নববর্ষের প্রাক্কালে---আলো-অন্ধকারে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

কালের প্রবাহে বহে গেল গেল আরও একটা বছর৷ দিন-রাত্রি, সুখ-দুঃখের মত এই বছরটাও কেটে গেল আলো-অন্ধকারে৷ কিন্তু বছর শেষে অন্ধকারের আশঙ্কাই যেন ঘনিয়ে আসছে৷ অর্থনৈতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বিভাজনের নীতি আর একটা অন্ধকারময় বছরের ইঙ্গিত দিচ্ছে৷

আর ক’দিন পরেই বিদায় নেবে ২০১৯৷ নোতুন বছরের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে একবার ফিরে দেখা যাক এই বছরটা কি দিয়ে গেল৷

সংখ্যাতত্ত্বের গরিষ্ঠতার জোরে শাসকের  উচ্চ আস্ফালনে সমাজে, রাষ্ট্রে, রাজনীতির অঙ্গনে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে৷ দিল্লী, হায়দ্রাবাদ, উন্নাও দেখিয়েছে আদিম প্রবৃত্তির নৃশংস বর্বর রূপ৷ শিক্ষার অঙ্গনে উচ্ছৃঙ্খলতার প্রকোপ, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির অঙ্গনে অশ্লীতার নৃত্য সমাজকে অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ অর্থনৈতিক মন্দাও চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে৷ আই.এম.এফ (ইণ্টারন্যাশনাল মনিটারি ফাণ্ড)-এর পক্ষ থেকে ভারতকে সতর্ক করা হয়েছে---এক্ষুণি ব্যবস্থা না নিলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে৷ তখন বিপর্যয় সামলানো সম্ভব হবে না৷

 

গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত সামাজিক বিভাজনের বিল সংখ্যাধিক্যের জোরে আইনে পরিণত হয়েছে৷ ২০১৯- এই লোকসভার নির্বাচন হয়েছে৷ সেখানে শাসক দল পুনরায় বিপুল সংখ্যাগরিতা নিয়ে ফিরে এসেছে৷ আর সেই সংখ্যাধিক্যের জোরে বিরোধী দল তো বটেই জোটের শরিক দলগুলোকেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকে এন.ডি.এ.-র বড় ভাই৷ গণতন্ত্র সুরক্ষিত রাখতে বিরোধী দলের একটা মুখ্য ভূমিকা থাকে৷ কিন্তু ভারতবর্ষের সমস্যা কোন শাসক দলই কখনো বিরোধিতা সহ্য করতে পারে না৷ শুধু  সংখ্যাধিক্যের জোরে বিরোধিতাকে অবজ্ঞা করা, ছলে-বলে জব্দ করা শাসকের স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়৷ ঠুনকো দেশপ্রেমের হুজুগ তুলে বিরোধীদের গায়ে দেশদ্রোহীর তক্মাও লাগিয়ে দেওয়া হয়৷ এইসব বাদানুবাদ নিয়েই একটা বছর কেটে গেল৷ জনগণ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল৷

এরই মাঝে ধর্মীয় মতকে অবলম্বন করে সামাজিক বিভাজনের বিল আইনে পরিণত হ’ল৷ দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ নাগরিকত্ব হারাবার আতঙ্কে, আশঙ্কায় দিশাহীন৷ প্রতিবাদে আন্দোলনে উত্তাল হ’ল গোটা দেশ৷ আন্দোলন দমন করতে অসম, উত্তরপ্রদেশ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে শাসকের নিষ্ঠুর পদক্ষেপ কেড়ে নিল কিছু প্রাণ৷ বছর শেষের দিনগুলো লেখা হয়ে থাকল নিরীহ নাগরিকের রক্তের অক্ষরে৷ দাম্ভিক শাসক তবু টলল না৷ বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শাসকের মতই তার ঔদ্ধত্য নিরীহ নাগরিককে খুন করে৷ চারিদিকে আশঙ্কা, আতঙ্কের দম বন্ধ করা পরিবেশ৷

এই পরিবেশের মধ্যেই হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র ও কিছু পরে ঝাড়খণ্ডের নির্বাচন এক টুকরো আলোর নিশানা দিল৷ হরিয়ানায় লেজুড় দলের সাহায্যে গদী বাঁচালেও মহারাষ্ট্রে রাজ্যপালকে হাতিয়ার করে পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে গিয়ে মুখ পুড়ল৷ ঝাড়খণ্ডে সেই সুযোগও হয়নি৷ জনগণ সরাসরি খারিজ করল শাসকের ঔদ্ধত্যকে৷ ক্ষমতা দখল করল বিরোধী জোট৷

বিপদ বুঝে বুলি পাল্টালো দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা৷ দু’মাস আগেও যারা গলা ফুলিয়ে দেশজুড়ে  এন.আর.সি.-র হুমকী দিয়েছিলেন, সংসদে দাঁড়িয়ে অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পে মৃত্যুর হিসেব দিয়েছেন তারাই ঝাড়খণ্ডে নির্বাচনে  ভরাডুবির পর বেসামাল হয়ে পড়লেন৷ এন.আর.সি. ডিটেনশন ক্যাম্পের কথা অস্বীকার করলেন৷ তুড়ি মেরে  উড়িয়ে দিলেন কয়েকমাস আগের বলা কথা৷

অন্ধকার ভেদ করে দেখা দিল আলোর নিশানা৷ শাসকের দম্ভ কখনোই শ্বাশত হতে পারে না৷

‘একের স্পর্ধারে কভু নাহি দেয় স্থান

দীর্ঘকাল নিখিলের বিরাট বিধান’৷

কিন্তু এইটুকুই যথেষ্ট নয়৷ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি বাসা বেধেছে, অশ্লীলতা, অসংযমতা সমাজকে অস্থির করে তুলেছে তার থেকে মুক্তির পথ খঁুজে বের করতে হবে৷ নববর্ষের প্রাক্কালে আমাদের নতুন করে শপথ নিতে হবে সর্বগ্লানি মুক্ত, সর্বকলুষমুক্ত এক নোতুন পৃথিবী গড়ে তোলার৷ তবে সবার আগে চাই ভোগ-সর্বস্ব জীবনের আমূল পরিবর্তন৷ তার জন্য প্রয়োজন কুসংস্কার মুক্ত, সংকীর্ণতা মুক্ত বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিসম্মত অধ্যাত্মবাদের অনুশীলন৷ মহান দার্শনিক  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার আধ্যাত্মিক জগতে যিনি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি নামে সমধিক পরিচিত তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শনে এই বিজ্ঞানভিত্তিক অনুশীলনের পথ দেখিয়েছেন৷  সেই পথেই সম্ভব নোতুন মানুষ, নোতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলা৷

তাই আজ আলো ও অন্ধকারে, আশা-নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে নোতুন বৎসরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে জীবনের ব্রত হোক নোতুন মানুষ হয়ে ওঠার যারা আগামী প্রজন্মকে উপহার দিয়ে যাবে সার্বিক শোষণমুক্ত এক নোতুন পৃথিবী৷