মদ্যপান নিষিদ্ধ হোক

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

গত ১৭ই সেপ্ঢেম্বর কলকাতায় দিন দুপুরে রামলীলা ময়দান থেকে এক অভিনব মিছিল বেরোয়৷ মিছিলের সামনে ছিল ঝাঁটা হাতে কয়েকশ’ মহিলা৷ মিছিলটি নবান্ন পর্যন্ত যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল৷ কিন্তু এস.এন.ব্যানার্জী রোড ধরে এগিয়ে ডোরিনা ক্রসিংয়ের কাছে পুলিশ মিছিলটিকে আটকে দেয়৷ এরপর মিছিলকারীরা এখানে প্রায় আধঘন্টা করে ধর্র্ণয় বসে৷ ‘ওয়েল ফেয়ার  পার্টি অব ইণ্ডিয়া’-র উদ্যোগে আয়োজিত এই মিছিলে বিভিন্ন স্থানের, বিশেষ করে, ভুক্তভোগী মহিলারা যোগ দিয়েছিলেন৷ তাঁদের দাবী, বিহার ও কেরলের মত পশ্চিমবাংলাতেও মদকে নিষিদ্ধ করতে হবে৷

 মিছিলে যোগদানকারী মহিলারা বলছেন, তাঁদের স্বামীরা রাতে পেট ভরে মদ খেয়ে এসে তাদের মারধোর করে, ছেলেমেয়েদের  ওপরও মারধোর করে৷ যা আয় করে তার অধিকাংশটাই মদ খেয়ে খরচ করে ফেলে৷ এদিকে বাড়ীতে অভাব, ছেলেমেয়েরা রোগে ওষুধ বা পণ্য পায় না৷ অনেক সময় স্বামীরা জুলুম করে বাড়ীর মেয়েদের কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে মদ কিনে খায়৷

তাছাড়া দিল্লীর গণধর্ষণ থেকে শুরু করে পার্কষ্ট্রীট বা কামদুনির ধর্ষণের ঘটনা সমস্ত ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অপরাধীরা মদ খেয়ে এই সব জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করে৷ কারণ মদ খেলে, মানুষ তাদের স্বাভাবিক সুস্থ বিচারবোধ হারিয়ে ফেলে, মানুষ বিবেকহীন বিচার বুদ্ধি হীন পশুতে পরিণত হয়ে যায় ৷ তখন সে অক্লেশেই নানান্ জঘন্য পশুসুলভ কাজ করতে দ্বিধা করে না৷

গ্রামাঞ্চলের বহু মানুষ যে টাকায় পুষ্টিকর খাদ্য কিনে খেতে পারত সেই অর্থ মদের পেছনে খরচ করে বাড়ীতে সপরিবারে অর্দ্ধাহারে অনাহারে থাকে৷ অনেকের পকেটে সামান্য  পয়সা এলে ঘরে বসে বসে মদ খেয়ে উড়িয়ে দেয়৷ পয়সা শেষ হলে আবার কাজে যায়৷

এইভাবে দেখা যায় মদের নেশা দেশবাসীকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাচ্ছে৷ শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার মানসিকতাও নষ্ট করে দিচ্ছে এই মদ্যপান৷ তাছাড়া, মদ নানান্ শারীরিক ও মানসিক রোগের গোড়া৷ মদ্যাসক্তির কারণেই অনেকে টিবি, ক্যানসার বা কঠিন লিভারের অসুখে ভোগে৷

এই সব দিক থেকে বিচার করে ভারতের অন্যান্য অনেক রাজ্যের মত এরাজ্যেও মদকে নিষিদ্ধ করা উচিত৷

 কেউ হয়তো বলবেন, নিষিদ্ধ করলেও কি মদ্যপান একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে ? তা হয়তো পুরোপুরি বন্ধ হবে না৷ প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আড়ালে আবডালে মদ্যপান কিছু না কিছু হয়তো চলতে থাকবে৷ কিন্তু সেক্ষেত্রে বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে মদ্যপান করে রাস্তায় মাতলামি করা ও ঘরে ফিরে ব্যাপকভাবে বাড়ীর মেয়েদের ওপর ও অন্যান্য মেয়েদের ওপর অত্যাচার করা অনেকটাই হ্রাস পাবে ৷ মদ নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির আশায় নূতন করে মদের দোকানকে লাইসেন্স দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছেন৷ এটা অত্যন্ত নিন্দনীয়৷ মানুষের সমাজকে ধবংসের পথে ঠেলে দিয়ে রাজ্যের আয় বাড়ানোর এই পরিকল্পনাকে আদৌ সমর্থন করা যায় না৷

দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণ বিধানই যে কোনো সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য৷ শুধু মদ কেন, সমস্ত মাদক দ্রব্যই নিষিদ্ধ করতে হবে৷ বর্তমানে মাদক দ্রব্য নিষিদ্ধ করণের যে আইন আছে, সে আইনকে কার্যকরী করে’ মাদকদ্রব্যকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে সরকারের আগ্রহের যথেষ্ট অভাব আছে৷ গুটকা, বিড়ি, সিগারেটসহ মদ, গাঁজা, আফিং--- এ সমস্ত মাদকদ্রব্য বর্তমানে মারণরোগ ক্যানসার ডেকে আনছে৷ এটা বিজ্ঞানীরা হাজার বার বলছেন৷ ধীরে ধীরে ক্যানসার রোগ মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে৷ এই রোগকে নির্মূল করতে গেলে সমস্ত মাদকদ্রব্যকে কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে৷ কিন্তু পুঁজিপতিরা তাদের ব্যবসার স্বার্থে এই ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখার সব চেষ্টাই করে চলেছে৷ সরকারও তাদের আয় বৃদ্ধির স্বার্থে এই মারণব্যবসাকে পরোক্ষে সমর্থন করে চলছেন৷ মুখে এসব মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে অনেক কথা বললেও কার্যতঃ নেতা-নেত্রীরা চান না যে, এগুলো পুরোপুরি উঠে যাক৷ এটাই সমস্যা৷

কারণ, কঠোর, সৎনীতিবাদী নেতা-নেত্রীর এখন অত্যন্ত অভাব৷ প্রায় সবাই আপন স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টাই করে চলেছেন৷ শাসকদল আবার পুঁজিপতিদের অর্থের ওপর একান্ত নির্ভরশীল৷ বিশেষ করে নির্বাচনী যুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে পুঁজিপতিদের দেওয়া কোটি কোটি টাকাই তাদের নির্বাচনে জেতার প্রধান হাতিয়ার৷ তাই সাধারণতঃ কোনো রাজনৈতিক দল প্রকৃতই পুঁজিপতিদের চটাতে চান না৷ কখনো কখনো বাইরে গরম গরম কথা বললেও ভেতরে ভেতরে গভীর সাঁট ও লেনদেন যে চলতেই থাকে, এটা কারুর অজানা নয়৷ তাই পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে তারা যান না৷ আর পুঁজিপতিরাও নিজেদের স্বার্থে সমাজের এই ব্যাধিগুলিকে সযত্নে পোষণ করে৷

 তাই এ ব্যাপারে সমাজের সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তেই হবে৷ সমাজে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এছাড়া কোনো উপায় নেই৷