নোতুন বৎসর শুভ হোক–কল্যাণদায়ী হোক - অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু

সংবাদদাতা
নিজস্ব সংবাদদাতা
সময়

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সবই দেশ–কাল–পাত্রে আধৃত৷ কাল জিনিসটা কী? –না, কাল হচ্ছে ক্রিয়ার গতিশীলতার ওপর মানসিক পরিমাপ (Mental measurement of motivity of action)৷ দেশ আছে–সে চক্রাকারে বিবর্তিত হয়ে চলেছে৷ সেই বিবর্তনকে মেপে চলেছে মন৷ সেই মাপাটার নাম কাল৷ ব্যাপকভাবে এই কালকে বলব মহাকাল আর তার খণ্ডগত হিসেবকে বলব কাল৷ দেশগত বিবর্ত্তন না থাকলে কাল থাকে না৷ অর্থাৎ দেশ–পাত্র রহিত কাল হয় না৷

আমরা কথা বলতে গিয়ে অনেকে ‘অনাদি কাল’ বলি, ‘অনন্ত কাল’ বলি৷ সেটা ব্যাপকতা ৰোঝাবার জন্যে৷ কিন্তু যখন এই পৃথিবী ছিল না, যখন এই পৃথিবীতে মানুষ ছিল না, তখন কালের কোন পরিমাপের ব্যবস্থা ছিল না৷ পরিমাপক না থাকায় কালও ছিল না৷ তবে এই পৃথিবীটাও তো সব কিছুই নয়, বিশ্ব–ব্রহ্মাণ্ডে আরও অনেক এই রকমের গ্রহ আছে, অনেক তারাও আছে৷ সেখানে মানুষ আছে আর যেখানে নেই ভবিষ্যতে থাকবে৷ সুতরাং কোথাও না কোথাও কাল ছিল৷ সমষ্টিগত কালকে বলি মহাকাল৷

আমাদের এই পৃথিবীতে কাল কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? চন্দ্রের হিসেবে ও সূর্যের হিসেবে৷ পৃথিবীকে স্থির ধরে সূর্য ঘুরছে এরকম মনে করে যে গণনা তাকে বলি সোলার সিষ্টেম–সৌর বর্ষ, সৌর পরিমাপ আর পৃথিবী স্থির আছে, চাঁদ ঘুরছে এই ধরে চান্দ্র পরিমাপ৷ আজ  আমাদের যে আন্তর্জাতিক নববর্ষ (ইন্টারন্যাশন্যাল নিউ ইয়ার্স ডে) এটা হ’ল সৌর পরিমাপ৷ এক কালে মার্চ মাস থেকে এর গণনা হত৷ মার্চ ছিল প্রথম মাস৷ সে বিচারে সেপ্ঢেম্বর ছিল সপ্তম, অক্টোবর অষ্টম, নবেম্বর–ডিসেম্বর নবম–দশম, জানুয়ারী একাদশ ও ফেব্রুয়ারী ছিল দ্বাদশ মাস৷ সেপ্ঢেম্বর–লাতিনে ‘সেপ্ঢ’ (sept) মানে সাত অক্টো (octo)  মানে আট, নোবা (nova) মানে নয়, ডিসে (dece) মানে দশ৷

পরবর্তীকালে রোমের রাজাদের চেষ্টাতেই গণনা পদ্ধতি পরিবর্তন করে জানুয়ারী থেকে গণনা শুরু হয়৷ সে গণনাও বেশ কিছুকাল চলে৷ কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে ফেব্রুয়ারী মাসটাকে নিয়ে৷ তখন ঠিক করা হ’ল যে প্রতি চার বৎসরে লিপ্ ইয়ার (leap year) করে দিয়ে হিসেবটাকে মানিয়ে নেওয়া হবে৷ যেমন ৰাংলাতেও করা হ’ল–পুরোনো হিসেব ছেড়ে দিয়ে পরে জয়ন্ত পাণিগ্রাহী নোতুন ৰাংলা হিসেব প্রচলন করেন৷ তেমনি নোতুন এই যে আন্তর্জাতিক হিসেব এও অনেক দিন ধরে চলছে৷ এও একটা কাল৷ অর্থাৎ ক্রিয়ার গতিশীলতার মানসিক  পরিমাপ৷

মানুষই মাপতে শিখল৷ এখন যে মানুষ মাপছে, সেই মানুষই চলছে, খাচ্ছে, সুখে হাসছে, ব্যথায় কাঁদছে৷ তার এই হাসা, তার এই কাঁদা, তার এই চলা, তার এই এগিয়ে চলা, তার হাঁটু ভেঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া সব কালের সঙ্গে সম্বন্ধিত৷ তাই কালবর্জিতভাবে কোথাও কেউ নেই৷ যদিও সেই গণনাটা মানুষের মানসিকতার দ্বারাই হয়ে চলেছে৷

 নোতুন বৎসর এল৷ এ গণনাটা মানুষই করেছে৷ আবার এই হিসেবের ভেতরে মানুষকে চলতে হবে, হাসতে হবে, কাঁদতে হবে, সুখ–দুঃখ–ব্যথা–বেদ্ নিয়ে অনেক কিছুই করতে হবে৷ তাকে সমাজকে নোতুনভাবে গড়তে হবে, অনেক গড়া জিনিসকে ভেঙ্গে আরও নোতুনভাবে গড়তে হবে, কত কিছুই না করতে হবে৷

আমি আশাবাদী৷ আমি জানি, পরমপুরুষ যা করেছেন, তা অপূর্ণ থেকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে •Human movement is a movement from imperfection towards perfection. So for everything, for anything and everything, for this universe, each and every person should be optimist.— ছোট বড় প্রতিটি ব্যাপারে প্রতি পদবিক্ষেপে প্রতিটি মানুষকে আশাবাদী হতে হবে৷ আমি মানুষকে আশার গান শুণিয়ে এসেছি, শুণিয়ে যাব৷ কারণ আমি জানি, যার লক্ষ্য সম্পূর্ণতার দিকে তার জয় অবশ্যম্ভাবী৷

আমি আশা করব, এই বৎসর যারা ধর্মৰুদ্ধিপ্রেষিত হয়ে এ পৃথিবীতে চলছে, তাদের পক্ষে এ বৎসর শুভ হবে–জয়ের বৎসর হবে৷ আনন্দে তাদের মুখ উজ্জ্বল হবে–উল্লসিত হবে৷ আমি আশা করব, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত  মানবাত্মা যারা কেঁদে চলেছে অথচ তাদের চোখের জল মোছাবার কেউ নেই, এই বৎসর তাদের চোখের জল মুছিয়ে দেবে৷

আমি আরও আশা করব, যে দানবেরা মানুষকে কাঁদাচ্ছে, মানুষকে অশেষ ভাবে নির্যাতনের ভেতর নিয়ে যাচ্ছে, যে দানবেরা মানুষকে সব সময় দাসত্বের শৃঙ্খলে আক্ষদ্ধ করে রাখতে চাইছে, এ বৎসর তাদের কাছে কাল বৎসর রূপে গণ্য হবে৷ আমি চাই, তোমরা হাসতে হাসতে এগিয়ে যাও, তোমরা হাসতে হাসতে ডিউটি করে যাও, তোমরা হাসতে হাসতে অন্যের চোখের জল মুছে দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোল৷

(১৯৮০ সালের ১লা জানুয়ারী ‘আন্তর্জাতিক নববর্ষ’ উপলক্ষ্যে প্রদত্ত প্রবচন৷)