মনে পড়ে

লেখক
পথিক বর

১৯৪৩ সাল ৪ঠা জুলাই, সিঙ্গাপুরের ক্যাথে বিল্ডিং৷ চারিদিকে লোকে লোকারণ্য৷ প্রেক্ষাগৃহে তিল ধারণের স্থান নেই৷ আনন্দ উচ্ছ্বল মুখগুলো অপেক্ষা করছে কোনও একজনের জন্যে৷ এত ভীড়, এত কষ্ট তবু মুখে কারো কোনও বিরক্তির ছাপ নেই৷ সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্যে৷

এমন সময় বাতাসে ভেসে এল সেই কণ্ঠ---‘বন্ধুগণ, টোকিও যাবার আগে বলেছিলাম, আপনাদের জন্যে আমি একটি ভাল উপহার নিয়ে আসব৷ আমার সেই উপহার আজ আমার পাশেই আছেন৷ (একজনকে ইঙ্গিতে দেখালেন) ভারতবর্ষ বা পৃথিবীর কোথাও তাঁর নতুন করে পরিচয় দেবার কিছু নেই৷ তাঁর পরিচয় তিনি নিজেই৷ শুধু সেনাবাহিনী নয়, সেই সঙ্গে ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগের সভাপতির দায়িত্ব আজ থেকে আমি তাঁর হাতে তুলে দিলাম৷ এখন থেকে তিনিই আমাদের নেতা৷ আমরা সবাই তাঁর আজ্ঞাবাহী সৈনিক মাত্র৷’

নিথর, নিশ্চুপ ভীড়ে ঠাসা প্রেক্ষাগৃহ৷ জীবন সর্বস্ব পন করেছেন দেশের জন্য৷ সারা জীবনের পরিশ্রমের ফল আজ হেলায় তুলে দিলেন আর একজনের হাতে৷ আজকের মত নেতৃত্বের লোভ তাঁর ছিল না৷ দেশ সেবার নামে লুটে খাওয়ার নেতাও তিনি ছিলেন না৷ সেদিনই বা তাঁর মত ক’জন ছিলেন, যিনি বলতে পারেন---‘দেশের জন্যে সর্বস্ব দিতে হবে, ফকির হতে হবে৷’ আজ আর কেউ ফকির হতে চান না৷ দেশসেবার নামে দেশকে ফকির করে নিজেরাই রাজা-উজির হয়ে বসেন৷ সেদিনও তো কত নেতা ছিলেন ক্ষমতার মোহে দেশপ্রেমের মুখোশে ঢাকা৷

তবুও ব্যতিক্রম তো থাকেই৷ তিনি সেই ব্যতিক্রমী নেতা৷ আজাদ হিন্দ ফৌজেরর সর্বাধিনায়ক---মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু৷ তিনিও একদিন ব্রিটিশের চোখে ধূলো দিয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করে জাপানে এসে উঠেছিলেন৷ তবে সুভাষের মত পথের কষ্ট তাঁকে পেতে হয়নি৷ বিপদসঙ্কুল পথ পেরিয়ে তাঁকে আসতে হয়নি৷ ব্রিটিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বৈধ নথিপত্র দেখিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় সেজে জাপান পাড়ি দিয়েছিলেন মাতৃভূমি ত্যাগ করে৷ এখানেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ, আজাদ হিন্দ ফৌজ৷ আজ তাঁর বয়স হয়েছে, শরীরও অসুস্থ৷ তাই অনেক পরিশ্রম, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে তিনি যে গড়ে তুলেছিলেন ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ ও আজাদ হিন্দ ফৌজ, আজ সেই ফৌজ তুলে দিলেন আর এক সর্বত্যাগী দেশ- নায়কের হাতে৷ সর্বত্যাগী সর্বাধিনায়কের উপযুক্ত উত্তরাধিকারী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে৷

বক্তা নীরব৷ আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কও নীরব৷ নীরব হল ভর্তি জনারণ্য৷ হঠাৎ হাজার কণ্ঠ গর্জে উঠল---নেতাজী সুভাষ জিন্দাবাদ, রাসবিহারী জিন্দাবাদ৷