ণের জন্যে  এটা বিশেষ প্রয়োজন ছিল৷

তবে বিজেি সরকারকেও ধর্মমতের গোঁড়ামী থেকে বেরিয়ে এসে কশ্মীরের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের উন্নয়নে আন্তরিক হতে হবে ও ভারতের মূল স্রোতে কশ্মীরকে  মিশিয়ে নেওয়া যে সকলের উন্নয়নের জন্যে অত্যাবশ্যক সমস্ত রাজ্যবাসীর মনে এই বিশ্বাস জাগাতে হবে৷