নীরব মোদী -পি.এন.বি কেলেঙ্কারি কি হিমশৈলের চূড়ামাত্র

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

বিগত দুই তিন সপ্তাহ ধরেই  বিশ্ববিখ্যাত হীরের গহণা ব্যবসায়ী নীরব মোদি, তাঁর সংস্থা  ও নীরবের মামা মেহুল চোক্সীর বিরুদ্ধে পি.এন.বি অর্র্থৎ পঞ্জাব ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্ককে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা প্রতারণার সংবাদে  সারাদেশ তোলপাড়৷  পিএনবির তরফে  সিবিআইয়ের কাছে নীরব মোদি , তাঁর স্ত্রী অমি, ভাই নীরল, মামা মেহুল চোক্সী ও তাঁদের অলঙ্কার সংস্থার বিরুদ্ধে প্রায় ১৮০ কোটি ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা) প্রতারণার অভিযোগ জানিয়েছে৷ সংবাদে প্রকাশ,  পিএনবির মুম্বাইয়ের ব্র্যাডি হাউস শাখা থেকে ২০১১ সালে  কোনো নিয়ম কানুন ছাড়াই ব্যাঙ্ক অফিসারদের যোগসাজসে বিরাট অঙ্কের অর্থের গ্যারান্টি বা ‘‘লেটার অফ আন্ডার টেকিং’’ হাতিয়ে নেয় নীরব মোদি ও  তাঁর সংস্থা ফায়ার ষ্টার ডায়মন্ড৷ পিএন বির এই এল .ও.ইউ দেখিয়ে   অন্যান্য ভারতীয় ব্যাঙ্কের বিদেশী শাখা থেকে ও অন্য বিদেশী ব্যাঙ্কের শাখা থেকে ধার নিয়ে তারা হীরে ও অলঙ্কার সামগ্রী ক্রয় করে৷ এইভাবেই ২০১১ থেকে২০১৭ পর্যন্ত চলছিল৷ গত ১৬ই জানুয়ারী ২০১৮ তিনটি হীরে ব্যবসায়ী সংস্থা (তিনটি সংস্থাই নীরব,অমি, নীরল ও মেহুলের মালিকানাধীন) পিএনবির কাছে আবার একই ধরণের ‘‘লেটার অফ আন্ডার টেকিং’’ পেতে অনুরোধ জানায় বিদেশে হীরের দাম মেটানোর জন্যে৷  ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এই ‘‘লেটার অফ আন্ডার টেকিং’’ দেওয়ার জন্য নগদ বন্ধক জমা দেওয়ার কথা বললে তারা জানায়, এর আগে এধরণের এল .ও.ইউ কোনো বন্ধক ছাড়াই দেওয়া হয়েছে৷  এই তথ্যের সত্যতা যাচাই ও খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখা যায় যে  ওই ব্যাঙ্কের দুই অফিসার গোকুলনাথ শেট্টি  ও মনোজ খারাট কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে সংস্থাগুলিকে এল .ও.ইউ পাইয়ে দিয়েছিলেন অথচ ব্যাঙ্কের নথিতে তার কোনো তথ্য রাখেন নি৷

প্রাথমিক তদন্তে জানা যায় যে এই জালিয়াতির ফলে পিএনবি ছাড়াও স্টেট ব্যাঙ্কসহ  আরও বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্ক বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রতারণার শিকার আর এই জালিয়াতি কান্ডের মূল নায়কেরা ইতোমধ্যে দেশছাড়া---পরিকল্পনা মাফিক ২০১৮ সালের প্রথম দিন ১লা জানুয়ারী মুম্বাই থেকে বিদেশে পাড়ি দেন নীরব মোদি, তার পাঁচদিন পরে বাক্স প্যাঁটরা সমেত ভারত ছাড়েন নীরবের স্ত্রী অমি, যিনি আবার মার্কিন নাগরিক৷  পরে পরেই বিদেশে পাড়ি দেন মামা মেহুল চোক্সী ও ভাই নীরল মোদি, যিনি বেলজিয়ামের নাগরিক৷  বিপদের গন্ধ পেয়ে তারা আর এদেশে আসার নাম করছেন না৷  শুধু তাই নয়, দাভোসে  ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে গত ২৩শে জানুয়ারী ২০১৮ প্রধানমন্ত্রী  নরেন্দ্র মোদি শিল্পমহলের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে  যে ছবি তুলেছিলেন, সেই ছবিতে  প্রধানমন্ত্রীর পিছনের সারিতে  হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিলেন নীরব মোদি৷  এই পরিস্থিতিতে নীরব মোদি ও তার সহযোগিরা ঠিক কোথায় বা কোন্ দেশে রয়েছেন  সে সম্পর্কেও ধোঁয়াশা যথেষ্ট যা পরিস্কার হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে৷  পিএনবি কর্তৃপক্ষ ও সিবিআই কয়েক দফা এফ.আই.আর করেছে৷  ব্যাঙ্কের তরফে ও সিবিআই ইডির নানারকম তদন্ত চলছে৷ নীরবদের ধরতে লুকআউট নোটিশ জারি হয়েছে, ব্যাঙ্কের বেশ কয়েকজন আধিকারিক -কর্মী - অবসর প্রাপ্ত আধিকারিক গ্রেপ্তার হয়েছে, নীরব মোদি- মেহুল চোক্সীদের সংস্থার বিপণি, বাড়ী-গাড়ী, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট,শেয়ারপত্র, সম্পত্তি, ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করা চলছে৷ তবে এখনও পর্যন্ত যেসব স্থাবর--অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে তার বাজার মূল্য প্রকৃত প্রতারণা অঙ্কের তুলনায় নস্যি মাত্র৷ কিন্তু আসল অপরাধীরা  সুযোগ বুঝে বা পরিস্থিতি অনুধাবন করে দেশ থেকে হাওয়া৷  তারা বিদেশে পাচার করা  বিপুল সম্পত্তি ও ব্যবসা কাজে লাগিয়ে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷

এখন প্রশ্ণ হলো,এতবড়ো একটা কেলেঙ্কারী  যার সঙ্গে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা জড়িত--- সেটা কোনো দু’এক জন ব্যাঙ্ক আধিকারিক বা কর্মীর পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়৷ তারা হয়তো বিষফোঁড়ার মুখ হতে পারেন কিন্তু এর বিস্তার আরও গভীরে৷ উপরমহলের নির্দেশ , প্রশ্রয়, সচেতনভাবে দেখেও না দেখার ভান  কিংবা অপদার্থতা না থাকলে ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খেপে খেপে এই বিশাল অঙ্কের জালিয়াতির জাল  বিস্তৃত হতে পারে  না৷  এই সময়কালের মধ্যে বহুবার ব্যাঙ্কের  নিজস্ব নিরীক্ষা Internal Audit) , বহির্বিভাগীয়  নিরীক্ষা External Audit),RBI Audit    ইত্যাদি সম্পাদিত হয়েছে৷  আর এতগুলি পরীক্ষা নিরীক্ষার পরেও এত বড় একটা অঙ্কের  বিষয় অদেখাই রয়ে গেল- এটি  সর্বৈব অবিশ্বাস্য ব্যাপার৷ শুধু তাই নয়,  সংবাদে প্রকাশ --- এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন মনোনীত ডিরেক্টর  শ্রী দীনেশ  দুবে ২০১৩ সালে  অর্থ মন্ত্রককে মেহুল চোক্সীর বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন৷  তা সত্ত্বেও  এলাহাবাদ ব্যাঙ্কে তার ঋণ মঞ্জুর করা হয়৷ শ্রী দুবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কেও এ সম্পর্কে অভিযোগ জানান৷ এছাড়াও বৈভব খুড়ানিয়া,  দিগ্বিজয়  সিংহ জাদেজারা২০১৫ সাল থেকে নীরব-মেহুলদের বিরুদ্ধে প্রধান মন্ত্রীর দফতরে (পি.এম.ও) লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন৷  ব্যাঙ্গালুরুর ব্যবসায়ী  হরিপ্রসাদও ২০১৬ সালে মেহুলের বিরুদ্ধে  পিএমও-তে অভিযোগ জানান৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্কও জানিয়েছে--- প্রয়ুক্তির ব্যবহার করে  এমন দুর্নীিিত যে ঘটতে পারে, ২০১৬ সালেই দেশের ব্যাঙ্কগুলিকে এই বিষয়ে তারা সতর্ক করেছিল৷ কিন্তু তারপরেও গত দেড়বছর ধরে  এই জালিয়াতি চলেছে৷  ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অধিকাংশ এল.ও.ইউ-র জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে বলে সংবাদে প্রকাশ৷  এই পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার পক্ষ  বয়ান দিচ্ছেন, ইউ.পি.এ সরকারের আমলে জালিয়াতি শুরু, তাই এর দায়ভার ইউপিএ জমানার  ৷  অপরপক্ষ বলছে,  জালিয়াতির বাড় বাড়ন্ত ২০১৫-২০১৬ থেকে  তাই বর্তমান সরকারই প্রকৃত দোষী৷

রাজনৈতিক চাপান-উতোরকে  একপাশে সরিয়ে রেখে এটা বলাই যায়,  যেকোনো ঋণ বা জালিয়াতি কোন একটা সময়ে শুরু হয়  ও কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, একশ্রেণীর কর্মীর দুর্নীতি,  অপদার্থতার সুযোগে  তা বাড়তে থাকে৷ এই ধরণের জালিয়াতি সম্পর্কে কোন রকম সংবাদ পাওয়ার বা সন্দেহ হওয়ার  সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব বুদ্ধি প্রয়োগ করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কমানো যায় আর এই দায়িত্ব  সেই সময়কালীন সবপক্ষেরই৷ অর্থমন্ত্রী এই কেলেঙ্কারীর সব দোষ  রিজার্ভ ব্যাঙ্ক,  অডিটারকুল  ও ব্যাঙ্ক কর্মীদের উপর চাপিয়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে জানিয়েছেন, প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে যা একটি গতানুগতিক বয়ান ছাড়া কিছুই নয়৷ কিন্তু প্রশ্ণ হচ্ছে---ব্যবস্থাটি কখন নেওয়া হবে ও কিভাবে? নীরব মোদি অ্যান্ড কোম্পানি দেশ ছেড়ে উধাও৷  এর আগে বিজয় মাল্য ব্যাঙ্কগুলির প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা  শোধ না করে বিদেশে হেসে খেলে বেড়াচ্ছেন৷ ললিত মোদি আইপিএল কেলেঙ্কারীতে অভিযুক্ত হয়ে  বিদেশে ফেরার৷ কয়েকদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে রোটোম্যাক কর্র্ত বিক্রম কোঠারির ৩,৬৯৫ কোটি টাকার ঋণ খেলাপের সংবাদ৷  বিক্রম কোঠারি ও তাঁর ছেলেকে গ্রেফতারও করা হয়েছে৷ এছাড়াও বাজারে যে নয় লক্ষ কোটি ব্যাঙ্কের অনাদায়ী অনুৎপাদক সম্পদ বিস্তৃত রয়েছে তাঁর ৯০ শতাংশই বড়ো বড়ো কর্পোরেট সংস্থার নামে---যার কেলেঙ্কারী হয়তো ক্রমশঃ প্রকাশ্য৷ পরবর্তীকালে  আরও বিপুল পরিমাণ বড় বড় কর্পোরেট ঋণ  থেকে  ঋণ খেলাপের ও জালিয়াতির সংবাদ শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা৷  অথচ ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা সত্যিকারের প্রয়োজনে  ৪/৫ লক্ষ টাকা ঋণ পেতে জুতোর শুকতলা ক্ষইয়ে ফেলছেন,  সময়ে কৃষিঋণ না পেয়ে চাষবাস  ও জীবিকা ধবংস প্রাপ্ত হচ্ছে,  কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ আর বড় বড় কর্পোরেট হাউস ব্যাঙ্কের ঋণ খেলাপ করেও  বুক ফুলিয়ে ফুটানি মেরে চলেছে৷ এইসব ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারী প্রতারণা রুখতে গেলে  সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন মেনে চলা, সতর্ক নজরদারী , প্রচলিত আইনকে সঠিকভাবে প্রয়োগ ও  প্রয়োজনে আরও কঠোর আইন বলবৎ করে জনগণের স্বার্থে ব্যাঙ্কঋণ শোধের ব্যবস্থা করা  ব্যাঙ্কগুলি ও সরকারের অবশ্যকর্তব্য৷

বিশেষজ্ঞদের মতে,  ব্যাঙ্কের এই দুরবস্থার জন্যে  অনেকগুলি কারণের মধ্যে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গলদই প্রধানতঃ দায়ী৷ বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি  পুঁজিবাদী ও বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত৷ কোনো কোনো দেশ  সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ-এর বুলি আওড়ালেও  প্রকৃত পক্ষে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারক ও বাহক৷ আমাদের দেশ ভারতবর্ষও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়৷ এদেশের অর্থনীতিও বৃহৎ পুঁজিপতি ও শিল্পপতি সংঘটনগুলির  নির্দেশক্রমেই চালিত হয়৷  ভোটের রাজনীতি ও বিশাল নির্র্বচন ব্যয় সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দলগুলি ( বাম-ডান--মাঝারি-সবদলই) বাট পাড়িয়া, চোরপুরিয়া, ডাকুমল, ভেজালদারিয়া ইত্যাদি গোত্রের পুঁজিবাদীদের শরণাপন্ন হয় আর নির্র্বচন শেষে যেদলই শাসনযন্ত্র পরিচালনা করুক, তারা এইসব পুঁজিপতিদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে সচেষ্ট থাকে৷ ফলে সমাজ জীবনে  নৈতিকতা বা নীতিবাদের ক্রমশঃ বিলীয়মান অবস্থা৷ সমাজ চালিত হয় অর্থশক্তি ও পেশিশক্তির দ্বারা আর  রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে৷ প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির রমরমা৷  মুনাফার জন্য যেকোনো অনৈতিক কাজকর্ম করতে মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত হয় না--- যার পরিণামে বাজারের কোনো জিনিসই ভেজালহীন নেই৷ খাদ্য, পানীয়,বস্ত্র, ঔষধপত্র, নির্র্মণ সামগ্রী ইত্যাদি জীবনধারণের সব ক্ষেত্রেই ভেজাল ও দূষণের জয় জয়কার৷ মানবিক ও নৈতিক অবমূল্যায়ণই আজকের এই ভয়ঙ্কর অবস্থার জন্য দায়ী৷  সৎ, ধার্মিক, নীতিবাদী মানুষেরা পদে পদে নির্র্যতিত, নিপীড়িত, শোষিত৷  সততা ও উদারতা দুর্বলতার নামান্তর৷ অপরপক্ষে দুর্নীতিবাজ, জালিয়াতির কারবারী ও বাহুবলীরা সমাজে উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত৷ তাদের অঙ্গুলি হেলনে প্রশাসন-সমাজ পরিচালিত হওয়ায় মানবিক সংবেদনশীলতা, প্রেমপ্রীতি , ভালবাসা,  ত্যাগ, সেবা , তিতিক্ষা ইত্যাদি শুভ গুণাবলীর  গঙ্গাযাত্রা৷  ফলশ্রুতিতে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রাষ্ট্রশক্তির অপচয় আর জনসাধারণের দুর্ভোগ ও শোষণই আজকের বাস্তবতা৷

এখন দেখা যাক,  এই ধরণের বিরাট আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলির  প্রভাব কতদূর৷  পিএনবি কর্তৃপক্ষ  বলছেন এই ধাক্কা সামলাবার মতো শক্তি ও সংস্থান তাঁদের আছে৷ ইতোমধ্যেই শেয়ার বাজারে এই জালিয়াতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, শেয়ারসূচক নিম্নগামী হয়েছে৷ পিএনবিসহ বিভিন্ন ব্যাঙ্কের  শেয়ারমূল্যের অধোগতি হয়েছে---  যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে জনগণের ওপর যারা  গাঁটের পয়সা খরচ করে শেয়ারে লগ্ণি করে ছিলেন৷ জালিয়াতির খেসারতের অর্থ বা অনাদায়ী ঋণ ও অনুৎপাদক  সম্পদের জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে লভ্যাংশ থেকে টাকা কেটে রাখতে হয় যার ফলে নীট লাভের পরিমাণ কমে যায়৷  আর লাভ কমার কারণে  ব্যাঙ্কের শেয়ার হোল্ডাররা ডিভিডেন্ড কম পান ও আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হন৷ এছাড়া ব্যাঙ্কগুলির ক্ষতি সামলানোর জন্যে  অর্থমন্ত্রক যে বিপুল পরিমাণে অর্থ  সংস্থান করে ও ব্যাঙ্কগুলিকে খয়রাতি দেয় তার মূল কারণ বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর অনাদায়ী ঋণ, ঋণ খেলাপ ও জালিয়াতি৷  আর এই অর্থ আসে সাধারণ মানুষের করের টাকায়৷ অর্থাৎ বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থার অনৈতিক কাজকর্মের দায়ভার বহন করতে হয় লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে৷ অপরপক্ষে সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য সংগৃহীত করের  টাকা উন্নয়নের পরিবর্তে অন্যখাতে ব্যয়িত হলে প্রকৃত পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হন দেশের জনগণ৷ ব্যাঙ্কগুলি সাধারণ গ্রাহককে যে ছোট ছোট ঋণ দান করে, তার সুদের হার ও নিয়মাবলী ঠিক করে ব্যাঙ্ক আর ব্যাঙ্কের শর্তেই সেই ঋণ মঞ্জুর করা হয়৷ যুক্তিগ্রাহ্য কারণেও এই নিয়মকানুনের বিচ্যুতি হলে সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের  হরেকরকম হয়রানির সম্মুখীন হতে হয় ও ঘটি-বাটি, জমি-জমা-বাসস্থান বিক্রয় করে ঋণ পরিশোধ করতে হয়৷ কিন্তু বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীদের  শতশত বা হাজার কোটি টাকা ঋণদানের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ককর্তৃপক্ষকে ঋণগ্রহীতা কর্পোরেট সংস্থার শর্তে কমসুদে (সুদ কম নেওয়ার  ও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে) ঋণ দিতে হয়৷  এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব তথা চাপও যথেষ্ট থাকে বলেই তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ধারণা৷

এইসব জালিয়াতি, ঋণ খেলাপী ও  অনুৎপাদক ঋণের খাতে অর্থসংস্থান করতে গিয়ে ব্যাঙ্কগুলির হাতে পরবর্তীকালে ঋণদানের জন্যে যথেষ্ট অর্থ না থাকার কারণে ও  সেই অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে  আমানতকারীদের জমারাশির উপর  প্রদত্ত সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হয়৷  তাই বিভিন্ন মেয়াদী জমা ও সেভিংস ব্যাঙ্কে  প্রদত্ত সুদের হার  ক্রমশঃ নিম্নাভিমুখী, স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে, পিপিএফ, ইপিএফ ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রেও সুদের পরিমান নিয়ম করে কমানো হচ্ছে৷ কয়েকদিন আগেও এই সুদ কমেছে৷  এরফল ভুগতে হয় সাধারণ মানুষকে ৷ এর সঙ্গে জনগণের মাথায় এফ.আর.ডি. আই-বিল  খাঁড়ার মতো ঝুলছে যার বেইল-ইন ব্যবস্থা ও  ব্যাঙ্কে জমারাশি ফিরে না পাওয়ার আশঙ্কা আপামর জনসাধারণকে আতঙ্কিত করে রেখেছে৷ এরফলে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার প্রতি  জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ক্রমাগত কমে চলেছে যা শুরু হয়েছে নোট বন্দির সূচনার পর থেকেই৷  হয়তো প্রশাসনও চাইছেন জনগণ ধীরে ধীরে ব্যাঙ্কের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে  শেয়ার বাজার মুখী হন৷ কিন্তু এতে জনগণের সম্পত্তির ঝঁুকি ও নিরাপত্তাহীনতা  ভীষণভাবে বৃদ্ধি পাবে-আর এই অবস্থা কোনো কল্যাণকামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়৷ সঠিকভাবে বিচার করলে বোঝা যায় যে, এসবই হচ্ছে পুঁজিবাদী,মুনাফা সর্বস্ব অর্থনীতির কুফল৷ এর হাত থেকে রেহাই পেতে হলে ব্যষ্টিগত মুনাফাবাজির পথ পরিহার করে সমবায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থব্যবস্থা চালু করতে হবে যাতে  সাধারণ মানুষের  সার্বিক ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়৷ আর এর একমাত্র সমাধান রয়েছে মহান দার্শনিক ঋষি শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত ‘প্রাউট’(PROUT) এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়৷ প্রাউটে পৃথিবীর সমস্ত সম্পদে সকল মানুষের সমানাধিকার স্বীকৃত ৷ কোনো ব্যষ্টি সামবায়িক সংস্থার অনুমোদন ব্যতিরেকে ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না৷  প্রাউট অর্থনীতি ও সমাজনীতির মূল উপাদান হচ্ছে সমবায়৷  আর সমবায়গুলি পরিচালিত হবে কঠোর নীতিবাদী, আপোষহীন, স্বার্থত্যাগী,সৎ ব্যষ্টিবর্গের দ্বারা৷ নীতিবাদের ভিত্তিভূমি হলো আধ্যাত্মিকতা৷ বর্তমান সমাজে অর্থপিশাচ পুঁজিবাদীদের সঙ্গে নীতিহীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দুষ্টচক্র বিনাশ করে জনগণের প্রকৃত উন্নতি বিধান করতে হলে আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক প্রাউট দর্শনের প্রতিষ্ঠাই একমাত্র উপায়৷ নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা মিলে ‘প্রাউট’-এর নীতি অনুযায়ী স্থানীয় স্তরে  অর্থাৎ ব্লকভিত্তিক  বনজ, খনিজ, কৃষিজ, মানব ও মেধা সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শতকরা একশত ভাগ কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করবে ও সমস্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে৷ এই উদ্দেশ্যে উৎপাদন সমবায়, উপভোক্তা সমবায়, কৃষি সমবায় ইত্যাদি গড়ে উঠবে যার  পরিচালনায় থাকবেন কঠোর নীতিবাদী , মানবতাবাদী, নিঃস্বার্থপর ব্যষ্টিগণ৷  শুধুমাত্র যেসব শিল্প স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়-যেমন বৃহৎ লৌহ ইস্পাত শিল্প, রেল সম্পর্কিত শিল্প ইত্যাদি  রাষ্ট্রের পরিচালনায় থাকবে৷ এইভাবে স্থানীয় স্তরে পূর্ণ কর্মসংস্থান ও ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মধ্যবর্তী ফড়ে ও মুনাফাবাজদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে৷ আর একটি সুন্দর শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে৷ তাই বর্তমান পৃথিবীতে শোষণ ও ধনী-দরিদ্রের দুস্তর ব্যবধান  দূর করতে , সমস্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্যের দুরারোগ্য ব্যাধির নিরসনে একমাত্র মকরধবজ ‘প্রাউট’ দর্শনের প্রতিষ্ঠাকল্পে আজকের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নীতিবাদী মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে ও শোষণহীণ মানবসমাজ রচনাকে ত্বরান্বিত করতে হবে৷  এ ভিন্ন মানব-শোষণ মুক্তির  আর কোন পথ খোলা নেই৷