নববর্ষের বৃত্তান্ত

লেখক
প্রণবকান্তি  দাশগুপ্ত

ইউরোপে বর্তমানে নববর্ষ পালিত হয় ১লা জানুয়ারী৷ কিন্তু এক সময় মার্চ মাসে নববর্ষ হতো৷

যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে ইউরোপে যে পয়লা জানুয়ারী নববর্ষ দিবস পালিত হয় তা ভুল, হওয়া উচিৎ ২৩ শে  ডিসেম্বর৷ কারণ ঐদিন থেকে উত্তরায়ণ শুরু৷ উত্তরায়ণের আরম্ভকাল থেকেই নববর্ষের শুরু৷ তাঁর মতে, দোলোৎসব নববর্র্ষেৎসব ও বটে৷ দুর্র্গেৎসবকেও তিনি নববর্ষোৎসব বলেছেন৷ কারণ নববর্ষের লক্ষণ বৈশিষ্ট্য নাকি দুর্র্গেৎসবে লক্ষিত হয়৷ তাঁর মতে দুর্র্গেৎসবে আমরা যে বাসনকোসন কিনি, ঘরদোর ধোয়া মোছা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করি, পুরনো তৈজসপত্র ধুয়ে সাফ করি ও নতুন পোষাক পরিধান করি তার মধ্য দিয়ে নববর্ষোৎসবের নিয়মই লালন করে থাকি৷

বাংলাতেও এখন যেমন পয়লা বৈশাখ নববর্ষ পালিত হয়৷ প্রাচীনকালে হতো অগ্রহায়ণে৷ ‘হায়ণের’ অর্থ বৎসর৷ ‘অগ্র’ হচ্ছে প্রথম৷ অর্থাৎ বৎসরের প্রথম মাস৷ গীতায় অগ্রহায়ণকে বলা হয়েছে মার্গাশীর্ষ৷ এককালে এই মার্র্গশীর্ষ বা অগ্রহায়ণ ছিল বছরের প্রথম মাস৷ মার্র্গশীর্ষ নক্ষত্রে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হলে সেই পূর্ণিমাকে বলে মার্গশীর্ষ পূর্ণিমা৷ এই মার্গশীর্ষী পূর্ণিমার জন্যেই মাসটির নাম মার্গশীর্ষ পূর্ণিমা৷ অগ্রহায়ণ মাসে সূর্যাস্তের পর এই নক্ষত্রে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হয়৷ তাই এককালে অগ্রহায়ণই ছিল বছরের  প্রথম মাস৷ পয়লা অগ্রহায়ণই ছিল বছরের প্রথম দিন৷

আর্যরা উত্তরায়ণ আরম্ভের দিনটিকে  নববর্ষ মনে  করতেন৷ উত্তরায়ন আরম্ভ হয় ২২শে ডিসেম্বর বা ৭ই পৌষ৷ তাই আর্যগণ ৭ই পৌষ নববর্ষ পালন করতেন৷ সেদিন তারা সূর্যের  পূজা ও যজ্ঞ করতেন৷

আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে পৌষমাসের শেষদিনে উত্তরায়ণ আরম্ভ হতো৷ অতএব পরদিন পয়লা মাঘ ছিল নববর্ষের দিন৷ সেদিনের পূণ্য তিথিটি সাগরসঙ্গমে স্নান অর্থাৎ মকর স্নানের মধ্য দিয়ে আজো পালিত হয়৷

পয়লা বৈশাখে ব্যবসায়ীদের হালখাতার উৎস খুঁজতে হলে যেতে হবে সেই মোগল আমলে৷ আকবরের আমল থেকে হিজরী সন অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন রাজস্ব আদায় করা হতো৷ প্রজারা  তখন রাজস্ব স্বরূপ ফসল দিতো৷ তাই আজকের হালখাতার তখন নাম ছিল ফসলী৷ সংস্কৃত ভাষার এর নাম ছিল ‘পুন্যাহ’৷ অর্থাৎ পুন্যের দিন৷ পুণ্যের লোভে যাতে প্রজারা রাজস্ব দিতে অপারগ না হয় তাই কি এই নামকরণ?

চিনা আর ইহূদিরা কোন নির্দিষ্ট দিনে নববর্ষ পালন করতো না৷ প্রাচীনকালে চান্দ্রবৎসর গণনার রীতি ছিল৷ সভ্যতার উন্মেষের সাথে সাথে সৌর-আবর্তনকে কেন্দ্র করে বছরের হিসেব শুরু হয়৷ সূর্যের হ্রাস-বৃদ্ধি নেই৷ চন্দ্রকলার কিন্তু হ্রাস বৃদ্ধি আছে৷ আর এই সূর্য ও চন্দ্রের গতির তারতম্য হেতু কোন বছরে বার , কোন বছরে তেরো মাস গোণা হয়৷ ফলে প্রাচীনকালে বিশেষতঃ চিনা আর ইহূদিরা নববর্ষ কোন নির্দিষ্ট দিনে পালন করতো না৷

নেপালে নববর্ষ হয় কার্ত্তিক পূর্ণিমার পরদিন৷ তামিলরা তাদের নববর্ষ (পোঙ্গল) পালন করে মাঘের শুরুতে৷

প্রাচীনকালে চিনে পুরনো বছরের প্রতীক হিসাবে একটি কাগজের ড্রাগন তৈরি করে তাকে পোড়ানো হতো৷ অর্থাৎ পুরনো বছরের অশুভ রাত্রিকে পুড়িয়ে নতুন দিনের আবাহন হতো এইভাবে৷

পশ্চিম আফ্রিকার কিছু কিছু উপজাতির মধ্যে নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় শস্যক্ষেত্রে নারী-পুরুস নির্বিশেষে আনন্দোৎসব হতো৷

জাপানে নববর্ষের দিন দুটো পিঠে তৈরি হয়৷ একটি পিঠে পুরুষ, অপরটি নারীরূপে কল্পিত হয়৷

খ্রীষ্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার ১লা জানুয়ারী নববর্ষ প্রচলন করেন৷ ঐ দিন একটি কলাগাছ তৈরি করে তার তলায় ইউরোপীয় তরুণ-তরুণীরা প্রেম নিবেদন করতো৷ তবে তাদের  প্রেম নিবেদনের পদ্ধতিটা আমাদের দেশের উপযোগী নয়৷ তাই উল্লেখ করলাম না৷

উত্তর ভারতে বর্ষারম্ভ হয় চৈত্রমাসের শুক্লা প্রতিপদে৷ ঐ দিন সেখানে ধবজা রোপণের প্রথা আছে৷ মোগল আমলে উত্তর ভারতে ফসলীবর্স প্রচলিচত ছিল৷ ফসলী বর্ষশুরু হতো ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা প্রতিপাদ থেকে৷

উড়িষ্যায় চালু ছিল আমলী ও বিলায়তী অব্দ৷ আসলী অব্দ শুরু হতো ভাদ্রমাসের শুক্লা দ্বাদশী থেকে৷ আর বিলায়তী আশ্বিন থেকে৷ 

দক্ষিণ ভারতে বর্ষ শুরু হয় বৈশাখ মাসের কৃষ্ণা প্রতিপাদ থেকে৷

কেরলে কোল্লামবর্ষ শুরু হয় ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা নবমী থেকে৷

গুজরাটের লোকেরা দেওয়ালীর দিন নববর্ষ পালন করে৷ সেদিন তারা জুয়া খেলে হার জিতের ভিত্তিতে নতুন বছরের ভাগ্য পরখ করে  নেয়৷