নোতুন সকালের প্রতীক্ষায়......

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

২০১৪ সনের পর ২০১৯---ভারতীয় গণতন্ত্রের এক সুদীর্ঘ নির্বাচন পর্বের অবসানে গত ২৩ মে প্রকাশিত ফলাফলের নিরিখে এন.ডি.এ-র নেতা হিসেবে শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় বার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ জয়লাভ করলেন ও প্রধানমন্ত্রী রূপে শপথ গ্রহণ করেছেন৷ গত দুই মাসাধিক কাল ধরে যে নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীগণ যুক্ত ছিলেন, তাঁদের বক্তব্য-বত্তৃণতায় গুটিকতক খয়রাতিমূলক অনুদান বিতরণের প্রতিশ্রুতি ছাড়া প্রকৃত উন্নয়নমুখী কর্মসূচীর বিশেষ উল্লেখ ছিল না৷ দলীয় ইস্তাহারগুলিতেও ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের গড়পরতা ঘোষণা ব্যতীত বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি৷ এত বড় একটা দেশের শাসনভার যারা পেতে চাইছেন তারা গত পাঁচ বছরে কী কী কাজ করলেন, আগামী দিনে ঠিক কী পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে চাইছেন---সে বিষয়ে কিছু ভাসা-ভাসা কথাবার্তাতেই তাঁদের বক্তব্য ছিল সীমাবদ্ধ৷ বরং একপক্ষ অপর পক্ষের নেতা-নেত্রীদের ব্যষ্টিগত আক্রমণ, কুৎসা, অকথা-কুকথার প্রয়োগ ইত্যাদিতেই বেশী ব্যস্ত ছিলেন৷ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন দলের কর্মীদের মধ্যে বচসা, মারামারি, হিংসা, সন্ত্রাস হয়েছে---আবার নির্বাচনোত্তর কালেও সেই হিংসা, অশান্তি, সন্ত্রাস বেড়েই চলেছে৷ জয়ী নেতা-নেত্রীগণ  সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, ভাগ্যবানেরা মন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করেছেন---আর হিংসা-সন্ত্রাসের আগুনে পুড়ে মরছেন সাধারণ মানুষজন৷ যে দলের যেখানে জোর বেশী তারা অপর পক্ষের দলীয় অফিস দখল করছে, নতুবা ঘরবাড়ী ভাঙ্গচূর, অগ্ণিসংযোগ ইত্যাদি অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে৷ এই সাময়িক উত্তেজনা, উস্কানি, রেষারেষি হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই থিতিয়ে যাবে কিন্তু যাদের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে যাচ্ছে---এগুলির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের দল৷ আমরা, দেশবাসীগণ, যদি একটু সচেতন হই, উস্কানি, উত্তেজনার গড্ডালিকা প্রবাহে যদি না ভেসে যাই, তবে আখেরে লাভ হবে দেশ ও দেশবাসী উভয়েরই, বাঁচবে মানুষ, দেশের সম্পদ ও সম্পত্তি৷

২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ছিল একদিকে নোটবন্দী পরবর্তী ভারতীয় অর্থনীতিতে দারুণ বিপর্যয়, শিল্প-কৃষি সহ সব ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির ক্রমাবনতি, কর্ম সংস্থানের অভাব, বেকারত্বের বৃদ্ধি, কর্ষক আন্দোলন, শ্রমিক অসন্তোষ ইত্যাদি---অন্যদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাত-পাত-ধর্মমতের মেরুকরণ, গোহত্যা-গো-মাংস ভক্ষণ সম্পর্কিত হিংসা, ভয় ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশ, বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার করে মেকী অহংবোধের বহিঃপ্রকাশ৷  নোট বন্দীর ফল হিসেবে বিভিন্ন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ্গণের পক্ষ থেকে আর্থিক বৃদ্ধি হ্রাসের ও কর্ম সংস্থানের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল---প্রথমে সরকার পক্ষ অস্বীকার ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করলেও পরবর্তীকালে তার সত্যতা প্রমাণিত হয়৷ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী আর্থিক বৃদ্ধির হার ২০১৪-১৫ সনে ৭.৫ শতাংশ, ২০১৫-১৬ সনে ৮.০ শতাংশ, ২০১৬-১৭ সনে ৭.১ শতাংশ, ২০১৭-১৮ সনে ৭.২ শতাংশ, ২০১৮-১৯ সনে ৬.৮ শতাংশ অর্থাৎ ২০১৮-১৯ সনের বৃদ্ধি গত পাঁচ বছরে সর্বনিম্ন৷ শুধু তাই নয়, ২০১৮-১৯-এ চারটি ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৮.০ শতাংশ, ৭.০ শতাংশ, ৬.৬ শতাংশ ও ৫.৮ শতাংশ, অর্থাৎ ২০১৯-এর জানুয়ারী থেকে মার্চে বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন ৫.৮ শতাংশ৷ এছাড়া সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬-র নোটবন্দীর পর ২০১৭-১৮ সনের বেকারত্বের হার ৬.১ শতাংশ, যা ভারতবর্ষের ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ দেশের যখন এই অবস্থা তখন শুধুমাত্র জাত-বর্ণ-ধর্মমতের মেরুকরণ আর উত্তেজক শ্লোগান সহ বত্তৃণতার বাগাড়ম্বর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কোনও উপকারে লাগবে না৷

যাই হোক, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ইতোমধ্যে নিজ নিজ দায়িত্বে বহাল হয়েছেন৷ মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে যে, সব চাষীদের ছয় হাজার টাকা করে ভর্তুকি দেওয়া হবে৷ এছাড়া চাষী ও দোকানদারদের জন্যে পেনশন প্রকল্পের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ অর্থাৎ সেই খয়রাতি-দানছত্রের ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি৷ পরবর্তীকালে হয়তো এই ধরণের আরও প্রকল্প ঘোষিত হবে৷ কিন্তু যাদের জন্যে এই প্রকল্পগুলি রচিত হয়, তাদের কাছে দলমত নির্বিশেষে নিরপেক্ষভাবে সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার সুব্যবস্থা না হলে প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়৷ শুধু তাই নয়, সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সুসংবদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ না করে দান খয়রাতির মাধ্যমে জনগণের স্থায়ী কল্যাণসাধন অসম্ভব৷ এর জন্যে অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ সর্বাগ্রে প্রয়োজন৷ এই উদ্দেশ্যে প্রথম শর্ত হ’ল, আঞ্চলিক স্তরে স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘটন৷ স্থানীয় সম্পদের সর্বাধিক উপযোগের জন্যে ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তৃণমূলস্তরে এই ধরণের অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘটন করতেই হবে৷ এর ফলে স্থানীয় মানুষের একশত শতাংশের কর্মসংস্থানের সুনিশ্চিততা ও বেঁচে থাকার জন্যে নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির ব্যবস্থা করা যাবে৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগে স্থানীয় সম্পদের পরিমাণ ও মান বৃদ্ধির দ্বারা জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে৷  সমগ্র ব্যবস্থাটি পরিচালিত হবে উৎপাদক সমবায় ও উপভোক্তা সমবায়ের মাধ্যমে যার নেতৃত্বে থাকতে হবে আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত কঠোর নীতিবাদীগণকে৷ ফলে কোনরকম মধ্যস্বত্ত্বভোগী বা ফড়েদের দ্বারা সাধারণ মানুষের বঞ্চিত বা শোষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না৷ কৃষি ও শিল্প উভয়ই এই পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে৷ শুধুমাত্র বৃহৎ শিল্পগুলি স্থানীয় সরকারের পরিচালনাধীন থাকবে আর অতি ক্ষুদ্র শিল্পগুলি ব্যষ্টিগত পরিচালনায়৷ কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের মধ্যেও সন্তুলন বজায় রাখতে হবে৷

নব-নিযুক্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী শ্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্কের হাতে প্রাক্তন ইসরো চেয়ারম্যান কে. কস্তুরীরঙ্গন কমিটির তৈরী নূতন শিক্ষানীতির খসড়া জমা পড়েছে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য হ’ল দেশের সমস্ত বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হিন্দী বাধ্যতামূলক করা৷ দক্ষিণী রাজ্যগুলি ও পশ্চিমবঙ্গের মত অহিন্দীভাষী রাজ্যের পক্ষ থেকে এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে৷ প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে, এটি একটি খসড়া রিপোর্ট মাত্র আর এই রিপোর্ট সম্বন্ধে শিক্ষাবিদ্গণ ও রাজ্যগুলির মতামত যাচাইয়ের পর কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে হিন্দী ভাষার প্রসারে আগ্রাসী ভূমিকা প্রদর্শন৷ তাই হিন্দী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙলা সহ অন্যান্য অহিন্দীভাষী রাজ্যের জনগণ জোটবদ্ধ হয়েছেন৷ বাঙলা ও অন্যান্য রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরাও এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন৷ সাধারণতঃ কোন মানুষই তার মাতৃভাষার অবদমন মেনে নিতে পারে না৷ মাতৃভাষা হ’ল মাতৃদুগ্দের সমান৷  কোন ভাষার অবদমন হলে সেই ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে হীনন্মন্যতা, ভীতন্মন্যতা ও সাংসৃকতিক অবক্ষয় দেখা দেয়৷ ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ে৷ ভারতবর্ষ যখন ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল, তখন থেকেই দেশের বিভিন্ন ভাষা, বিশেষতঃ বাংলা ভাষাকে অবদমনের অপচেষ্টা চলেছে৷ কারণ ব্রিটিশ প্রশাসকেরা বুঝেছিল যে বাঙালী অত্যন্ত বুদ্ধিমান, সমাজ সচেতন ও সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন জাতি৷ সুতরাং তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বাঙলার সংসৃকতিকে নষ্ট করে দেওয়া৷ আর সে জন্যেই তারা তৎকালীন শিক্ষা পদ্ধতিতে দ্রুত ইংরেজী ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এক শ্রেণীর মেকী ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজ তৈরী করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল যাতে নব্য -ইংরেজদের বশংবদ হিসেবে ব্যবহার করে বঙ্গ সংসৃকতিকে ধবংস করার পথ প্রশস্ত হয়৷ ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে দেশের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের সাথে সাথে অহিন্দীভাষী অঞ্চলের নিজস্ব সংসৃকতি, ঐতিহ্য নষ্ট করার ধারাবাহিকতার উত্তরাধিকারও হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে হস্তান্তরিত হয় ও তারা এই কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে৷

ভারতবর্ষ বহু ভাষা, ধর্মমত, ঐতিহ্য সংসৃকতি সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর বাসভূমি ও বিভিন্ন রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি যুক্তরাষ্ট্র৷ তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ও অন্যান্য রাজ্য সরকারগুলির যথাযথ সম্মান প্রদর্শন সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব৷ এই কারণেই সাম্প্রতিক নির্বাচনপূর্ব দলাদলি, রেষারেষি, ব্যষ্টিগত মর্যাদাহানিকর কার্যকলাপ, কটূক্তি ইত্যাদিকে ভুলে গিয়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও অন্যান্য রাজ্য প্রশাসনের নেতৃবৃন্দকে সুসম্পর্ক ও সুসমন্বয়ের মাধ্যমে জনকল্যাণের সাংবিধানিক কর্তব্য পালনে অবশ্যই তৎপর হতে হবে৷ কেন্দ্র বা রাজ্যের কোষাগারে যে অর্থ আসে তা কোন দল বা নেতা-নেত্রীর ব্যষ্টিগত সম্পত্তি নয়---দেশের জনসাধারণের প্রদত্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর হিসেবে সংগৃহীত ধনরাশি৷ এই অর্থ যাতে সমগ্র দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ও জনকল্যাণে ব্যয়িত হয় সেদিকে সতর্কতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে লক্ষ্য রাখা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবশ্যকর্তব্য৷ পরমপিতার দান এই বিশ্বের সমস্ত সম্পদ সব মানুষের যৌথ সম্পত্তি৷ সেই সম্পদকে সকলের মেধা, শ্রম ও প্রযুক্তির দ্বারা সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করে সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে ও সকলের নূ্যনতম প্রয়োজন (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা) পূরণের নিশ্চিততা প্রদান করতে হবে৷ কোন মানুষই দান বা খয়রাতি গ্রহণ করতে চায় না---প্রয়োজনানুসারে শ্রমদান করে ভোগ্যবস্তু প্রাপ্তির জন্যে পর্যাপ্ত ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করতে চায়৷ সেই কারণে আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন প্রাউট বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের নীতি অনুসারে ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার দ্বারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃষি ও শিল্পের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নতি সাধন করে’ সমাজের সকলের জন্যে একশত শতাংশ কর্মসংস্থান ও নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির উপকরণের সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে৷ এর ফলে কোন দান খয়রাতির প্রয়োজন হবে না---মানুষ তার নিজের জীবন ধারণের রসদ নিজেই সম্মানের সঙ্গে উপার্জন করতে পারবে৷ দ্বিতীয়তঃ কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংসৃকতির কোনরকম অবদমন চলবে না৷ সমস্ত ভাষার সর্বাত্মক উন্নতিতে সচেষ্ট হতে হবে ও শিক্ষার মাধ্যমরূপে স্থানীয় ভাষাকে বিশেষভাবে ব্যবহার করতে হবে৷ এই মর্মে স্মরণ করি প্রাউট-প্রবক্তা মহান দার্শনিক  ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের সুচিন্তিত মতামত---

‘‘শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত স্থানীয় ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা উচিত৷ মানুষের সামূহিক অভিব্যক্তিকে বলে সংসৃকতি৷ ভাষা হ’ল সংসৃকতির প্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম৷ সমস্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর উচিত প্রতিটি ভাষাকেই উৎসাহ দান করা৷ তাহলেও স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে আত্মমর্যাদা বোধ ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার জন্যে প্রত্যেক সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থানীয় ভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা উচিত৷ প্রতিটি অঞ্চলের আপন আপন ধবনাত্মক সাংসৃকতিক বৈশিষ্ট্যকে উৎসাহ দান স্থানীয় এলাকার সামাজিক-অর্থনৈতিক বিকাশের পক্ষে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান৷ এছাড়া জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতিবোধ জাগ্রত করে তোলবার পক্ষে এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়৷

স্থানীয় ভাষা ছাড়া অন্য ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার অর্থ হ’ল স্থানীয় ভাষার প্রতি অবদমন৷ এর ফলে স্থানীয় সংসৃকতিও অবদমিত হয়৷ পরিণতিতে ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা দেয় নৈতিক অবক্ষয়, হীনন্মন্যতাবোধ ও পরাজিতসুলভ মনোভাব৷....... তবে স্থানীয় জনসাধারণ যদি নিজেদের সাংসৃকতিক ঐতিহ্যের প্রতি পরিপূর্ণভাবে সচেতন হয়ে ওঠে, তাহলে সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক সমস্ত হীনন্মন্যতাবোধ থেকেও তারা মুক্ত হতে পারবে৷’’

সুতরাং জনগণের করের টাকায় কাপ্তানী মেরে দানছত্রের দোকান না খুলে সুসংবদ্ধ ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বনির্ভর স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলে সমাজের সকলের জন্যে কর্মসংস্থান ও ক্রয়ক্ষমতার সুব্যবস্থা আশু ও একমাত্র প্রয়োজন৷ এই উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিকতার আদর্শে গড়ে ওঠা আাপোষহীন চরিত্রবিশিষ্ট  নীতিবাদী সদ্বিপ্রদের পরিচালনায় প্রাউট দর্শনের নীতি পদ্ধতি অনুযায়ী (আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা) একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা রচনা করাই বর্তমানে ভারতবর্ষসহ সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান---আর তখনই সর্ববিধ শোষণের অন্ধ তমিস্রা অপসৃত হয়ে মানুষের জীবনে ও সমাজে নবরবির কিরণোজ্জ্বল নোতুন সকাল উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে৷ সমগ্র পৃথিবী ও আগামী প্রজন্ম সেই শুভ মুহূর্ত্তের প্রতীক্ষায় দিন গুণছে৷ তাই বিশ্বের সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্তরিক ভাবে প্রাউট প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হতেই হবে, যাতে  যথাশীঘ্র এই পৃথিবীর বুক থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানসিক, মানসাধ্যাত্মিক ও অন্যান্য সমস্ত প্রকার শোষণের কালরাত্রি চিরবিদায় নিতে বাধ্য হয়৷