মোদিজীর পুঁজিপতি প্রীতি!

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বর্তমানে ভারতে যখন চরম অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে, সে সময় এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্যে পুঁজিবাদের প্রধান একনিষ্ঠ-ভক্ত-প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের দ্বারস্থ হয়েছেন এই সংকট থেকে দেশের ১৩৫ কোটি মানুষকে উদ্ধারের প্রার্থনা নিয়ে । শুধু প্রার্থনাই নয়, তাঁদের  হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে---কয়লাখনি, বিমানবন্দর ও প্রতিরক্ষার জন্যে অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন---রাষ্ট্রের এই সব অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইয়ূনিট । এও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় সমস্ত সংস্থাগুলিতেই দেদার বেসরকারী পুঁজির আহ্বান করা হবে । যাতে করে এদের নিয়ন্ত্রণ ভার সম্পূর্ণ পুঁজিপতিদের হাতেই চলে যায় ।

প্রধানমন্ত্রী মোদির বক্তব্য, এতে পুঁজিপতিদের কৃপায় দেশের জনসাধারণের আর্থিক সংকট ঘুচবে । তাদের দারিদ্র ও বেকার সমস্যার সমাধান হবে । সরকারের দ্বারা এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, তাই পুঁজিপতিদের কাছে মোদিজীর আত্মসমর্পণ ।

ব্যষ্টিগতভাবে তিনি পুঁজিপতিদের কাছে আত্মসমর্পণ করুন, সেটা তাঁর ব্যষ্টিগত ব্যাপার । কিন্তু দেশের জাতীয় সম্পদগুলি যার মালিক দেশের জনসাধারণ সেগুলি দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার তাঁর কী অধিকার আছে?--- এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক প্রশ্ণ ।

পুঁজিপতিরা যে শিল্প কলকারখানা গড়ে তার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য  দেশের জনসাধারণের দারিদ্র্য দূরীকরণ নয় বা বেকার সমস্যার সমাধান নয় । তারা দেশে সমগ্র এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নও কখনও চায় না । তারা একমাত্র চায় মুনাফা, যত বেশি সম্ভব লাভ । তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে । তাদের লক্ষ্য থাকে যত দূর সম্ভব কম সংখ্যক মানুষকে কর্মে নিয়োগ করে বেশি  করে লাভ । তারা দেশের জনসাধারণের কল্যাণ দেখবে না, দেশেরও কল্যাণ দেখবে না ।

ইতিহাস সাক্ষী, ব্রিটিশ বণিকরা এদেশে ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে এসে কিভাবে সমগ্র দেশকে শোষণ করে ছিবড়ে করে দিয়েছিল । এখন আবার সেই বিদেশী পুঁজিপতিদেরই দেশের  গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সেকটরগুলির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে । আর ভারতীয় পুঁজিপতিদের শোষণের প্রকৃতি বিদেশী পুঁজিপতিদের শোষণের প্রকৃতির চেয়ে খুব একটা আলাদা কিছু নয় । নিজের   মুনাফাটাই সার কথা, চুলোয় যাক দেশের তথা দেশবাসীর কল্যাণ!

অর্থনৈতিক নীতিতেও বলে যেখানে ঘাটতি শ্রমিক (deficit labour) এলাকা সেখানে বড় পুঁজি, বৃহৎশিল্পের  প্রয়োজনীয়তা বেশি । আর যেখানে উদ্বৃত্ত শ্রমিক (Surplus labour) এলাকা, অর্থাৎ প্রচুর সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের প্রয়োজন রয়েছে, বেকার সমস্যা অত্যধিক সেখানে কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প ও মাঝারি শিল্পকেই গুরুত্ব দিতে হবে । ব্যাপকভাবে এইসব ছোট ছোট শিল্পের বিস্তার ঘটাতে পারলেই ব্যাপকভাবে দেশবাসীর কর্মসংস্থান হবে, তাদের দারিদ্র্য ঘুচবে, বেকারত্বের জ্বালা মিটবে ।

আর এই সমস্ত শিল্প স্থাপনে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের একেবারে আগ্রহ নেই, কারণ এতে লাভ কম । আর বিভিন্ন জেলায় জেলায়--- গ্রামাঞ্চলে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের প্রবেশ ঘটলে তারা  কুটিরশিল্প,ক্ষুদ্র শিল্প, মাঝারি শিল্প ও ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে । বৃহৎ পুঁজিপতিদের কাছে এদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না । তারা বেকার হয়ে পড়বে । সরকারকে তো পুঁজিপতিরা আগে থেকেই কিনে নিয়ে তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখে ।

তাই পুঁজিপতিদের ওপর ভরসা করে দেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের চিন্তা যাঁরা করেন তাঁরা  দিবাস্বপ্ন দেখেন, তাহলে পথ কী ? সেই পথই দেখিয়েছেন মহান্ দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, সে পথ প্রাউটের প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের পথ, অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের পথ, তথা অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের পথ । বহিরাগত পুঁজিপতিদের হাত থেকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে স্থানীয় মানুষের হাতেই অর্থনৈতিক ক্ষমতার সুষম বন্টন করতে হবে । এটাই দেশের  জনসাধারণের  দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বেকার সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।