মুক্তির আনন্দ সোপান

লেখক
ফরিদা নার্গিস

বর্তমান বিশ্ব এক চরম সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলেছে৷ বিশেষ করে নারীর ক্ষেত্রে অবদমন একটু বেশি মাত্রায় ঘটে চলেছে৷ আর নারী জাতির এই অবদমনের পেছনে সামাজিক–আর্থনৈতিক যত রকমের কারণ আছে, তার মধ্যে ধর্মমত (Religion) গত কারণ প্রধান দায়ী৷ আবার এই ধর্মমতের পেছনে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে নেপথ্যের সেই পুঁজিবাদী শক্তি৷ পুঁজিবাদী শক্তির সহায়তায় ধর্মমতগুলির বাড়াবাড়ি রকমের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও প্রথা পদ্ধতি মানব প্রগতির রথকে পিছনের দিকে টানছে৷ নারী জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধগলির পঙ্কিল আবর্তে৷ এর এক দিকে আছে পুঁজিবাদের ভোগ সর্বস্ব জীবনধারা অন্যদিকে ধর্মমতগুলির হাজারো বিধি নিষেধের বেড়াজাল৷ আর এই দুইয়ের পিষ্টনে নারীর জীবন ওষ্ঠাগত প্রাণ৷ নারী অবহেলিত, বঞ্চিত ও পথে ঘাটে ধর্ষিত হচ্ছে৷ দু’চার জন নারী ক্ষমতার ঊর্ধে উঠে এসে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকলেও সাধারণ নারী জাতির দুর্গতি কিন্তু বেড়েই চলেছে৷ সেখানে মালালা কিংবা রাজিয়া দু’য়ের অবস্থা কিন্তু একই৷ উভয়েই পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী, ভোগবাদী মানসিকতার শিকার৷

নারী শিক্ষার অধিকারের জন্যে আন্দোলন করতে গিয়ে ধর্মমতের ধ্বজাধারীদের হাতে গুলি খেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে মালালা পুঁজিবাদী বিশ্বের ক্রিড়নক হয়েছেন৷ তাঁকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে তাঁর কৈশোর–যৌবন কেড়ে নিয়ে তাঁকে পুঁজিবাদী বিশ্বের মুখপাত্র করা হয়েছে৷ পাকিস্থানের যে সোয়াট অঞ্চলের নারী মুক্তির জন্যে তাঁর সংগ্রাম ছিল, সেই সোয়াট অঞ্চলের অবশিষ্ট নারীরা কিন্তু আজও নিরাপত্তাহীন৷ প্রতি মুহূর্তে তাদের দিকে তালিবানী বন্দুকের নল তাক করা আছে৷ একজন মালালাকে বিশ্ববিবেক করে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রেখে লাভ কী? হাজারো মালালাদের দায়িত্ব কে নেবে? নাকি এও পুঁজিবাদীদের ভিন্ন কৌশল –

‘‘সাপ হইয়া দংশন করো 

ওঝা হইয়া ঝাড়ো’’৷

বিপরীতে আবার রাজিয়াদের দেখতে পাই অস্ত্র  হাতে৷ এরা শিক্ষা গ্রহণ করছে, মালালার বিপরীতে – অস্ত্রশিক্ষা, অস্ত্রের ট্রেনিং ও জেহাদের ট্রেনিং৷ আবার দুটো ঘটনাই ঘটছে ইসলামের দোহাই দিয়ে৷ অদ্ভুত দ্বৈরথ যাত্রা নারীকে নিয়ে, পুরুষ তান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজের৷

যে জেহাদি মানসিকতা নিয়ে রাজিয়া, শাকিলারা বেহেস্ত পাবার জন্য আত্মঘাতী হতে প্রস্তুত, সেই রাজিয়া শাকিলারা কি একবারও নিজেকে প্রশ্ণ করে দেখেছেন বেহেস্তের সুসজ্জিত বাগানে তার স্বামী দেবতাটি যখন চল্লিশ জন সুন্দরী, চিরকুমারী নারী বেষ্টিত থাকবেন, সেখানে তাদের কী অবস্থান হবে? নাকি তারাও চল্লিশ জন সুন্দর সুন্দর হুর পাবেন? এতগুলো পুরুষ বা নারী ভোগ সে কি ব্যাভিচার নয়? নাকি সেই ব্যাভিচার এই দুনিয়ার ব্যভিচারের চেয়ে সুখদায়ক? – ভাবতে পারি না৷ ভাবতে গেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়৷

এতদিন জেহাদ ছিল পুরুষদের মধ্যে৷ এখন নারীদেরকেও জেহাদের পথে টেনে আনা হচ্ছে৷ নারী সমাজের জন্যে আরেকটি চিন্তার কারণ৷ রাজিব গান্ধীর হত্যায় একজন জেহাদি তামিল নারীকে আমরা আত্মঘাতী হতে দেখেছি৷ এসব ধর্মমতের অন্ধ–কুসংস্কারের ফসল৷ আর পুঁজিবাদের পণ্য বানাবার কৌশল৷

আজ পুঁজিবাদীদের প্রচার যন্ত্রগুলি সাড়ম্বরে ধর্মমতের অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের কালিমা ছড়িয়ে চলেছে৷ ধর্মমতের ধ্বজাধারীরা সেই কালিমা গায়ে মেখে সমাজ–সংসারকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারের আবর্তে৷ নারী মুক্তি সেখানে সুদূর পরাহত৷

এই পঙ্কিল আবর্ত থেকে মুক্তির পথ আজ নারীদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে৷ দুই একজন মালালা হয়ে পুঁজিবাদীদের ক্রিড়নক হলে যেমন চলবেনা, তেমনি রাজিয়া, শাকিলা হয়েও লাভ নেই৷ মালালাকে ফিরে আসতে হবে সোয়াট অঞ্চলে৷ রাজিয়াদের ফিরে যেতে হবে সংসারে সন্তান সন্ততির সুন্দর স্বপ্ণিল ভবিষ্যতের জন্য৷ পুরুষদের যদি কিছু করার থাকে এদুয়ের অবস্থার পরিবর্ত্তনের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন৷ যদি না বাড়াতে পারেন সরে দাঁড়ান৷ নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার নারীর হাতেই ছেড়ে দিন৷ না, তার জন্য মালালাদের নোবেল পুরস্কার দিয়ে খাঁচায় বন্দি করার যেমন দরকার নেই, তেমনি রাজিয়াদেরও ঘৃণা করার অধিকার কারও নেই৷ আসলে মালালা, রাজিয়া উভয়েই পুঁজিবাদী পুরুষতান্ত্রিক ধর্মমতের শিকার৷ এর থেকে মুক্তির পথ নারীকেই খুঁজতে হবে৷ প্রয়োজনে ধর্মমতগুলির নিয়ম শৃংখল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে হবে৷ কোনো একক ধর্মমতের গন্ডীতে আবদ্ধ থেকে প্রকৃত মুক্তির স্বাদ পাওয়া যাবে না৷ কেননা ধর্মমতগুলির বিধান তৈরি হয়েছে পুরুষকেন্দ্রিক৷ সেখানে নারী ভোগ্যপন্য৷ নারী নরকের দ্বার৷

আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় যতটা জেনেছি, একবিংশ শতকের ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ তেমনি একটি (প্রাউট) দর্শন সেখানে নারীর প্রকৃত মর্যাদার কথা বলা হয়েছে৷ নারীকে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে৷ অর্ধেক মানুষ না, পূর্ণ মানুষ৷ এখন নারীকেও এগিয়ে আসতে হবে সেই মুক্তির আনন্দ সোপানে, মুক্ত জীবনানন্দ উপভোগ করতে৷