পল গুণে যায় আশায় আশায়

লেখক
আচার্য দীপাঞ্জনানন্দ অবধূত

মধ্যরাত্রি, ঘন অরণ্য, অন্ধকারের বুক চিরে যন্ত্রচালিত চার চাকা বিশিষ্ট ছোট ঘর দূরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে সমুখের পানে৷ যে দুটি বৈদ্যুতিক বাতি লাগানো সমুখে, তারআলো জোরালো নয়৷ তাই সমুখের বা পাশের দর্শকদের আবছা আবছা দেখাচ্ছে৷ শুধু কালো পীচের রাস্তাটা সামনের খানিকটা দেখা যাচ্ছে৷ পাকা ড্রাইভার না হলে এই আঁকাবাঁকা রাস্তায় ওই ক্ষীণ আলোতে এত দ্রুত বাসকে চালিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব৷ মোট আমরা ৩০ জন যাত্রী৷ একবার ড্রাইভার ভাই জোরে চেঁচিয়ে বলল ওই চেকপোষ্টে পাহারা রত সৈনিকদেরকে৷ সবাই ঘুমিয়ে এপাশ-ওপাশ হচ্ছে, আমার যে কেন ঘুম নেই চোখে তা অজানা৷ সত্যি কি সুন্দর এই আলো আধারের আবছা আবছা জগৎ! ঘন বন চারপাশে৷ ছোট বড় বিভিন্ন ধরণের গাছ, তা কিছুটা বুঝতে পারছি ওই ক্ষীণ আলোতে৷ এই আবছা আলোতে কালোতে বেশ ভাল লাগছিল৷ শহরে দেখি পাটিগণিত ঠাসা আধুকি জঙ্গলের পশু৷ যারা বিবর্তনের পথ কিছুটা অতিক্রম করেছে বলে নিজেদের নাম দিল মানুষ৷ তবে মানুষ নয় এরা হচ্ছে বেহুঁশ৷

যা বলছিলুম৷ এই আলো আঁধারের খেলা দেখতে দেখতে অনেক সময় পেরিয়ে গেল হঠাৎ আবছা আলোতে যে কালো ভাবটা তা সরে যেতেই দেখলাম ঘন কালো নীল ছায়া৷ এমন ঘন কালো নীল ছায়া দেখতে পেয়ে বুকের ভেতরটা ধরফর করে উঠল৷ সেই ঘন কালো নীল ছায়া বলল---ভয় পেয়েছেন? আমি কিছু বলার আগেই আবার বলল---অনেক দিন ধরে আপনাকে খঁুজছি কিন্তু পাইনি৷ ভাগ্য ভাল আজ পেয়েছি৷ ইতস্ততঃ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম---আমায় খোঁজ করছেন? আ-মা-য় মানে? আপনি কে? সেই ঘন কালো নীল ছায়া বলল---গলার স্বরে আমায় চিনতে পারছেন না? আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম---না, মানে, ঠিক বুঝতে পারছি না যে৷ এবার সেই ঘন কালো নীল ছায়া কাতর স্বরে বলল---আমায় চিনতে পারছো না! হায় বিধাতা, সত্যি তোমার কী আশ্চর্য আবিষ্কার এই ধরা৷ দেখুন তবে আমায় আর একবার৷

তার সেই আগের পচা-গলা, হাড়-মাংসের শরীরখানা আবছা আবছা চোখের সামনে ভেসে উঠল৷ মুহূর্ত্তে চিনতে পেরে আমি চেঁচিয়ে বললাম---তুমি সেই গোপাল যার মৃত্যু হয়েছিল আজ থেকে পনেরো বছর আগে৷

সে বলল---হ্যাঁ স্যার, আমি সেই আপনার প্রিয় ছাত্র গোপাল৷

সব ঘটনা মনে পড়ে গেল৷ আজ থেকে পনেরো বছর আগে গোপাল সুকলে ভর্তি হয়েছিল সপ্তম শ্রেণীতে৷ গোপাল পড়াশুনায়, খেলাধূলায় সব সময় প্রথম স্থানে থাকত৷ কিন্তু নবম শ্রেণীতে ওঠার আগে ও জলে পড়ে মারা যায়৷

গোপাল বলল---স্যার, আপনার শেখানো সব কথা আমার মনে আছে৷ সবাইকে ভুলতে পেরেছি, কিন্তু আপনাকে! তা অসম্ভব৷ এই দেখুন৷ আপনি আমাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন--- সেই মন্ত্র আমার আজও মনে আছে৷ জীবন সংগ্রামে কীভাবে সফলতা আসবে তার সম্পূর্ণ গাইডলাইন যা আমি পেয়েছিলাম জীবনবেদ ও চর্যাচর্য বইগুলি পড়ে৷ এই বইগুলি পড়ে ৷ আপনি আমায় এই বইগুলি পড়তে দিয়েছিলেন৷

আমি বললাম---এই মন্ত্র তুমি অভ্যাস করছ? হঠাৎ সে কেঁদে উঠল৷

তাকে আমি সান্তনা দিয়ে বললাম---কেঁদনা গোপাল, ঈশ্বর দেখছেন তিনি দয়ালু, তিনি কৃপা করবেন৷

গোপাল বলল---স্যার আজ পনেরো বছর পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছি---পথে-ঘাটে, পাহাড়ে-জঙ্গলে, শশ্মানে, ঘরে, নদী, ঝর্ণাতে আকাশে-বাতাসে, গ্রহে-নক্ষত্রে মুক্তির আশায়৷ কেউ না, কেউই পারল না শোনাতে আমায় আমার মোক্ষের উপায়৷ আমি এ যন্ত্রণা আর সইতে পারছি না৷ ওগো স্যার, তুমি বল আমায় আমার মোক্ষ মুক্তির উপায়৷ এই ত্রিতাপ জ্বালা থেকে মুক্তি চাই৷

নিজেকে সামলে তাকে বললাম---এখন ডি.ষম.এস.-এর সময় যাও পুরুলিয়াতে৷ সেখানে গিয়ে হরিপরিমণ্ডল গোষ্ঠীর দলে যোগ দিয়ে কীর্ত্তন কর খুব করে৷

হঠাৎ কাণে বার বার ভেসে আসছে---স্যার উঠুন, স্যার নামতে হবে৷ চোখ খুলে চেয়ে দেখি বাসে বসে আছি৷ ওদিকে ভোরের মিষ্টি চিক্চিকে রোদ, চারপাশের বন জঙ্গলকে আলোকিত করেছে৷ শোনাযাচ্ছে পাখীদের মিষ্টি কলরব৷ আবার আমার পাশের সেই ভদ্রলোক বলল---স্যার চলুন, সবাই বাস থেকে নেমে গেছে৷ ভোর রাতে বেশ ঘুমিয়েছেন৷ আমি বললুম---হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে যাচ্ছি যাচ্ছি৷