প্রভাত সঙ্গীত  ঙ্গ আলোয় ফেরার আকুতি

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

আজ সমাজের সর্বস্তরে দেখা দিয়েছে চরম অবক্ষয়ের অমানিশা৷ অর্থনৈতিক স্তরে চলছে চরম শোষণ ও দুর্নীতি৷ ঈশ্বর সৃষ্ট এই জগতের সম্পদ যা ঈশ্বরের সন্তান সমস্ত মানুষের মিলেমিশে খেয়ে পরে বাঁচার জন্যে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জীবনের চরিতার্থতার পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে, কিন্তু আজ সেই সম্পদ লুঠে পুটে খাচ্ছে সমাজের এক শ্রেণীর শোষকগোষ্ঠী৷ রাজনীতি – যা নাকি দেশ–সেবার প্রকৃষ্ট নীতি, তা হয়ে উঠেছে যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা করায়ত্ত করার ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার কৌশল মাত্র৷ এখানে ‘নীতি’টা নিতান্তই গৌণ৷ শিক্ষার নামে চলেছে কেবলমাত্র অর্থ রোজগারের উপায় আয়ত্ত করার প্রশিক্ষণ, সেখানে নীতিশিক্ষা–ধ্যাত্মশিক্ কোনো নাম–ঠিকানা নেই৷ সংস্কৃতির নামে চলেছে অসংস্কৃতির বেলাল্লাপানা৷ সমস্ত মূল্যবোধ জ্বলে পুড়ে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার নামে উগ্র জড়বাদ ও ভোগবাদের লাভাস্রোতের তলায়৷

এই অবস্থায় সমাজের আমূল পরিবর্ত্তন – সর্বাত্মক বিপ্লবই মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি রক্ষার একমাত্র পথ৷ কিন্তু তার জন্যে মানুষ তৈরী কৈ সবাই তো পুঁজিবাদ সৃষ্ট ভোগবাদ তথা জড়বাদের গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে চলেছে৷ আত্মসচেতনতা – সমাজ চেতনা নিঃশেষিত প্রায়৷ এ অবস্থায় আগে প্রয়োজন একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব৷ এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আত্মসচেতনতাবোধ ও সমাজচেতনা জাগাতে হবে৷ অধ্যাত্ম ভিত্তিক শুভচিন্তা তথা নৈতিক–চেতনার ভিত্তি মজবুত করতে হবে৷

পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বক্ষেত্রে এইটাই হয়৷ সমাজের প্রগতির ক্ষেত্রে একটা বড় ধরণের পরিবর্তন বা বিপ্লব আসার আগে আসে সাংস্কৃতিক বিপ্লব৷ ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবের পূর্বেও তৎকালীন দেশবরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, গীতিকারদের চেষ্টায় দেশ জুড়ে দেখা দিয়েছিল একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যা মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে বিপ্লব এনেছিল৷ মানুষের মনে জ্বালিয়ে দিয়েছিল আদর্শের অগ্ণিশিখা৷

আজকের সর্বাত্মক অবক্ষয়ের যুগে তেমনি আগে দরকার মানুষের মনোজগতে এক পরিবর্তন৷ ভোগবাদের পরিবর্তে আনতে হবে মানুষের মধ্যে অধ্যাত্মবাদ, সেবা ও ত্যাগের ভাবনা৷

সমাজের এই প্রয়োজন উপলব্ধি করেই ধর্মগুরু ও সমাজগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী, যাঁর লৌকিক নাম শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, তিনি একদিকে যেমন এক পূর্ণাঙ্গ দর্শন দিয়ে মানুষকে আদর্শ সমাজ রচনার দিশা দেখালেন, সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনার উদ্দেশ্যে রচনা করলেন প্রভাত সঙ্গীত – যাতে রয়েছে অধ্যাত্ম চেতনামূলক সঙ্গীত থেকে শুরু করে সমাজ চেতনামূলক তথা সমাজের সমস্ত অন্যায় ও পাপাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের  সঙ্গীত, যেগুলির সংখ্যা পাঁচ সহস্রাধিক, আর এই প্রভাত সঙ্গীতের সুরে ছন্দে মানুষের মনকে বইয়ে দেওয়ার জন্যে তিনি সৃষ্টি করেছেন নোতুন এক সাংস্কৃতিক সংস্থা – রেণেঁশা আর্টিষ্টস্ এ্যান্ড রাইটার্স এ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপে ‘রাওয়া’৷

‘রাওয়া’র উদ্যোগে আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এই প্রভাত সঙ্গীত – দেশবাসীর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাসীর সাংস্কৃতিক জগতে আজ যে অমানিশা দেখা দিয়েছে – তার অবসান ঘটিয়ে প্রভাতের অরুণ আলোয় জগৎকে উদ্ভাসিত করতে৷

আগামী ১৪ই সেপ্ঢেম্বর প্রভাত সঙ্গীত দিবস৷ ১৯৮২ সালের এমনি এক ১৪ই সেপ্ঢেম্বর শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী দেওঘরে প্রথম প্রভাত সঙ্গীত রচনা শুরু করেছিলেন৷ ১৯৯০ সালের ২০শে অক্টোবর কলকাতায় তাঁর মহাপ্রয়ানের আগের দিন পর্যন্ত মাত্র ৮ বছর ১ মাস ৬ দিনের মধ্যেই তিনি ৫০১৮ টি সঙ্গীত রচনা ও তাতে সুরারোপণ করে’ বিশ্বের ইতিহাসে এক নোতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন৷

১৪ম্ম্ভ্র ভবভঢূবম্ভ্রঙ্খতয্ বিশ্বের দেশে দেশে এই প্রভাত সঙ্গীত দিবস পালিত হডয৷ প্রভাত সঙ্গীত অবলম্বনে সর্বত্র ‘রাওয়া’র উদ্যোগে ব্যাপকভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে৷ বিভিন্ন স্থানে প্রভাত সঙ্গীত অবলম্বনে নৃত্য, গীত অঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে৷ এই সব কেন্দ্র করে প্রভাত সঙ্গীতের প্রতি সর্বত্র মানুষের বিপুল আগ্রহ পরিদৃষ্ট হচ্ছে৷

আজ ভোগবাদ তথা জড়বাদগ্রস্ত মানুষ স্বার্থলোভ ও আত্মকেন্দ্রিক জীবনের মোহে বিপথগামী৷ সেই পথ ভ্রষ্ট মানুষের কাছে প্রভাত সঙ্গীতের জিজ্ঞাসা–

‘‘মানুষ মানুষ হারায় হুঁশ কোথায় চলেছ তুমি৷

আকাশ সাগর বিষিয়ে দিয়ে নরক করে মর্ত্ত্যভূমি৷’’

তাই আলোয় ফিরতে, চেতনা জাগাতে প্রভাত সঙ্গীতের  শুরুতেই অন্তরের আকুতি –

‘‘বন্ধু হে নিয়ে চল,

আলোর ওই ঝর্ণা ধারার পাণে৷৷

আঁধারের ব্যাথা আর সয়না প্রাণে৷৷’’