নিখাদ প্রতারণা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

দেশের রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সদস্যরা নির্বাচনের প্রাক্কালে নিজ নিজ দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে ইস্তাহার প্রকাশ করে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিতে দেখা যায়৷ কিন্তু স্বীকার করতেই হয় এই সকল প্রতিশ্রুতির ভেতর এমন অনেক সদিচ্ছা থাকে যা সাধারণ ভোটারদের প্রলুব্ধ করে থাকে৷ অথচ নির্বাচন বৈতরণী পার হয়ে গেলে বিজয়ী দলের সাংসদ ও বিধায়করা প্রতিশ্রুতি পূরণের কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুলে যান৷ বিগত ৭৩ বছর ধরেই এমনটা হচ্ছে৷ মাঝে মাঝে সরকার বদল হয়৷ কিন্তু নির্বাচনের পূর্বে দেওয়া প্রতিশ্রুতি নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ভুলে যাওয়াটাই নেতামন্ত্রীদের রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে সোনার বাঙলার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় শাসক দল৷ তাদের স্বভাব সিদ্ধ আচরণ ত্যাগ করে প্রচারের প্রধান মুখ একেবারে বাঙালী পোষাকে বারে বারে বাঙলায় ছুটে আসছেন৷ কিন্তু মুখে নেই হিন্দুত্বের কথা, শ্যামাপ্রসাদের কথা, মুখ্যমন্ত্রীর মুসলীম তোষণের কথা৷ এই সেদিন আম্ফানে বিপর্যস্ত বাঙলার প্রতিও যার নজর ছিল না, হঠাৎ করে বাঙলার মসনদ দখলের স্বপ্ণে বিভোর হয়ে সোনার বাঙলার প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাঙলায় ছুটে আসছেন৷ এই দল গত ২০ বছর গুজরাট শাসন করছে৷ সেই গুজরাট আজও কেন সোনার হয়নি৷

এর উত্তর দেবেটা কে? অবশ্য এর উত্তর তথাকথিত নিরপেক্ষ ভেকধারী সংবাদ পত্রের সম্পাদকীয়তে দেখা যায়, তাঁরা বলেন দলীয় ইস্তাহার রাষ্ট্রের বাজেট নয় যে এর সমালোচনা চলবে৷ বিষয়টা একান্তই দলের অভ্যন্তরের বিষয়৷ অবশ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বক্তব্য হল, ভারতীয় সংবিধান এ সম্পর্কে কোনরূপ বক্তব্য রাখেনি৷ সুতরাং আইনগত বিচূ্যতির সুযোগে দল ও গোষ্ঠীর রাজনীতিকরা দলীয় ইস্তাহারের মাধ্যমে ভোটদাতাদের প্রলুদ্ধ করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে প্রতিশ্রুতি রক্ষাকে কর্তব্য বলে মনে করেন না৷ সুতরাং প্রথমে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও পরে তা অস্বীকার করাকে প্রতারণা বলে অবিহিত করতে বাধা নেই৷ কেননা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট আদায়ের পরে পরে তা পূরণ না করাটা নিখাদ প্রতারণাই৷

বস্তুত দেশের প্রতিটি দল ও ব্যষ্টি কেন্দ্রীক রাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রতিশ্রুতি পূরণ না করলেও প্রতারিত জনতা এর বিরুদ্ধে আইনগত সাহায্য পাওয়ার অধিকারী নয়৷ এই আইনগত বিচূ্যতির জন্যেই দেশের জাতীয় আঞ্চলিক ও ব্যষ্টি কেন্দ্রীক রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচন এলেই ঢ়াকঢ়োল পিটিয়ে দলীয় ইস্তাহার প্রকাশ করে থাকে৷ এই সকল ইস্তাহারের সদিচ্ছা জনসাধারণকে দলের প্রতি প্রলুদ্ধ করাই নেতৃত্বের উদ্দেশ্য৷ কিন্তু ইস্তাহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি দলীয় সাংসদ ও বিধায়ক কতদিনের মধ্যে পূরণ করবেন সে বিষয়ে কোনও উল্লেখ থাকেনা৷ অথচ যে প্রতিশ্রুতি ভোটারদের সম্মুখে তুলে ধরা হচ্ছে তার মূলধন কোথা থেকে সংগ্রহ করা হবে এ সম্পর্কেও দলীয় নেতৃত্ব একটি কথাও ব্যয় করেনা৷ সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলি জনতার সঙ্গে প্রতারণার পথটি প্রথম থেকেই খোলা রাখে৷ আর এখানেই বোঝা যায় দলীয় ইস্তাহার যে নিখাদ প্রতারণার হাতিয়ার মাত্র৷

২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে দেশবাসীকে গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী৷ সুইসব্যাঙ্কের কালো টাকা ফিরিয়ে আনা, বছরে দু–কোটি চাকরী,নেতাজী গোপন ফাইল প্রকাশ, সীমান্তে নির্মূল, শূন্য এ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ ইত্যাদি ইত্যাদি৷ তার একটা প্রতিশ্রুতিও  এখনও পুরণ হয়নি৷ এরই মধ্যে আবার সোণার বাঙলার স্বপ্ণ ফেরি  করে ভোট কুড়তে মাঠে নেমেছেন৷ চিটফাণ্ড কাণ্ডে অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ তারা জনগণকে প্রভাবিত করেছে চিটফাণ্ডে টাকা রাখতে৷  পরে সেই টাকা আর গ্রাহকরা ফেরত পায়নি৷ একইভাবে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণকে ভোট দিতে প্রভাবিত করার পর প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করাটাও জনগণের সঙ্গে প্রতারণার সামিল৷

এমতাবস্থায় ইস্তাহার বিলিয়ে দেশের মানুষকে প্রতারণা করতে রাজনৈতিক দলগুলি যাতে না পারে তার জন্যে অচিরেই একটি নির্বাচনী আইন চালু করা দরকার৷ দ্বিতীয়তঃ ইস্তাহারে বর্ণিত প্রতিশ্রুতি জয়ী রাজনৈতিক দলগুলি কতদিনের মধ্যে সম্পন্ন করবে তা আইন করে বেঁধে দিতে হবে৷