প্রভাত  সঙ্গীত ও শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি

লেখক
শ্রীজ্যোতির্ময় পাহাড়ী

বিবর্তনের ধারা পথ বেয়ে উদ্ভিদ, পশু-পাখীর স্তর অতিক্রম করে পশু-মানব আজকের আধুনিক মানবে পরিণত হয়েছে, পশুমানবরূপে বনে জঙ্গলে বিচরণ  করার সময় পাশবিক বৃত্তির দেহসবর্বস্বতাই ছিল তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য৷ তবে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ‘মন’ দিয়েছিলেন যা পশু-পাখীকে প্রদান করেননি৷ কালক্রমে মানুষের শরীরেরও মনের পরিবর্তন হয়েছে৷ ধীরে ধীরে তার বুদ্ধির  বিকাশ ঘটেছে  বিবেকবোধ  জাগ্রত হয়েছে ও ভালমন্দ বিচার  করতে শিখেছে৷ তবুও আজকের মানুষের  মধ্যে জন্মজন্মান্তরের  পশুজীবনের সংস্কার ও অভ্যাস সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করছে৷ অপরদিকে জীবাত্মা যেহেতু পরমাত্মার অংশবিশেষ সেই কারণে মানুষের মধ্যে দেব সুলভ গুণাবলী পরিলক্ষিত হয়৷ মানুষ দেবত্বে উন্নীত হন৷ বিধাতা পুরুষ  কিছু কিছু পশুপাখীর মত মানুষকে, সমাজবদ্ধ জীব করতে চেয়েছিলেন, তাই  মানুষ সামাজিক জীব৷ সমাজের  বাহিরে সে থাকতে পারে না, সমাজে  সকলের সঙ্গে  মিলেমিশে থাকতে  সে ভালবাসে৷  সমাজের মধ্যেই তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে৷ এই সমাজবদ্ধ  মানুষের সমাজ জীবনের সামগ্রিক অভিপ্রকাশ তার সংসৃকতির মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে৷ মানুষের হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনার প্রকাশ যেমন সংসৃকতির মধ্যে এসে যায় তেমনি সঙ্গীত, শিল্প ও ললিতকলাও এই সংসৃকতির মধ্যে এসে যায়, তাই সঙ্গীত  মানব সংসৃকতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ৷ তবে নিম্নমানের সঙ্গীত মানুষের অন্তনির্হিত পশুভাবকে জাগিয়ে তোলে ফলে মানুষ পশুসুলভ কাজকর্ম করে ফেলে৷  আবার উচ্চমানের সঙ্গীত মানুষের মধ্যে সুপ্ত দেবভাবকে জাগিয়ে তোলে৷ বর্তমানে ভোগবাদ সর্বস্ব অসংসৃকতি সুস্থ  সামাজিক পরিবেশকে কলুষিত করে তুলছে এবং সঙ্গীত জগৎকে গ্রাস করে ফেলেছে৷ সঙ্গীত জগতের এই অবক্ষয়কে রোধ করে অমানিশার অবসান ঘটিয়ে আলোয় ভরে দেওয়ার বার্তা বহন করে নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়েছে ‘প্রভাত সঙ্গীত’৷ প্রভাতসঙ্গীতের রচয়িতা ও সুরকার  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার যিনি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি নামে খ্যাত, এখানে প্রভাতসঙ্গীতের  অর্থ প্রভাতকালীন সঙ্গীত নয় অথবা প্রভাতরঞ্জন রচিত এই সঙ্গীত বলে এর নাম  প্রভাত সঙ্গীত তাও নয়৷ বর্তমানে সঙ্গীতের জগতে যে অবক্ষয়ের অমানিশা দেখা দিয়েছে  তার অবসান ঘটিয়ে এই সঙ্গীত নূতন প্রভাতের  সূচনা করবে বলে এই সঙ্গীতের নাম প্রভাত  সঙ্গীত৷ এই প্রভাত সঙ্গীত কোনো সাধারণ রচনা নয়, এই  সঙ্গীত হচ্ছে  চৈতন্য সত্ত্বার এক  স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ৷

মানব সভ্যতার এক সংকটময় সময়ে যখন ধর্ম , সংসৃকতি, শিক্ষা, অর্থনীতি রাজনীতিসহ বিভিন্নক্ষেত্রে চরম নীতিহীনতা  ও বিশৃঙ্খল অবস্থা, চরম অবক্ষয় আর সমাজের পুরাতন  ধ্যান ধারনা যখন বর্তমান সমাজে  অচল, কোন সামগ্রিক  প্রগতিশীল সর্বাত্মক  আদর্শ নাই, সেই যুগসন্ধিক্ষণে  ১৯২১ সালের বৈশাখী পূর্ণিমাতে  মহাসম্ভূতি ও প্রভাতসঙ্গীতের  রচয়িতা ও সুরকার  শ্রী প্রভাতরঞ্জন  সরকারের জন্ম৷ ১৯৩৯ সালের শ্রাবণীপূর্ণিমাতে আধ্যাত্মিক  গুরু রূপে তাঁর আত্মপ্রকাশ৷ মানব সভ্যতার এক সঙ্কটময় সময়ে এই মহামানব এক সর্বাত্মক আদর্শ মানব সমাজকে উপহার দিয়েছিলেন যার নাম আনন্দমার্গ দর্শন৷ তিনি ধর্ম , সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য শিল্প, সঙ্গীত, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি সকল ক্ষেত্রেই সকলপ্রকার সমস্যা সমাধানের  কথা সুস্পষ্ট ভাবে বলেছেন৷ তাঁর এই দর্শনকে  দিকে দিকে প্রচার ও প্রসার করতে তিনি ১৯৫৫ সালের ১লা জানুয়ারী আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ তৈরী করলেন ও শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন৷ কয়েক বছরের মধ্যে  এই সংঘটন পৃথিবীর ১৮২ দেশে ও দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়ল, এই আদর্শ দিকে দিকে  প্রচারের জন্য ও মানব সেবার উদ্দেশ্যে তিনি শত শত সর্বক্ষণের  গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসীনিদের সুশিক্ষিত করলেন, যাঁরা পরমপুরুষের আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন৷

বিশ্বব্যাপী এই সাংঘটনিক  কর্মকাণ্ডের মধ্যে সদাব্যস্ত থেকেও ১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর ‘দেওঘরে’ তাঁর প্রভাত সঙ্গীত  রচনার শুভারম্ভ করেন৷ মাত্র ৮ বছর সময়ের মধ্যে ৫০১৮ খানি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মী সঙ্গীত বাংলা, ইংরাজী, সংসৃকত, উর্দু, হিন্দী ইত্যাদি ৮টি ভাষায়  রচিত  হল৷ এই সঙ্গে  উল্লেখ করা  প্রাসঙ্গিক যে, শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী প্রায়  দুইশত ভাষা  জানতেন বা কথা বলতে  পারতেন  অর্র্থৎ তিনি  সকল মানুষের  ভাষা জানতেন  এবং মনের কথা  বুঝতে  পারতেন  এবং বিভিন্ন দেশের মানুষের  সঙ্গে তাদের কথা বলতে পারতেন, এই ধরনের  নজীর  পৃথিবীর  ইতিহাসে  বিরল৷  কারণ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী  একজন  সাধারণ ধর্মগুরু ছিলেন না৷ তিনি ছিলেন মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম যিনি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন শোষণহীন নোতুন পৃথিবী গড়ার জন্য তার অগণিত  শিষ্য ও অনুরাগীদের পথ দেখাতে৷ লক্ষ্য করার বিষয়  এত ভিন্নধর্মী ভিন্ন ভিন্ন  ভাষায় দেশী বিদেশী সুরের যুগান্তকারী সঙ্গীত ঘরানার যিনি শ্রষ্টা, তিনি নিজে কোনোদিন হারমোনিয়াম বা কোন বাদ্যযন্ত্র  নিয়ে কোন ওস্তাদের  কাছে  সঙ্গীতের  তালিম নেননি৷ তাছাড়া সবগুলি গান তৈরী হয়েছে তার তাৎক্ষণিক  গেয়ে যাওয়াকে  কেন্দ্র করে এবং অপর ব্যক্তি  গান ও সুর  লিখে  গেছেন৷ তিনি নিজে কোন গান লেখেননি বা তার পাণ্ডুলিপি কখনো  সংশোধন করেন নি৷ প্রভাতসঙ্গীতের সুরকার  হিসাবে তাঁর অত্যাশ্চর্য ও অপূর্ব সুর নির্বাচনের ক্ষমতা৷অনন্য সাধারণ, তাই তো  তিনি পরমপুরুষ, প্রভাতসঙ্গীতে কখনো দেশী, কখনো বিদেশী আবার কখনো  রাগ সঙ্গীতের  সুর, কখনো লোকসংগীতের সুর , তার পাশাপাশি  আছে  পার্সিয়ান, ইজরায়েলী, চাইনিজ অথবা  স্কান্ডিনেভিয়ান, আই বেরিয়ান  ইত্যাদি বৈচিত্র্যময়  সুরের সংযোজন৷ ভাব বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে  ভৈরবী, যোগিয়া, আশাবরী, তোড়ি, ভীমপলশ্রী, পিলু, ইমন, খাম্বাজ, বাগেশ্রী, কাফি, চন্দ্রকোষ, তিলককামান, কেদার, বেহাগ, মালকোষ, ছায়ানট , দরবারী কানাড়া, দেশবাহার, জয়জয়ন্তী ইত্যাদি রাগিনীর  সমাহার এবং সেই সঙ্গে টপ্পা, বাউল,কীর্তন, ঝুমুর, গজল, কাওয়ালী ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সুরের বৈচিত্র্য প্রভাত সঙ্গীতকে করেছে  অনন্য ও অসাধারন৷ গানের জগতে  এই ধরনের  দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল৷ বিষয়গত বৈচিত্র্য আলোচনা করতে গিয়ে বলা যায় প্রভাত সঙ্গীতের  বিপুল ভাণ্ডারে আছে অধ্যাত্মচেতনামূলক গান, নব্যমানবতাবাদের গান, মিষ্টিক ধর্মী গান, আশাবাদের গান, প্রকৃতি পর্বের গান, শিবগীতি, কৃষ্ণগীতি, শিশুদের গান, উৎসব অনুষ্ঠানের গান প্রভৃতি বিভিন্ন ভাবের ও বিভিন্ন  বিষয়ের গান৷ তাই প্রভাত সঙ্গীতকে অতিমানসের সঙ্গীত হিসাবে চিহ্ণিত করা যায়৷  (ক্রমশঃ)