কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়

লেখক
প্রভাত খাঁ

এমন অনেক মহাপুরুষ এই মাটির পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁদের কীর্ত্তি অতুলনীয়৷ তেমনি একজন হলেন রাজা রামমোহন রায়৷ তিনি ১০ই মে ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে হুগলী জেলার খানাকুলের রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ আর মৃত্যুবরণ করেন ইংলণ্ডের ব্রিস্টলে ২৭শে সেপ্ঢেম্বর ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে৷ তিনি শিৰাবিদ ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন৷ তিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ভারতপথিক’ সম্মানে ভূষিত করেন৷ তিনি বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন৷ ভারতের বুক থেকে জঘন্য ও নির্মম নারকীয় নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথা রদে একাই তীব্র লড়াই করে গেছেন৷ তাঁর সহায়তায় বড়লাট বেণ্টিঙ্ক ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর আইন করে এই প্রথা রদ করে দেন৷ রামমোহন রায় ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে রংপুরে যখন কর্মরত ছিলেন তখন তাঁর বড়ভাই জগমোহন রায় মারা যান৷ তাঁর মৃত্যুতে তাঁর পত্নী অলোকমঞ্জরী দেবীকে সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যষ্টিদের প্ররোচনায় তাঁর পরিবার সহমরণে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করেন৷ তাঁর পরিবারের কেউই এই নিষ্ঠুর কাজে বাধাদান করেননি৷ রামমোহন রায় এই মর্মান্তিক নিষ্ঠুর সংবাদে মর্মাহত হন৷ তিনি তাঁর কলম ধরেন সমাজের এই নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর প্রথার বিরুদ্ধে৷ এতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্বার্থপর নিষ্ঠুর পুরোহিতগণ ও সমাজপতিরা রামমোহনের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে ও নানাভাবে কুৎসিৎ ভাষার তাঁর বিরোধিতা করতে থাকেন৷ কিন্তু সমাজের শিক্ষিত চিন্তাশীল ব্যষ্টিরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন৷ অলোকমঞ্জরী দেবীর বয়স যখন মাত্র ৪০, তখন ১২১৬ সালের ২৭শে চৈত্র ইংরেজী ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই এপ্রিল রবিবার সহমরণ অনুষ্ঠিত হয়৷ তখন  কিছু কিছু ইংরেজী শিৰায় শিক্ষিত ও সংস্কারমুক্ত যুক্তিবাদী ব্যষ্টি কেবল রামমোহনের সঙ্গে ছিলেন৷ রামমোহন রায়ের মাতুলালয় ছিল শ্রীরামপুরে৷ শ্রীরামপুর তখন বিখ্যাত খ্রীষ্টান মিশনারীদের কর্মস্থল ছিল৷ পঞ্চানন কর্মকার খ্রীষ্টানদের সহায়তায় প্রিণ্টিং প্রেসের কর্মে ব্যবহৃত বিভিন্ন ভাষার হরফ (অক্ষর) তৈরী করে মুদ্রয়ণ শিল্পকে উন্নত করেন৷ রামমোহন রায় বিরোধীদের উপযুক্ত জবাব দিতে তাঁর অকাট্য যুক্তিকে উপস্থাপন করেন সতীদাহের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বই ও প্রবন্ধের মাধ্যমে৷ তখন বিরোধীরা ছড়া বেধে রামমোহনের বিরুদ্ধে লোক ক্ষেপিয়ে বেড়াত---‘‘ব্যাটা সর্বনাশের মূল, বাড়ী খানাকুল, ওঁং তৎসৎ বলে ব্যাটা বানিয়েছে ইসুকল৷’’ রাজা রামমোহন সংবাদ কৌমুদিতে কলকাতার এক নির্মম সতীদাহের ঘটনা লেখেন৷ একজন সতী অর্ধদগ্দ অবস্থায় প্রাণে বাঁচতে চিতা থেকে পালিয়ে যান৷ তার আত্মীয়রা তাকে জোর করে ধরে এনে আবার চিতায় নিয়ে মারতে উদ্যোগী হন৷ তখন কয়েকজন ইয়ূরোপীয় তাকে উদ্ধার করেন ও প্রাণ রৰা করেন৷ তিনি (রামমোহন রায়) তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করেন তাঁর লেখায়৷ প্রথম সহমরণ আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না৷ সহমৃতা না হলে যে পাপ হবে এমন কথা কোনও শাস্ত্রে লেখা নেই, দ্বিতীয়তঃ বিধবাদের পক্ষে সহমরণের চেয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করাই শ্রেয়৷ তৃতীয়তঃ স্বেচ্ছায় কেউ সহমরণে যায় না, জোর করে বলপ্রয়োগ করে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে তাদের হত্যা করা হচ্ছে৷ সুতরাং এটা অধর্ম৷ এই প্রথা তুলে দেওয়াটাই কর্তব্য৷ লর্ড বেণ্টিঙ্ক রাজা রামমোহনের সঙ্গে সাৰাতে অনেক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন সতীদাহ প্রথা রদ্ করতে৷ একাজে রামমোহনের এক ইংরেজ বন্ধু অ্যাডাম ইংল্যাণ্ডে এক বত্তৃণতায় সতীদাহের বিরুদ্ধে অকাট্য যুক্তি দেখান৷ বন্ধু অ্যাডাম সাহেব বলেন---‘‘প্রতি বছর পাঁচ ছয় শত রমনীকে সরকারী লোকজনের সামনে দিবালোকে হত্যা করা হ’ত৷’’ ধীরে ধীরে পৃথিবীতে বিশ্বজনমত গড়ে ওঠে সতীদাহের বিরুদ্ধে৷ মাননীয় জে.পেগম নামে একজন লেখক ও ফ্যানি পাক্স নামে একজন ইয়ূরোপিয়ান মহিলা সতীদাহের মত নিষ্ঠুর প্রথার ওপর বই লেখেন৷

আজ বিজ্ঞানের উন্নতিতে প্রচার যন্ত্র শক্তিশালী ও জনগণও সচেতন৷ অনেকেই কুসংস্কার মুক্ত৷ সেদিন সুশিৰার হার কম ছিল৷ শিক্ষিতের সংখ্যাও কম৷ কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকের সংখ্যা বেশী ছিল৷ গ্রামের মোড়ল, জমিদার, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের স্বেচ্ছাচারিতা ছিল ভয়ঙ্কর৷ সমাজের মানুষ বিরোধিতা করতে পারত না৷ রাজা রামমোহন ছিলেন সংস্কারমুক্ত মানুষ৷ তিনি অত্যন্ত যুক্তিবাদী মহাপুরুষ ছিলেন৷ তিনি সত্যের জন্যে লড়াই করেছেন চিরজীবন৷ তিনি নিজের জননীর বিরুদ্ধে মামলা করেন পৈত্রিক সম্পত্তির ন্যায্য অধিকারের জন্যে৷ মামলায় জয়লাভ করে তিনি তাঁর সম্পত্তির অংশ মাকে প্রত্যর্পণ করে জানিয়ে দেন যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সদাজাগ্রত ও সংগ্রামী৷ সম্পত্তি লাভ করাটা বড় কথা নয়৷ তিনি অন্যায় ও বঞ্চনার বিরুদ্ধেই চিরপ্রতিবাদী৷ তিনি ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে ৭ই এপ্রিল জাহাজে চড়ে ইংলণ্ডে পৌঁছান৷ সেখানে তিনি প্রিভি কাউন্সিলে অ্যাটর্নি ব্যথিকে পরাজিত করেন ও সতীদাহ প্রথা রদকে আইনসম্মত করেন অকাট্য যুক্তি দিযে৷ অ্যাটর্নি ব্যথি ছিলেন হিন্দু কুসংস্কারপন্থীদের উকিল৷ রাজা রামমোহন রায় দেশের ইংরেজী শিৰায় শিক্ষিত যুবকদের খ্রীষ্টান হওয়া থেকে রৰা করতেই মূলতঃ একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম সমাজের প্রবর্ত্তন করেন৷ কারণ ইংরেজ শাসক ও ইংরেজ পাদ্রীরা এদেশে রাজধর্মের প্রলোভন দেখিয়ে এদেশের তরুণ-তরুণীদের ধর্মান্তরিত করে অত্যন্ত ক্ষতি করেছিল৷ সেই ব্রাহ্ম সমাজ ভারতের হিন্দু সমাজকে ধবংসের হাত থেকে রৰা করে৷ রাজা রামমোহন আধুনিক যুগে একজন প্রকৃত ধর্মবেত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন৷ মানব সমাজে কোনও ভেদাভেদ নাই৷ ইনি ছিলেন মানবতার পূজারী এক মহামানব৷ তাই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ভারতপথিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন৷

প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে যুগ যুগ ধরে তিনি বিরাজ করুন এই ধরামাঝে৷ রামমোহনের স্মরণীয় কাজ হ’ল  (১) সতীদাহ প্রথা রদ করার জন্যে তাঁর অবিস্মরণীয় সংগ্রাম, (২) ইংরেজী শিৰা প্রচলনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, (৩) নারী শিৰাকে অগ্রাধিকার, (৪) একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা, (৫) জনহিতকর কর্ম ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গণচেতনার জাগরণে লেখনি ধারণ, (৬) গদ্য বাঙলা সাহিত্যকে প্রাণ দান (উন্নত) করা ইত্যাদি৷