প্রজাতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তব চিত্র

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে৷ যদিও এই স্বাধীনতাকে সার্বিক স্বাধীনতা বলা যায় না৷ বলা চলে এদিন আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছি৷ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আমরা পাই নি৷ ব্রিটিশ শাসকের হাত থেকে শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে এলেও বহুজাতিক পুঁজিপতি গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক নাগপাশ থেকে ভারতের জনগণ মুক্তি লাভ করে নি৷

যাইহোক ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ব্রিটিশরা ভারতের নেতাদের হাতে দেশ শাসনের ভার অর্পণ করার পর আমাদের নিজস্ব সংবিধান রচনার জন্যে ডাঃ বি. আর. আম্বেদকারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গড়া হয়৷ এই কমিটির ওপর দায়িত্ব পড়ে স্বাধীন ভারতের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্যে নোতুন সংবিধান রচনা করার৷ এই কমিটি কর্তৃক রচিত সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী আনুষ্ঠানিক ভাবে কার্যকর করা হয় ও ভারতকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ গণতন্ত্র বলতে বোঝায় যেখানে সরকার জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হচ্ছে, আর প্রজাতন্ত্র হ’ল যেখানে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধানও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন৷ যেমন এদেশের সাংবিধানিক প্রধান রাষ্ট্রপতি ভারতের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত হচ্ছেন অর্থাৎ পরোক্ষভাবে জনগণের দ্বারাই নির্বাচিত হচ্ছেন৷ ইংল্যাণ্ডের সরকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অর্থাৎ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হলেও দেশের সাংবিধানিক প্রধান অর্থাৎ এখানকার রাজা বা রাণী জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন না৷ তাই ইংল্যাণ্ডে গণতন্ত্র রয়েছে, কিন্তু তা প্রজাতান্ত্রিক নয়৷ আমেরিকা গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিকও, তবে এখানে রাষ্ট্রপ্রধানই জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত৷

যাইহোক, ভারতে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র স্বীকৃত হয়েছে৷ কিন্তু মূল কথা হ’ল ওখানে এই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে জনসাধারণকে সংবিধানগতভাবে যে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে কার্যতঃ আইনের মারপ্যাঁচে সে অধিকার থেকে জনগণ বঞ্চিত৷ যেমন ভারতের সংবিধানে প্রতিটি মানুষের জীবন ও সম্পত্তির অধিকার রয়েছে৷ এটা মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃত৷ কিন্তু বাস্তবে এদেশে অনাহারে, অপুষ্টিতে মরতে হয় হাজার হাজার মানুষকে৷ এই প্রবল শীতে শীতবস্ত্রের অভাবে শতাধিক মানুষকে কুঁকড়ে মরতে হয়েছে৷ সরকার পুঁজিপতিদের স্বার্থে গরীবের জমি কেড়ে নিচ্ছে৷ তাহলে কোথায় গেল প্রতিটি মানুষকে জীবন ও সম্পত্তির মৌলিক অধিকার দানের গালভরা বুলি

মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে অন্যতম প্রতিটি মানুষের শিক্ষা ও সংসৃক্তির অধিকার৷ তাহলে কেন এখনও কোটি কোটি মানুষ অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জমান? ব্যষ্টি স্বাধীনতার অধিকার তথা মত–প্রকাশের অধিকারও যদি মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃত তাহলে কেন শাসক দলের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলে এদেশে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা থাকে না? সংবিধানের বইতে লেখা আছে সাম্য ও ন্যায়ের অধিকার সবাই পাবে৷ কিন্তু এদেশে সত্যই কি এ অধিকার সবাই পায়? তা যে পায় না–এটা দিবালোকের মত সত্য৷ প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা ও বঞ্চনার শিকার ভারতীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র৷ বাস্তবে ইংল্যাণ্ডের সংসদীয় গণতন্ত্রের ফটোকপি করে’ ভারতে তাই চালু করা হয়েছে৷ ভারতের নিজস্ব সভ্যতা, সংসৃক্তি, ভাবধারাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ভারতের স্বাধীনতোত্তর নেতৃবৃন্দ পাশ্চাত্ত্যের অন্ধ–নুকরণ করে কাঙিক্ষত ফল লাভ করতে চেয়েছেন৷ ভারতের মনীষীদের–বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ–এঁদের প্রদর্শিত পথকে দূর থেকে নমস্কার করে’ আমরা অন্য পথে চলেছি৷ নেতাজী সুভাষচন্দ্র এই মনীষীদের আদর্শকে ভারতীয় সমাজে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন৷ সে দিকেও আমরা দৃষ্টি দিই নি৷ নেতাজী যে ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের ওপরে ভিত্তি করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, আমরা সে দিকটাকে একবারও ভেবেই দেখিনি৷ আমরা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেওয়ার পাঠ তুলেই দিয়েছি৷

আমাদের নেতারা স্বাধীনতার পরে কেবল একটা কথাই বুঝেছে৷ আর তা হ’ল ভোটের রাজনীতি৷ ক্ষমতা দখলের রাজনীতি৷ যেন যেতন প্রকারেণ ক্ষমতা দখল করতে হবে৷ একবার ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারলেই আর কোনো চিন্তা নেই৷ সংবিধান, আইন, আদালত সব কিছুই তখন আত্মস্বার্থ–সিদ্ধির মাধ্যম মাত্র৷ জনগণ তখন গৌণ হয়ে যায়৷

এই পরিস্থিতিতে এই জটিল সংকট থেকে সমাধানকল্পেই মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার দিয়েছেন তাঁর নোতুন দর্শন প্রাউট–যার মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের তথা প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন৷ বলেছেন, সেবা, ত্যাগ ও আধ্যাত্মিক নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত মানুষের মাধ্যমে সর্বাত্মক শোষণমুক্ত সর্বাঙ্গসুন্দর সমাজ গড়ার কথা৷ এটাই যুগের দাবী৷ তাই আসুন, প্রাউটের আদর্শকে জেনে জীবন ও সমাজকে এই নোতুন পথে গড়তে এগিয়ে আসুন৷ এছাড়া আজ আর অন্য কোন পথ নেই৷