খন্ খন্ ঝন্ ঝন্

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

গম্ভীর শব্দের অর্থ হল জলের তলমাপক ভাব অর্থাৎ জলকে গম্ভীর বললে বুঝতে হবে সেটা অর্থই জল.... অনেকতলা পর্যন্ত সেই জল গেছে৷ যদিও শব্দটি আদিতে  জলপরিমাপক  হিসেবেই ব্যবহৃত হত কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরণের  অলঙ্কারে বিভিন্ন বস্তুর  তলমাপকতায় এর ব্যবহার হয়ে এসেছে৷ ভারী আবাজ, ভারী মনমেজাজ, ভারী চলন-বলন,  যার মধ্যে অনেক নীচ অবধি বা অনেক ভিতর পর্যন্ত মাপবার  প্রশ্ণ ওঠে তার জন্যে ‘গম্ভীর আবাজ হাসিবিহীন মুখকে লব গম্ভীর চলন৷ তবে মনে  রাখতে হবে মুখ্যতঃ এটি জলেরই  তলত্ব বা অতলত্বের  পরিমাপ৷

‘গম্ভীর’ শব্দের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল একটি কম বয়সের ঘটনার কথা৷ আমার জানা  এক ভদ্রলোকের স্ত্রী ছিলেন দারুণ দজ্জাল, উঠতে বসতে স্বামীকে খোঁটা দিয়ে কথা বলতেন৷ বচনের  ঝালে  তিনি অন্নপ্রাশনের  ভাতকেও  বমি করে বার করে দিতে লোককে বাধ্য করতেন৷ কিন্তু গোবেচারা*

(এখানে বেচারা মানে সাদাসিধে মানুষ..... সাত চড়েও যিনি রা-টি কাড়েন না৷ গোরু একটি শান্তশিষ্ট প্রাণী, মোষের মত)

একদিন ভোরে পশ্চিম দিকের পাহাড়টার দিকে বেড়াতে যাচ্ছি৷ দেখি, রাস্তার ধারে বটতলায় বসে রয়েছেন  সৌরেন সরকার ৷ ভদ্রলোক আমার বাবার চেয়ে বয়সে এক বছরের বড় ছিলেন৷ তাই তাঁকে জ্যাঠামশায় বলতুম৷ তাঁকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে শুধোলুম--- কী জ্যাঠামশাই! এখন  এখানে  এভাবে বসে আছেন!

হ্যাঁ,প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে থালা বাসন-পত্র যদি সেই বাড়ীর কাছ দিয়ে তীব্রগতিতে ছুটে আসা রেলগাড়ীর শব্দে থালা-বাসনপত্রের দেওয়ালের গা ছেড়ে যখন  মাটিতে পড়ে যায় তখন একটা খন্ খন্ ঝনাৎ শব্দ নিশ্চয়ই শুণেছ৷ আবাজ কেমন বোঝাতে গিয়ে লোকে বলে খন্খন্ ঝন্-ঝন্ আবাজ ৷ এ আবাজ  কেবল বাসনেরই হয়, মানুষ বা অন্য জীবের হয় না৷ তবুও এ আবাজটি অনেক সময় মুখর বা মুখরা মানুষের অভিব্যাক্তি বোঝানোর সময় ব্যবহৃত হয়৷

(মেজাজী নয়, হরিণের মত ছটপটেও নয়, বেস শান্তশিষ্ট স্বভাবের৷ যে বেচারী মানুষটি একেবারে গোরুর মত শান্তশিষ্ট তিনি হলেন গোবেচারী৷ গোরুকে বেশী মারলেও সে শিঙ নেড়ে তেড়ে আসে না৷   মার সয়েই যায়--- বেশী মারে শিঙ নেড়ে তেড়ে আসে না৷ মার সয়েই যায়--- বেশী মারে  ক্কচিৎ কখনও কাঁদে৷  তাই কাউকে যদি গোরুকে মারার মত মারা হয় ও সে মার খেয়ে মরে যায়, সে ধরণের মারকে বলা হয় ‘গোবেড়ান’--- কলকাতার কথ্য বাংলায় ‘গোবেড়েন’৷ )

আমি সরকার জ্যাঠামশাইকে জিজ্ঞেস করলুম--- তা অত ভোরে এই বটতলায় বসে থাকার কারণটা কী?  তিনি বললেন--- বাবা, সবই তো জানো, বাড়িতে চব্বিশ ঘন্টা খন্ খন্ ঝন্-ঝন্৷ তা তোমার  জেঠীমার ভয়ে একটু গাছতলায় বসে শান্তি পাচ্ছি৷ খানিক বাদে  আবার বাড়ী ফিরতে হবে, তারপর অফিস যেতে হবে, তবু আর দশটা মিনিট বসে থাকি.....যতটুকু  সময় খন্ খন্, ঝন্-ঝনের  হাত থেকে  দূরে থাকা যায়৷

 তাহলে বুঝলে এই গম্ভীর শব্দ যদিও জলের পরিমাপের জন্যে প্রাচীনকালে ব্যবহৃত  হত কিন্তু আজ গম্ভীর  স্বভাবের  মানুষ, গম্ভীর চালচলন, গম্ভীর  চরণ-চারণা, গম্ভীর ধবনিবিন্যাস প্রভৃতি নানানভাবে নানান ব্যঞ্জনার বহ্বাম্ফোটে তরঙ্গের উত্তরণে সত্যিই মুড়ি-মুড়কির মতই ছড়িয়ে পড়েছে৷ শব্দটি তার সাবেকি গাম্ভীর্য আজ হারিয়ে ফেলেছে৷ (শঃচঃ ২০৷১৮)