নীলকণ্ঠ দিবস ও প্রাউট কি ও কেন

লেখক
অনন্যা সেনগুপ্ত

আমরা জানি সদাশিবকে নীলকণ্ঠ বলা হয়৷ কারণ সমুদ্র মন্থনের সময় যে গরল অর্থাৎ বিষ উঠেছিল তিনি তা নিজ কণ্ঠে ধারণ করে জগৎকে বাঁচিয়েছিলেন৷ বিষ ধারণের ফলে তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে যায়৷ সেই থেকে শিবের এক নাম নীলকণ্ঠ হয়৷

এটা কল্পনা, প্রতীক বা রূপক যাই হোক, বর্তমানের বাস্তবে বিশ্বাসযোগ্য না হলেও ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী ইতিহাসের পাতায় এক উল্লেখযোগ্য দিন৷ যা আধুনিক বিশ্ববাসীর কাছে নীলকণ্ঠ দিবস নামে পরিচিত হয়ে থাকবে৷ ওই দিনই পটনার বাঁকীপুর সেণ্ট্রাল জেলে ডাক্তারের মাধ্যমে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারকে মারাত্মক রাসায়নিক বিষ ঔষধের ছলে প্রয়োগ করা হয়৷ তীব্র বিষক্রিয়ায় তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন৷ পরের দিন ১৩ই ফেব্রুয়ারী তাঁর জ্ঞান ফেরে৷

শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন সমাজ সংস্কারক, পরিবেশ বিজ্ঞানী তথা মহান দার্শনিক, সত্যদ্রষ্টা মনীষী, প্রাউট তত্ত্বের প্রবর্ত্তক তেমনি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে ধর্মগুরু হিসেবে তিনি সামাজিক-আধ্যাত্মিক সংঘটন ‘আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের’ প্রতিষ্ঠাতা ও আনন্দমার্গ দর্শনের প্রবর্ত্তক শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী রূপে পরিচিত৷

তাঁকে বিষপ্রয়োগের প্রধান কারণ তাঁর সামাজিক-অর্থনতিক তত্ত্ব ‘প্রাউট’৷ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ ও সুষম বণ্টন প্রাউটের মূল কথা৷ প্রাউটের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদী শোষক ও অলীক সমাজতন্ত্রের ধারক মার্কসবাদীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে৷

এখন আলোচনায় আসা যাক৷ প্রাউট কী? প্রাউট হ’ল---‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ ইংরাজীতে Progressive Utilization Theory, বা সংক্ষেপে PROUT৷ ঊণবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদের বিকল্প হিসেবে উঠে আসে মার্কসবাদ৷ কিন্তু শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার দেখিয়ে দেন মার্কসবাদ ও পুঁজিবাদের মধ্যে মূলতঃ কোন পার্থক্য নেই৷ কারণ পুঁজিবাদে সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করে নেয় কয়েকজন ব্যষ্টি৷ অপরদিকে মার্কসবাদে সেই ভূমিকাটা পালন করে পলিটব্যুরো বা রাষ্ট্রের পরিচালকগণ৷ অর্থাৎ মার্কসবাদকে বলা যায় রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ৷

শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর যুগোপযোগী প্রাউট তত্ত্বে প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা)  নিশ্চিততা দিয়েছেন৷ প্রাউটের পঞ্চমূল নীতির একটিতে আছে--- ‘কোন ব্যষ্টিই সামবায়িক সংস্থার সুষ্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না৷  (প্রসঙ্গত প্রচলিত সমবায় পদ্ধতি নয়, আধুনিক পরিবর্তিত ও যৌক্তিকতাভিত্তিক সমবায় পদ্ধতি) কেন পারবে না---এ প্রশ্ণ স্বাভাবিক৷ এ প্রশ্ণের উত্তরে প্রাউটে বলা হয়েছে বিশ্বের সমগ্র সম্পত্তির মালিক পরমপুরুষ৷ মানুষ তার প্রয়োজন মত সেই সম্পদ ভোগ করতে পারে, কিন্তু কুক্ষিগত করে রাখতে পারে না৷ কারণ সঞ্চয়ের অবাধ স্বাধীনতা সমাজে  ধনবৈষম্য সৃষ্টি করে৷ আজ সমাজে সেটাই হয়েছে৷ পুঁজিবাদের আগ্রাসন বিশ্বের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষের হাতে৷ ভারতবর্ষেও ৮০ শতাংশ সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে আর দেশে চরম বেকারত্ব৷ গরীব আরও গরীব হচ্ছে দিন দিন, ধনীর ভাণ্ডার দিন দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে৷ এই অবস্থায় প্রাউটের বিকল্প অর্থনীতি অর্থাৎ বিকেন্দ্রীত অর্থনীতি ও সম্পদের সুষম বণ্টনের দ্বারা অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই অর্থনীতির সুফল প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে৷

প্রাউট তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন প্রাউটিষ্ট ইয়ূনিবার্সাল৷ সেই সঙ্গে তিনি  বুঝিয়ে দেন শোষণের ছলা-কলা, পুঁজিবাদ কীভাবে স্থানীয় সংসৃকতি, কৃষ্টি, অর্থনীতিকে ধবংস করে মানস অর্থনৈতিক শোষণের দ্বারা তার জ্বাল বিস্তার করে৷ পুঁজিপতিরা এই জিনিস মেনে নিতে পারল না৷ অপরদিকে কমিউনিষ্টরাও---যারা ভেবেছিল মার্কসবাদই শেষ কথা প্রাউটের অভ্যুত্থানে তাঁরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে৷ পুঁজিপতি ও কমিউনিষ্টদের মিলিত চক্রান্তে ২৯শে ডিসেম্বর সি.বি.আই শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারকে গ্রেফ্তার করে৷ জেলের মধ্যে অমানবিক অত্যাচার করে, প্রলোভন দেখিয়েও যখন তাঁকে বাগে আনা গেল না, তখনই বে-পরোয়া হয়ে তাঁকে হত্যা করার জন্যে ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী রাত্রি ১১-টার সময় জেলের ডাক্তারকে দয়ে শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়৷ কিন্তু ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে শ্রী সরকার সেই বিষ হজম  করে নেয়৷

শ্রী সরকার প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি দেন ভারত সরকার ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে৷ কিন্তু কোন প্রতিকর না পেয়ে ১লা এপ্রিল থেকে অনশন শুরু করেন৷ ১৯৭৮ সালের ২রা আগষ্ট জেল থেকে বেরিয়ে তিনি এই অনশন ভঙ্গ করেন৷

পুঁজিবাদ ও মার্কসবাদ প্রভাতরঞ্জন সরকারকে ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থাকে দমাতে পারেনি৷ বরং আজ বিশ্বের ১৮২টি দেশে প্রাউট তত্ত্ব সমাদৃত ৷ কমিউনিজম এখন মৃতপ্রায়, পুঁজিবাদেরও দিন শেষ হয়ে আসছে৷ মানুষের সামনে প্রাউটের বিকল্প কোন পথ আজ আর নেই৷