‘‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম৷৷
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম৷
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে৷৷’’
মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের সমরপ্রাঙ্গনে পাণ্ডব পক্ষের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অর্জুনের রথের সারথি ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ৷ শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনের রথকে সমরপ্রাঙ্গনের দিকে ধাবিত করে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্র স্থলে প্রতিপক্ষ যোদ্ধাদের সম্মুখীন হলেন তখন অর্জুন দেখতে পেলেন প্রতিপক্ষ যোদ্ধাদের অধিকাংশই তাঁর নিজের আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধব৷ নিজের আত্মীয় পরিজনকে হত্যা করার জন্যে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে তিনি অপারগ বলে জানালেন কৃষ্ণকে৷ গাণ্ডীব পরিত্যাগ করে বিষন্ন বদনে রথের উপরে বসে পড়লেন৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন অর্জনুকে বললেন, হে অর্জুন, এই ধরাধামে যখন ধর্মের অধোগতি হয়, মানুষ যখন তার স্বধর্ম অর্থাৎ মানবধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে অধর্মের পথে চলতে থাকে, অধার্মিকদের অন্যায়,অত্যাচার ও ভ্রষ্টাচারে যখন মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে কাতরভাবে পরমপুরুষকে ডাকে, তখন দুষ্টদের দমন ও শিষ্টদের পালন করার জন্যে , ব্যভিচার ও ভ্রষ্টাচার দূর করার জন্যে ও ধর্মসংস্থাপনের জন্যে আমি যুগে যুগে এই মর্ত্যলোকে অবতীর্ণ হই৷
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আনুমানিক, প্রায় ৩০০০ থেকে ৩৫০০ বৎসর পূর্বে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন৷ সে যুগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক , কুটনৈতিক পরিস্থিতি এ যুগের মত এত জটিল বা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল না৷ তবুও এক ঘোর ধর্মীয় সংকটময় মুহৃর্তে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই মর্ত্যধামে আবির্ভূত হয়ে প্রকৃত মানবধর্মকে রক্ষা করেছিলেন৷
বর্তমান ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, কুটনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল ও ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন৷ রাজনৈতিক অনাচার, সামাজিক ব্যাভিচার, অর্থনৈতিক ভ্রষ্টাচার, উদগ্র অসৎ প্রবৃত্তি আজ সমগ্র মানব সমাজকে এক অতল গহ্বরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ বহু মনীষী, যুগপুরুষ ও সমাজ সংস্কারকের আবির্ভাব আমাদের ভারতবর্ষে ঘটেছে৷ গৌতমবুদ্ধ, চৈতন্যদেব, রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ ব্যষ্টিদের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ না করলেই নয়৷ কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির কোন সদর্থক উন্নতিতো ঘটেই নি, বরং কালের অগ্রগতির সাথে সাথে আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন ঘোর তমসাচ্ছন্ন৷
কালের এই সংকটময় মুুহৃর্তে আর এক যুগপুরুষ ও মহান দার্শনিকের আবির্ভাবের কথা উল্লেখ করতেই হবে৷ তিনি শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী৷ ১৯২১ সালের বৈশাখী পূর্ণিমায় (বুদ্ধপূর্ণিমা) বিহারের জামালপুরে তাঁর জন্ম৷ পৈতৃক বাড়ি বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ের সন্নিকটবর্তী বামুনপাড়া গ্রামে৷ শ্রী সরকার প্রবর্তিত ‘আনন্দমার্গ’ একটি ধর্মীয় সংঘটন যা মানবধর্মে বিশ্বাসী ও নব্যমানবতাবাদ তথা বিশ্বভ্রাতৃত্বের পূঁজারী৷ তিনি যেমন অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনা অর্থাৎ যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধির মাধ্যমে চরম আধ্যাত্মিক উত্তরণের দিগদর্শন দিয়েছেন--- তেমনি দিয়েছেন যুগান্তকারী এক সমাজ অর্থনৈতিক দর্শন-‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷ Progressive Utilisation Theory) সংক্ষেপে ‘প্রাউট’ নামে সমধিক পরিচিত৷
শ্রী সরকার রচিত ‘আনন্দসূত্রম’ পুস্তকখানিতে তিনি বিভিন্ন সূত্রের উল্লেখ করেছেন৷ প্রাউট তত্বের উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর রচিত ‘আনন্দসূত্রম’ গ্রন্থখানির পঞ্চম অধ্যায়ের সূত্রগুলিতে ৷ পঞ্চম অধ্যায়ের নয় নম্বর সূত্রটিতে তিনি বলেছেন--- ‘‘যুগস্য সর্বনিম্ন প্রয়োজনং সর্বেষাং বিধেয়ম্’’৷ ‘প্রাউট’ তত্ত্ব এক সাম্যবাদী তত্ত্ব, কিন্তু এর ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠিত অধ্যাত্মবাদের উপরে৷ প্রচলিত এক সাম্যবাদী তত্ব যেটা বস্তুবাদে বিশ্বাসী ও পৃথিবীর বুক থেকে ক্রমশঃ বিলীয়মান৷ এখানেই এই সাম্যবাদী তত্ত্বের সাথে প্রাউটতত্ত্বের তফাৎ৷ তথাকথিত সাম্যবাদী তত্ব বা মাকর্সবাদ হিংসায় বিশ্বাসী৷ রক্তাক্ত বিপ্লব বা শ্রেণী সংগ্রাম মাকর্সবাদের মূল মন্ত্র৷ প্রাউট তত্ত্বে হিংসার কোন স্থান নেই৷ প্রাউট তত্ত্বের শুরু উপরোক্ত সূত্রটি দিয়ে ও শ্রী সরকার রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে তিনি এর বিশদ ব্যাখা করেছেন৷
উপরোক্ত সূত্রটির ব্যাখায় তিনি বলেছেন, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি সম্পদ প্রতিটি মানুষের সাধারণ সম্পত্তি৷ এই সম্পত্তির উপরে সকলেরই সমান অধিকার৷ মানুষের সর্বনিম্ন বা মৌলিক প্রয়োজনগুলির যথা-অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান,চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা সবাইকার জন্যে সুনিশ্চিত করা অবশ্য কর্তব্য ৷ কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়বেন আবার কিছু সংখ্যক মানুষ অনাহারে আশ্রয়হীন অবস্থায় চিকিৎসার অভাবে তিলে তিলে মরবে, এটা হতে পারে না৷ তিনি বলেছেন, মানুষের এই সর্বনিম্ন প্রয়োজন পূর্ত্তির দায়িত্ব ও গ্যারান্টি সরকারে থাকা শাসক কুলকেই নিতে হবে৷ পার্থিব সম্পদের সুষমবন্টনের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে৷
মানুষের এই সর্বনিম্ন প্রয়োজন আবার যুগের পরিবর্তনের সাথে তথা গুণগত প্রগতির সাথে পরিবর্তিত হয়৷ তাই তত্ত্বের নাম ‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷ প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের আশ্রয়ের জন্যে গুহা কন্দরের প্রয়োজন হ’তো৷ যুগের প্রগতির সাথে মানুষের বাসগৃহের সর্বনিম্নমানেরও উন্নতি বিধান ঘটেছে৷ গুহা থেকে কঁুড়ে ঘর, কুঁড়েঘর থেকে পাকা বাসগৃহ, এভাবে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের মানও উন্নত হয়েছে৷ তিনি আরও বলেছেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধরাধামের প্রতিটি প্রাণী, উদ্ভিদ, জড়পদার্থ, আকাশ, বাতাস পরমব্রহ্মেরই সৃষ্টি--- বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে আমরা কসমিক ফোর্স বলে জানি৷ যাবতীয় পার্থিব সম্পদ তারই সৃষ্টি, তাই তার সৃষ্ট সম্পদের উপর সকলেরই সমান অধিকার৷
- Log in to post comments