নিপীড়িত মানবতার মুক্তির আদর্শ ও দধীচি দিবস

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

মানুষ আজ দিশাহীনতায় ভূগছে৷ লক্ষ্যহীন মানব জীবন৷ ধর্মের স্থান অধিকার করেছে রাশি রাশি ডগমা বা ভাবজড়তা, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার৷ সামাজিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও মূলত পুঁজিবাদ, মাকর্সবাদ (জড়বাদ) আর ডগমা এই তিনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে৷ অথচ এই তিনের কোনটারই সর্বাত্মকশোষণমুক্ত সমাজ গড়বার সামর্থ্য নেই৷ ফলে মানব সমাজে আজ সর্বক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে চরম আদর্শগত শূন্যতা৷

এরফলে আজ সর্বত্র চলছে ব্যাপক দুর্নীতি ও শোষণ, আর মানুষের ব্যষ্টিগত জীবনেও চরম উচ্ছৃঙ্খলতা ও অশান্তি৷

এই অবস্থায় জগদ্গুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আজকের যুগে চরম আদর্শগত শূন্যতা দূর করতে এনেছেন এক সর্বানুসূ্যত দর্শন---আনন্দমার্গ৷ কি ধর্ম, কি শিক্ষাব্যবস্থা, কি সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন, সর্বক্ষেত্রে তিনি মানুষকে আজকের সমস্ত সমস্যার সমাধানের জন্যে এক সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত সর্বাঙ্গ সুন্দর সমাজ রচনার এক মহান আদর্শ উপহার দিলেন৷ শুধু তত্ত্বই নয় এই আদর্শগত তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যেই তিনি প্রথমে চাইলেন তাঁর বহুমুখী সেবাযজ্ঞ পরিচালনার জন্যে এক উপযুক্ত স্থান৷ তখন প্রথমে টাটা-বিড়লা প্রভৃতি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রস্তাব আসে৷ যদি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর সামাজিক, অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রাউট দর্শন---যাতে পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের (অর্থনৈতিক গণতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার কথা আছে---ওটিকে ত্যাগ করে কেবল ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ওই ধরনের কোন সেবা প্রতিষ্ঠান গড়তে চান---তাহলে তার জন্যে জমি টাকা -পয়সা যা দরকার তা তাঁরা (পুঁজিপতিগোষ্ঠী) সাহায্য করতে প্রস্তুত আছে৷ তখন শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁদের এই প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘‘আমি তো নিপীড়িত মানবতার সেবার জন্যে এসেছি৷ প্রাউট ত্যাগের প্রশ্ণই উঠে না৷’’

এরপর তিনি দেশের সবচেয়ে অবহেলিত এলাকার মধ্যে অন্যতম জেলা পুরুলিয়ার, জয়পুর ও ঝালদা ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেখানে মানুষের জীবিকার কোন ব্যবস্থা নেই, অনুর্বর পাথুরে টাঁড় জমি,পাহাড়-জঙ্গল এলাকা সে স্থানটিকেই তাঁর সেবাকেন্দ্র রূপে নির্র্বচিত করলেন৷ গড়জয়পুরের রাণী প্রফুল্লকুমারী দেবী এই জায়গাটিকে আনন্দমার্গকে দান করেন৷ এই জায়গাতে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর শিষ্যদের সাহায্যে জঙ্গল ঝোপঝাড় ভরা সম্পূর্ণ পাথুরে টাঁড় জমিকে ধীরে ধীরে বাসোপযোগী করে নিজেরাই রাস্তাঘাট তৈরী করেআনন্দমার্গের প্রধান কর্মকেন্দ্র আনন্দনগরের প্রতিষ্ঠা করেন৷ মার্গগুরুদেব রেলের চাকরী ছেড়ে এখানে তাঁর আনন্দনগর নির্র্মণের কাজে তদারকির জন্যে চলে আসেন৷ সেটা ১৯৬৭ সালের ১লা জানুয়ারী৷ মার্গগুরুদেব এখানে প্রাইমারী সুকল, হাইসুকল, কলেজ, দাতব্য চিকিৎসালয় (এ্যালাপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি), কুষ্ঠাশ্রম, অন্ধ-মুক-বধির আশ্রম (আনন্দমার্গ এ্যাকাডেমি অফ লাইট), অনাথ শিশুদের লালন পালন শিক্ষা-দীক্ষার মধ্যে শিশুসদন, দূরের ছেলেদের আশ্রমে রেখে পড়াশুণার ব্যবস্থার জন্য বেশ কয়েকটি হোষ্টেল---এছাড়াও নানান ধরণের সেবামূলক ইয়ূনিট ও ছোট ছোট শিল্প গড়ে তোলার বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করলেন৷ এ অবস্থায় এই এলাকায় কম্যুনিষ্টরা প্রথমে এই আশ্রমকে তাদের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে পরে যখন দেখে আনন্দমার্গীদের আয়ত্তে আনা যাবে না, তখন তাঁরা আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে৷ এই ষড়যন্ত্রে কম্যুনিষ্টরা তাদের সমর্থক স্থানীয় বিডিও অশোক চক্রবর্তীকেও সামিল করে৷ এরপর ১৯৬৭ সালে ৫ই মার্চ দুর-দূরান্ত থেকে বিশাল গুণ্ডাবাহিনী এনে আনন্দনগর আক্রমণ করে৷ আনন্দমার্গ থেকে এই ষড়যন্ত্রের পূর্র্বভাস পেয়ে পুলিশকেও জানানো হয়েছিল৷ কিন্তু পুলিশ তখন আক্রমণকারীদেরই সহযোগিতা করে৷ বলাবাহুল্য তখন চলছিল পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্টের রাজত্ব৷ সিপিএম নেতা জ্যোতিবসু ছিলেন এই যুক্তফ্রন্টের উপমূখ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রী৷

এই পরিস্থিতিতে সেদিন বিশাল সশস্ত্র হিংস্র গুণ্ডাবাহিনীর হাত থেকে আনন্দনগরকে তথা আনন্দনগরের সুকল ও হোমের বাচ্চাদের রক্ষা করতে আনন্দমার্গের পাঁচজন সন্ন্যাসী ও সর্বত্যাগী কর্মী ---আচার্য অভেদানন্দ অবধূত,আচার্য সচ্চিদানন্দ অবধূত, অবোধ কুমার,প্রভাস কুমার ও ভরত কুমার আক্রমণকারীদের বোঝাতে গিয়ে তাদের হিংস্র আক্রমণে নিহত হন৷

আনন্দনগরে এই হিংস্র আক্রমণের মূল হোতা ছিল সিপি.এম৷ সরকার পক্ষ এই নৃশংস আক্রমণকে গণরোষ বলে প্রচার করে মামলাটিকে বাতিল করে দেয়৷ পরে সিপিএম গদিচ্যুত হলে এই মামলাটি পুনরায় চালু হয়৷ শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে আনন্দমার্গের সন্ন্যাসীদের নৃশংস খুনের দায়ে স্থানীয় বিডিও অশোক চক্রবর্তী সহ ১৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়৷ তার মধ্যে ৮জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়৷ বিচারক তার রায়ে বলেন, এ আক্রমণ ও হত্যকাণ্ডে শাসক কমিউনিষ্ট দলের মূখ্য ভূমিকা ছিল৷

পৃথিবীতে কোন মহান আদর্শের প্রতিষ্ঠা সহজে হয় না৷ দুর্নীতি পরায়ণ ও কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাদের শোষণ ব্যবস্থা টিঁকিয়ে রাখতে সবসময়েই শুভশক্তির ওপর আক্রমণ হেনেছে৷ যারা আদর্শের প্রতিষ্ঠা চান তাদেরও সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আদর্শের প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে৷

আনন্দনগর সমস্যা জর্জরিত দিশাহীন মানবসমাজের আলোক বর্তিকা৷ আনন্দমার্গের মহান আদর্শ যার নাভিকেন্দ্র আনন্দনগর---এই আনন্দমার্গ আজ সারা পৃথিবীর সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান ---সমস্ত প্রশ্ণের একমাত্র সদুত্তর---সমস্ত হতাশার একমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্বাস৷

সেদিন ১৯৬৭ সালে ৫ই মার্চ নিপীড়িত মানবতার যুক্তির আদর্শ আনন্দমার্গ প্রতিষ্ঠায় যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন৷ সেই মহান ‘দধিচীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিবছর ৫ই মার্চ তারিখটিকে দধিচী দিবস হিসাবে পালন করা হয়৷

তাই, এই ‘‘দধিচী দিবস’’ হল প্রকৃতপক্ষে জগতের কল্যাণে যারা এই আত্মোৎসর্গ করেছেন সবার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিশেষ দিন৷ এইদিন সুমহান দধীচিদের আত্মোৎসর্গ থেকে প্রেরণা গ্রহণ করে নিপীড়িত মানবতা মুক্তির জন্যে জীবনপণ সংগ্রাম করার শপথ নেওয়ার দিন৷