নিম

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

পরিচয় ও প্রজাতি ঃ বিশ্বে নিমের অনেক প্রজাতি আছে – কেউ খুব তেঁতো, কেউ কম তেঁতো, বা কেউ একেবারেই তেতো নয়–যেমন মিঠা নিম বা কারি লিফ্৷ ভারতের যে সকল স্থানে তেজপাতা জন্মায় না সেখানকার মানুষ তেজপাতার বদলে এই মিঠা নিম বা কারি লিফ্ ব্যবহার করে থাকেন৷

সাধারণ নিম যা আমরা দেখে থাকি তা মূলতঃ ভারতীয় উৎসের৷ একে দেশী নিম বলা হয়৷ ‘নিম’ শব্দটি সুপ্রাচীন সংস্কৃত ‘নিম্ব’ শব্দ থেকে এসেছে (নিম্ব > নিম্ব্ > নিম হিন্দীতে ঈ–কার দিয়ে লেখা হয় নীম)৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রাচীন সাহিত্যে নিমের কথা রয়েছে৷ অতি শীতের দেশ ব্যতীত নিম সর্বত্রই জন্মায়৷ এমনকি অল্প স্বল্প মরুভূমির আক্ষহাওয়াও নিম সহ্য করতে পারে৷ ভারতে ও এশিয়ায় এই সাধারণ নিম গাছের সংখ্যাই বেশী৷

ভারতে অধিক তিক্ত যে নিমটি পাওয়া যায় ক্ষাংলায় তাকে বলি ঘোড়া নিম – উর্দূতে ‘বকায়ন’, সংস্কৃতে ‘মহানিম্ব’ বা ‘কেশমুষ্টি’৷ এর গাছ আকারে একটু বড়, পাতা তীক্ষ্ণাগ্র৷ ফল কিছুটা গোলাকার৷ ঘোড়া–নিম গাছের দৈর্ঘ্য সাধারণ নিমের চেয়ে বেশী৷ ঘোড়া নিমের পাতা সাধারণ নিমের পাতা থেকে ভিন্ন৷ ভারতের সর্বত্রই এই ঘোড়ানিমের গাছ দেখা যায়৷ গাছের সংখ্যা সাধারণ নিমের চেয়ে কম৷ কারণ লোকে খাদ্য হিসেবে এর পাতা খায় না বলে এর গাছ লাগায় কম৷

রক্তদুষ্টি ও চর্মরোগে নিম ঃ ঔষধ হিসেবে সাধারণ নিমের অভ্যন্তরীণ ও বহিরঙ্গিক দুই–ই ব্যবহার আছে৷ এর পাতা, ডগা, ছাল, বীজ ইত্যাদি থেকে ঔষধ তৈরী হয়৷ নিমের পাতার রস অল্প পরিমাণে খেলে রুচিবর্দ্ধক ও রক্তশোধক৷ নিমপাতার রস বাইরের ক্ষতস্থানে প্রলেপ হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে ঙ্ম নিম পাতা জলে সেদ্ধ করে সেই জল antiseptic বা বীজাণু–নিবারক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে ক্ষ৷ নিম পাতার রস সহযোগে তৈরী নিম–তৈল বা নিম–ঘি চর্মরোগের ঔষধ তো বটেই, নিম বীজের তৈলও চর্মরোগের মহৌষধ ঙ্ম কুষ্ঠরোগে নিম ছালের ক্কাথ একটি ঔষধক্ষ নিম গাছের ছায়া শরীরের পক্ষে খুবই ভাল৷ নিমের ছাল লঘু–চর্মরোগের ঔষধ৷ ঘোড়া নিমেরও ঔষধীয় গুণ অপরিসীম৷ চর্মরোগে বাহ্যিক প্রয়োগে এই নিমই সবচেয়ে সুন্দর ফল দেয়৷ এই গাছের হাওয়া যে কোন চর্মরোগের পক্ষে তো ভালই, ম্যালেরিয়া ও অনেক প্রকারের জ্বর রোগেরও ঔষধ৷ ছোট গ্রামে অন্ততঃ একটি ও বড় গ্রামে একাধিক কেশমুষ্টি বা ঘোড়া নিমের গাছ থাকা ভাল৷ নিমগাছের রস (Aqua Margosa) খেতে গেলে যাঁদের আমাশয় বা অর্শ রোগ রয়েছে তাঁরা যেন সাধারণ নিমের রসই খান৷ তবে যাঁদের অর্শ বা আমাশয় নেই, তাঁরা ঘোড়া নিম গাছের রসও খেতে পারেন৷ ঙ্ম ঋতুরোগে ঘোড়া নিমের ছাল থেকে ঔষধ তৈরী হয়৷ ক্ষ ‘‘ঘোড়া নিম গাছের শেকড়ের ছাল ৩/৪ তোলা পরিমাণ নিয়ে জলে সেদ্ধ করে ঋতুকালে (নারীরা) প্রত্যহ সকালক্ষেলা সেবন করলে ঋতু পরিষ্কার হয়৷’’

তিক্ত ভোজ্য হিসেবে নিমের ব্যবহার–বসন্ত ঋতুতে নিম ভক্ষণ ঃ নিমপাতা ভাজা প্রথম পাতে খেলে পেট ভাল খাকে ও কৃমি রোগের হাত থেকে রক্ষা করে৷ তবে ঘোড়া নিমকে ভোজ্য হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়৷ অতিরিক্ত তিক্ততা–নিবন্ধন একদিনে বেশী খেলে অথবা একটানা পর পর কয়েক দিন খেলে রক্ত–আমাশয় দেখা দেবার সম্ভাবনা৷

বসন্ত ঋতুতে নিমের পাতা মহোপকারী ঔষধ৷ এর প্রভাবে চর্মরোগ বিনষ্ট হয়, রক্ত পরিষ্কার হয়, রক্তদুষ্টি বিদূরিত হয়৷ ‘‘বসন্তে ভ্রমণং পথ্যং অথবা তিক্তভোজনম্’’– বসন্তকালে ভ্রমণ করলে যে গুণ পাওয়া যাবে, পথ্য হিসেবে তেঁতো খেলে সেই একই গুণ পাওয়া যাবে৷ বসন্তকালে হপ্তায় কম করে’ দু’দিন, বেশী করে তিন দিন, প্রথম পাতে নিম–বেগুন ভাজা খেতে হয়৷ তাতে এক বছর গুটিকা–ব্যাধি (small pox, chicken pox) হবে না৷ এক্ষেত্রে সাধারণ নিম না পেলে ঘোড়া নিম খেলেও খেতে পার৷ তবে তা খেও কম পরিমাণে–অর্থাৎ বেশী পরিমাণ বেগুনের সঙ্গে মিশিয়ে৷ বসন্ত ঋতুতে নিম–ঝোল অথবা নিম–শুক্তোও স্বাস্থ্যবর্দ্ধক তথা রোগ–প্রতিষেধক৷

নিম–তৈল ও নিম–ঘি ঃ নিম বীজের তৈল ত্রিদোষজ চর্ম রোগের ঔষধ৷ নিম–ঘি ও নিম–তৈল সাধারণ নিমেও হয়, আবার ঘোড়া–নিমেও হয়৷ তবে ঘোড়ানিমের তেল বেশী ফলপ্রসূ৷ নিম পাতার রসে প্রস্তুত নিম–ঘি সংক্রামক চর্মরোগের ঔষধ৷

নিম তেল প্রস্তুত করবার প্রণালী ঃ নিমপাতা ছেঁচে বা বেটে রস বের করে নাও৷ রসের পরিমাণের (ধরা যাক এক সের) অর্ধ্বেক পরিমাণ (এক্ষেত্রে তাহলে আধ সের) তিল–তৈল মিশিয়ে জ্বাল দাও৷ তৈলের পরিমাণ যতখানি ছিল জ্বাল দেবার পরে ততটুকু মাত্র অবশিষ্ট থাকতে জ্বাল দেওয়া বন্ধ করো৷ নজর রাখবে তেল যেন পুড়ে না যায়৷ ঙ্ম নিম–ঘিও একই প্রণালীতে প্রস্তুত করা হয়–তফাৎ শুধু তিল–তৈলের পরিবর্ত্তে গাওয়া–ঘি ব্যবহার করতে হয় ক্ষ৷

নিম–মধু ও অকাল–বার্দ্ধক্য ঃ নিমফুলের মধুতে বিশেষ কয়েকটি গুণ রয়েছে৷ নিম–ফুলের মধু যে কেবল একটি পুষ্টিকর খাদ্য ও উন্নত মানের শর্করাপ্রতিভূ তাই–ই নয়, নিম ফুলের মধু একটি উন্নত মানের ঔষধ৷ অল্পপরিমাণে নিমের মধু খেলে একদিকে যেমন লিবারের পক্ষে কল্যাণকর, অপরদিকে তেমনি রক্তগতিবর্দ্ধকও কোন কোন বৈদ্য–শাস্ত্রের মতে আয়ুবর্দ্ধকও বটে৷ এ ব্যাপারে সাধারণ নিম ও ঘোড়ানিম দুই–ই সমভাবে উপকারী৷ অকাল–বাক্ষার্ধক্যের উত্তম শ্রেণীর ঔষধ হ’ল নিম–মধু৷ তোমরা দেখে থাকবে, কোন কোন ছেলের ২৫/২৬ বছর বয়স হলেই বার্দ্ধক্য অথবা বুড়োমির নানা লক্ষণ এসে যায়৷ উঠতে–বসতে চায় না– সব সময় শুয়ে থাকতে ভালবাসে৷ অল্প শীতে গলায় মাফ্লার বাঁধে......বৃষ্টিতে ঘরের বাইরে বেরোয় না৷ ঙ্ম এ সব ক্ষেত্রে নিম–মধু ব্যবহার করা উচিত৷ যেখানে এক বা একাধিক নিম–গাছ আছে সেখানে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী মৌচাক থেকে নিম–মধু সংগ্রহ করা যায়৷ তা ছাড়া  ওই সব স্থানে মৌমাছি পালনের মাধ্যমে অর্থাৎ Bee-keeping বা Bee-boxes  থেকে প্রাপ্ত নিম–মধুও কাজে লাগে৷

অন্যান্য রোগে ব্যবহার ঃ নিমের শেকড় যকৃৎ সংক্রান্ত ব্যাধির ঔষধ৷ নিমের রস মধুমেহ রোগের (Diabetes) ঔষধ৷ রক্তে শর্করা অংশ কমাতেও এ সাহায্য করে৷ ‘‘অর্শের বলির ওপর কচি নিমপাতা দিয়ে তৈরী নিম–ঘি ঈষৎ গরম অবস্থায় লাগিয়ে দিলে কয়েক দিনের মধ্যেই রোগ সেরে যায়৷ শয়নের পূর্বেও নিম–ঘি ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়৷’’

নিম ও পঞ্চবটী ঃ নিমের হাওয়া ক্রমি–বিনাশক। ক্রমি মানে ব্যাকটিরিয়া রোগ–বীজাণু তো বটেই, শত্রু স্বভাবের মাইক্রোবাইটামের বিরুদ্ধে যুঝতে পারে৷ সেইজন্যে স্বীকৃত পঞ্চবটীর মধ্যে নিম অন্যতম৷ প্রাচীনকালে মানুষ রোগ বীজাণু–বিমুক্ত পরিবেশে সাধনা করতে চাইতেন৷ তাই তাঁরা সাধনা স্থানে পঞ্চবটী রচনা করতেন (নিম্ব, বিল্ব, শাল্মলী, বট ও অশত্থ) কেউ কেউ বিকল্পে আমলকীকেও ধরে থাকেন৷ পঞ্চবটীতে সাধারণ নিমের পরিবর্ত্তে মহানিম্বও চলতে পারে৷

ঔষধ ছাড়া অন্যান্য ব্যবহার ঃ নিমের পাতা বস্ত্র উপগত কীটেরও ঔষধ৷ নিমের কাঠ বেশ উন্নত মানের৷ নিমের গাছ আকাশ থেকে মেঘকে টেনে আনে, ভূমিক্ষয় রোধ করে ও সুনিবিড় ছায়া দেয়৷ আজকাল নিমের তেল থেকে সাবান, টুথপেস্ট ও নানান রকমের শরীর–চর্চার ঔষধ তৈরীর উপকরণ হচ্ছে৷ নিমের দাঁতন দাঁতের পক্ষে অতি উপকারী৷

(শ্রীশ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের

‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে)