প্রাকৃতিক চিকিৎসা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

উপবাস

কেবল মানুষেরই নয়, মনুষ্যেতর অনেক প্রাণীরও ঔষধের সঙ্গে অল্পস্বল্প পরিচয় আছে৷ তবে মনুষ্যেতর অনেকগুলি প্রাণী প্রাচীনকাল থেকেই তাদের স্বাভাবিক ঔষধ হিসেবে মেনে চলেছে উপবাস বা স্বেচ্ছা-অনশনকে৷ তোমরা দেখে থাকবে, কুকুর ও আরও কয়েকটি জীব একটু অসুস্থতা বোধ করলেই আহারে বিরতি দেয়৷ তোমাদেরও যদি কখনও কিছুটা শারীরিক অস্বস্তি বোধ আসে তখন খাবার ইচ্ছে থাকে না৷ আজকালকার কিছু কিছু চিকিৎসক খাবার ইচ্ছে না থাকলেও রোগীকে জোর করে খাবার পরামর্শ দেন ও চাপ দেন৷ এটা কিন্তু প্রাকৃতিক রীতি–বিরুদ্ধ৷ অসুস্থ জীবের পক্ষে খেতে না চাওয়াটাই স্বাভাবিক যদি তার অসুস্থতাটা অতি–ক্ষুধা রোগ না হয়৷ আহার বন্ধ রাখলে শরীরের কয়েকটি যন্ত্র সাময়িক বিশ্রাম পায়৷ তার ফলে সে উপবাসান্তে নোতুন উৎসাহে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে ও জীবদেহে সুস্থতা বোধ ফিরে আসে৷ তাই শুধু প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরই নয়, প্রাগৈতিহাসিক জীবেরও আদি, অকৃত্রিম ও প্রধান ঔষধ হচ্ছে উপবাস বা স্বেচ্ছাকৃত অনশন৷

স্বেচ্ছা-অনশন ও উপবাসে কিছুটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে৷ স্বেচ্ছা-অনশন বলতে বুঝি, শরীরকে সুস্থ রাখার জন্যে ইচ্ছে করেই না খাওয়া (অন্ + অশন = অনশন৷ ‘অশন’ মানে খাওয়া, ‘অনশন’ মানে তাই না খাওয়া)৷ এই অনশন অবশ্যই রোগ নিরাময়ের সহায়ক৷ কিন্তু চাপিয়ে–দেওয়া অনশনে রোগ–নিরাময়ের গুণ নেই৷ কেননা জোর করে অনশন করতে বাধ্য করলে মনের মধ্যে যে একটি চাপা বিক্ষোভ থাকে সেটা মানসিক সন্তুলন নষ্ট করে দেয় আর.....সেই সঙ্গে শারীরিক সন্তুলনও নষ্ট করে দেয়৷

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথির কাছাকাছি দিনগুলিতে লক্ষ্য করা যায় শরীরের জলীয় ও গ্যাসীয় পদার্থগুলো ওপরের দিকে উঠে বুকে ও মাথায় একটা অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে৷ তাই ওই সময়ে পাকস্থলীতে আহার না পড়লে ওপরের পদার্থগুলো নিম্নের দিকে নেবে আসে ও তাতে শারীরিক অস্বস্তিকর অবস্থাটার লাঘব হয়৷

আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তাই–ই পরিবর্ত্তিত হতে হতে সারভাগ শুক্রে পরিণত হয়৷ শুক্র হ’ল মস্তিষ্কের ভোজন৷ আর তা থেকেই জীবমনের চিত্তধাতু ectoplasmic stuff উৎপন্ন হয়৷ বিধিমত উপবাস করলে উদ্বৃত্ত শুক্র মনের হীন বৃত্তিগুলোর উদ্রেক না করে মনকে উন্নততর বৃত্তির দিকে পরিচালিত করে৷ তাছাড়া উপবাসের ফলে শরীরের অনাবশ্যক দূষিত পদার্থগুলোও নষ্ট হয়ে যায়৷ তাছাড়া ভুক্ত আহারের হজমের জন্যে শরীরের যে শক্তিটা ব্যয়িত হয় সেটাকে অন্য কাজে লাগানো যেতে পারে৷ তাই উপবাসের সময় (আধ্যাত্মিক) সাধনার পক্ষে প্রকৃষ্ট সময়৷

উপবাস জিনিসটা অনশন তো বটেই, অধিকন্তু সেই সময় কায়িক অভিপ্রকাশ কিছুটা প্রত্যাহার করে নিয়ে মানসিক অভিপ্রকাশকে পরম পুরুষের সান্নিধ্যে ক্রমশঃ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া৷ ‘উপ’ মানে নিকটে, ‘বাস’ মানে থাকা৷ তাই ‘উপবাস’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে ঈশ্বরের নিকটে থাকা৷

হ্যাঁ, বলছিলুম কি, উপবাসে স্বেচ্ছা–নশনের গুণ তো আছেই, অধিকন্তু এই জিনিসটা মানসিক সন্তুলনেরও বিশেষ ভাবে সহায়ক অর্থাৎ উপবাস শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার ব্যাধিরই ঔষধ৷ বিধিক্ষদ্ধভাবে উপবাস করলে মানুষের মনঃশক্তি যে ক্ষৃদ্ধি পায় তাতে কোন সন্দেহই নেই৷ এটাই যুগ–যুগান্তরের পরীক্ষিত সত্য৷

সূর্যালোক

সূর্যালোকে রোগ নিরাময়ের প্রভূত উপাদান রয়েছে৷ সূর্যালোকে বিভিন্ন বর্ণের রশ্মি (rays or pencils of rays) বিভিন্ন ধরনের ব্যাধির ঔষধ, প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক৷ দিবসের বিভিন্ন সময়ে সূর্যালোকের বিভিন্ন ধরনের গুণ রয়েছে৷ সূর্যপক্ব জলেরও বিভিন্ন ধরনের গুণ রয়েছে৷ তাই সূর্যালোককেও জীবদেহের বিভিন্ন ব্যাধির অন্যতম ঔষধ রূপে প্রাচীনকাল থেকেই স্বীকার করা হয়েছে৷ বেদেও বলা হয়েছে–‘সূর্য্যঃ যথা সর্বলোকস্য চক্ষুঃ’৷ সূর্যালোকরূপ ঔষধকে সেবন করতে হয় পিঠের মেরুদণ্ডের মাধ্যমে, বক্ষদেশ বা উদরের মাধ্যমে নয়৷

বায়ু ও মাটি

নির্জন স্থানের নির্মল বায়ুও  (O3) জীবদেহের উত্তম ঔষধ৷ এই বায়ু–রূপী ঔষধকে সেবন করতে হয় মস্তকের পশ্চাদ্ভাগ দিয়ে ও কপালের ঊর্ধ্বাংশ দিয়ে৷ বনভূমির নিকটবর্ত্তী নদীতীরে যে স্থানে অল্প পরিমাণে বালি ও বেশী পরিমাণ মাটি রয়েছে, সেই স্থানের মৃত্তিকাও জীবদেহের উত্তম ঔষধ৷ এই ঔষধ সেবন করতে হয় বিনা বস্ত্রে ভূমি–শয্যায়৷

জল

গন্ধবিহীন ঈষদুষ্ণ জল–বিশেষ করে তা’ যদি সূর্যপক্ব হয়–জীবদেহের পক্ষে উত্তম ঔষধ৷ এতে রোগ নিরাময়ের গুণ খুব বেশী পরিমাণে থাকে৷ প্রাচীনকাল থেকে জেনে বা না জেনে মানুষ ও বিভিন্ন জীব জলকেও তাদের অন্যতম ঔষধ রূপে মেনে নিয়েছে৷ বেদেও বলা হয়েছে ঃ ‘‘আপশ্চ বিশ্বভেষজী’’৷

(শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে গৃহীত)