মানব জীবনে বিজ্ঞান ও ধর্ম

লেখক
 সৌমিত্র পাল

পূর্ব প্রকাশিতের পর

মনকে বিস্তৃত করবার পদ্ধতি Process of Extension of  Human Mind) ঃ- মানবদেহ  যেমন পাঞ্চভৌতিক উপাদানে (ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ ব্যোম) সৃষ্ট, তেমনি মানবমনও পঞ্চকোষের  সমাহারে  গঠিত৷ মনের  পাঁচটি  কোষ হল যথাক্রমে ঃ

১. কামময় কোষ

২.মনোময় কোষ

৩. অতিমানস কোষ

৪.বিজ্ঞানময় কোষ

৫. হিরন্ময় কোষ

কলাফুলের  পাঁপড়িগুলি যেমন বিভিন্ন স্তরে  (বাইরের থেকে ভেতরের দিকে) বিন্যস্ত থাকে,

তেমনি মানব মনের কোষগুলিও স্থূল থেকে  সুক্ষ্মস্তরে পর্যায়ক্রমে বিন্যস্ত৷ ধর্মসাধনার আটটি বিশেষ পর্র্যয়ে মানব মনের wave length ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে৷ ফলে মন তার স্থূল আস্তরনগুলিকে  ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করে এগিয়ে চলে  সুক্ষ্মত্বের পানে৷ বাড়তে থাকে মনের ক্ষমতা ও  গভীরতা মনের এই ধর্ম তথা স্বভাবকে বলে মনের অন্তর্মুখীনতা৷ মন তার শেষ কৌষিক আস্তরন হীরন্ময়-তে পৌঁছলে সে নিষ্কলুষ চৈতন্যের উজ্বল দ্যুতিকে দর্শন করতে পারে৷  এটা যেন ঠিক কোন মানুষের ভ্রমনপথ পেরিয়ে লক্ষ্যস্থল সমুদ্রের উপকূলে এসে পৌঁছানো৷ যেখানে সে সুবিশাল সমুদ্রের অপরূপ শোভা দর্শন করতে পারবে৷

এই মনোরম দৃশ্য আকর্ষণ করবে তার মনকে বারংবার৷ এই আকর্ষন যখন মনে তীব্র হবে, তখন সে  ঐ বিপুল বিশাল জলরাশির মধ্যে নেমে পড়বে৷ ঠিক তেমনি হীরন্ময়ে মন উপনীত হলে চৈতন্যের দ্যুতি ক্রমাম্বয়ে আকর্ষন করবে তার মনকে (অনুমনকে)৷ এই স্তরে মানব মনে  খুব সামান্য তরঙ্গ কাজ করে৷ মানুষ এই স্তরেও কিন্তু উপলদ্ধি করে দুটো মনের অস্তিত্বকে --- একটা তার নিজের মন (অনুমন) অপরটি অসীম চৈতন্যের  মন (ভূমামন) তাই হীরন্ময় কোষের আস্তরনটাকে বলা যেতে পারে চৈতন্যকে পাবার দ্বার পথ৷ এইটুকু আস্তরনটাকে পেরিয়ে গেলেই অনুমন ভূমামনে সমাহিত হয়ে একটাই মন (অসীম চৈতন্য) হয়ে যায়৷ লবনের পুতুল সাগরের লবন জলে সমাহিত হলে লবনের পুতুলের কী আর  নিজস্ব অস্তিত্ব Individual existence) থাকবে? সে তো তখন সাগরই হয়ে যাবে৷ তাই  মানব মন (অনুমন) ভূমাচৈতন্যে সমাহিত হয়ে গেলে অনুমন ভূমাচৈতন্যে হারিয়ে এক হয়ে যায়৷ অনুমনের এই অবস্থায়Wave length সম্পূর্ণ  বিস্তৃত হয়ে পরিশেষে তা Infinite বা অসীমই  হয়ে যায় এটাই মনের চরম বিস্তৃতি বা বিকাশ Complete extension of Mind)৷ মন এই অবস্থায় শোক, তাপ , উল্লাস, জরা, বিকার, ব্যাধিহীন এক চির আনন্দঘন অবস্থা বিরাজ করে৷

এবার ধর্মসাধনার আটটি পর্র্যয় বা অষ্টাঙ্গিক অনুশীলনের মাধ্যমে মানব দেহ-মনের বিকাশ কীভাবে হয় তা আলোচনা করব৷

(১) কামময় কোষ বা স্থূলমন Crude Mind)ঃ এটা মনের মধ্যে একেবারে বাইরের আস্তরন 1st Layer)৷ মনের এই স্তরেই স্থূল (জাগতিক) বাসনার জন্ম হয়৷ বাইরের জগতের রূপ-রং-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ প্রভৃতি  অনুভূতি কামময় কোষকে সর্বদা আকর্ষন করে৷ তখন দেহস্থ কামবৃত্তি (আকাঙ্খা)-র প্রভাবে কামময় কোষে বাসনা জাগ্রত হয়৷ বাসনা নানান হতে পারে যেমন যশ-প্রতিষ্ঠা-অর্থ ক্ষমতা-যৌবন প্রভৃতি পাবার বাসনা৷ একজন মা যেমন নানান রঙিন খেলনা দিয়ে তার শিশুকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে, তেমনি প্রভৃতি মাতাও নানান রঙিন বিস্তার করে মানব মনকে (কামময় কোষকে) আকৃষ্ট করে চলেছে৷ কামময় কোষ ও তখন তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেহস্থ ইন্দ্রিয় সমূহকে জাগতিক ভোগ্য বাসনার দিকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়৷ এতে ক্ষনিক সুখ এলে ও মন থাকে সদা অশান্ত-অস্থির৷ বাসনার চোরাবালিতে মন   ক্রমশঃ  তলিয়ে যেতে থাকে কামময় কোষেরFunction  বোঝাতে গিয়ে বৈদিক ঋষিরা একটি সুন্দর উপমা ব্যবহার করেছেন৷   

‘‘আত্মানাং রথিনাং বিদ্ধি শরীরং রথমেবতু

বুদ্ধিনতু সারথীং বিদ্ধি মনো: প্রগহমেবচ৷’’

অর্র্থৎ আমাদের এই সুন্দর দেহটাকে বলা হচ্ছে একটা রথ৷ এই রথের ,রথী ও , সারথী হলেন যথাক্রমে  আত্মা ও বুদ্ধি৷ আর রথের ঘোড়া হল-ইন্দ্রিয়৷ আর লাগাম হল-মন (কামময় কোষ)৷ এখন বুদ্ধিরূপী সারথী মনরূপী লাগামকে (কামময় কোষ) কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তবে রথের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী৷ যে কামময় কোষ লাগামের মতো দশ ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করছে তাকে নিয়ন্ত্রন করা চাই৷  চাই কামময় কোষের সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ--- অন্যথায় স্থূল  বাসনার চোরাস্রোতে  জীবন তলিয়ে যাবে, মনে অস্থিরতা অশান্তির দাবানল জ্বলতে থাকবে৷ ‘‘যম নিয়ম’’ অভ্যাস যোগের মাধ্যমে মনের  এই তার প্রাথমিক আস্তরণকে তথা  কামময় কোষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷     (ক্রমশঃ)