প্রকৃতির রুদ্ররোষ!  মানুষের দুর্বুদ্ধি!

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

করোনার আতঙ্কে কাঁপছে বিশ্ব৷ বিশ্বায়ণের নূতন পর্ব হয়তো শুরু হল৷ ‘বিশ্বায়ণ’ শব্দটি এতদিন পুঁজিবাদী দুনিয়ার করায়ত্ত ছিল৷ এই বিশ্বায়ণ পুঁজিবাদী দুনিয়ার জন্যে অবাধ বাণিজ্যের দুয়ার খুলে দিলেও সাধারণ নাগরিকের জন্য সি.এ.এ, এন.আর.সির আগল মজবুত করা হচ্ছিল৷ সহজ কথায় তথাকথিত বিশ্বায়ণ বণিক শ্রেণীর বিশ্বের বাজার দখলের, শোষণের হাতিয়ার৷ এই বিশ্বায়ণকে কেন্দ্র করেই উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে চলছে ঠান্ডা যুদ্ধ৷

কিন্তু অতিক্ষুদ্র এক মারণ বাইরাস কোভিড -১৯ সবকিছু লন্ডভণ্ড করে দিল৷ চেকপোস্ট, এন.আর.সি, সিএএ, কোনকিছুই তার কাছে প্রতিবন্ধক নয়৷ চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত অসহায় হয়ে আত্মরক্ষার পথ খুঁজছে৷ কোনো প্রতিষেধক  এই মুহূর্ত পর্যন্ত তার হাতে নেই৷ শুধুমাত্র কোয়ারেন্টাইনের  কক্ষে অসুস্থ  মানুষকে বন্দী করে রোগ-বিস্তার রোখার চেষ্টা চলছে৷ কিন্তু এভাবে আর কতদিন? ইতোমধ্যে ১৬০টিরও বেশি দেশে কয়েক লক্ষ মানুষ এই মারণ বাইরাসে আক্রান্ত৷ মৃত্যুর সংখ্যাও ৮ হাজার ছাড়িয়েছে৷

চীনের উহান প্রদেশ থেকে এই মারণ বাইরাসের যাত্রা শুরু, তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোভিড-১৯কে ফরেন বাইরাস বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকে উহান বাইরাস  বলেও ডাকছে৷ এই শতকের গোড়ায় লন্ডনে এক বিজ্ঞান সম্মেলনে উইলিয়াম স্টুয়ার্ট তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জৈব অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন৷ সেই প্রসঙ্গ উঠে আসছে করোনার প্রকোপে৷ অভিযোগের তীর সেই চীনের দিকেই৷

সমস্যা যতই জটিল হোক সংকট যতই ঘণীভূত হোক, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে গেলেও রাজনীতিবিদরা তার জায়গাতেই অনড় থাকে৷ তাই বিশ্বব্যাপী এই দুর্র্যেগে রাজনীতিবিদরা পরিত্রানের পথ না খঁুজে পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করতে ব্যস্ত রাজনীতির লাভ লোকশানের হিসেব কষে৷ কেউ কেউ করোনা থেকে বাঁচতে গো-বিষ্ঠার বিধানও দিচ্ছে৷ গত প্রায় ৪০০ বছর ধরে বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে  মারণ বাইরাসের দৌড়---একি মানুষের দুর্বুদ্ধি! না-কি  প্রকৃতির রুদ্র রোষ!

একথা সত্য গত ৪০০ বছরে বিজ্ঞানের সৌজন্যে মানুষের অঞ্জলি ভরে গিয়েছে বিপুল ঐশ্বর্য আর বৈভবে৷ কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতি ১০০ বছরে দেখা দেয় মারণ বাইরাসের প্রাদুর্ভাব৷ অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে প্রায় ২০ কোটি মানুষের প্রাণ নিয়েছে বুবোনিক প্লেগ৷ তার ঠিক ১০০ বছর পরে কয়েকলক্ষ মানুষের প্রাণ হরণ করেছে জলবাহিত ব্যাকটেরিয়া কলেরা৷ ১৯১৮-২০ সালে কয়েক কোটি মানুষের প্রাণ নিয়েছে স্প্যানিশ ফ্লু-‘ইনফ্লুয়েঞ্জা৷’  তারপর ২০২০তে আবার মহামারীর রূপধারণ করেছে আর এক মারণ বাইরাস ‘কোভিড-১৯’৷

এত ঐশ্বর্য, এই বৈভব,বিজ্ঞানের নিত্যনূতন আবিষ্কার ও অবদানের আলোর ছটা ধূসর বিবর্ণ হয়ে যায় মারণ বাইরাসের কোপে৷ তবু শেষ হাসি বিজ্ঞানই হেসেছে৷ মানুষের মস্তিষ্কের কাছে মাথা নত করেছে মারণ রোগের জীবাণু৷ তবে বহু মূল্যবান প্রাণেরবিনিময়ে৷ কোভিড-১৯ও কোথায় গিয়ে থামবে, কত প্রাণের বিনিময়ে এখুনি তা বলা সম্ভব নয়, কারণ এই মারণ বাইরাসের প্রতিষেধক এখনো চিকিৎসা বিজ্ঞানের করায়ত্বের বাইরে৷

বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই যে মারণ বাইরাসের দৌড় এর উৎস আজও বিজ্ঞানের অধরা৷ মানুষের সীমাহীন লোভ-লালসা, অদম্য কৌতুহল, সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের আগ্রহ প্রকৃতির ওপর হামলে পড়েছে অপরিণামদর্শীর মতো৷ পরিণতিতে প্রকৃতিও তার পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য হারাচ্ছে৷ ফলে ঝড়, ঝঞ্ঝা, প্লাবন, ভূ-কম্পন--- প্রকৃতির রুদ্ররোষে আছড়ে পড়ছে ধরণীর বুকে, বহে আনছে মারণব্যাধির জীবাণু মদগর্বী মানুষের অহংকারের মুখে ঝামা ঘষে৷ গোদের ওপর বিষ-ফোঁড়ার মতো এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধ বাজ দানবীয় শক্তির জৈবযুদ্ধের দুর্বুদ্ধি৷ যা পৃথিবীকে বিনাশের প্রান্তে দাঁড় করিয়েছে৷

নীতিবাদী ও শুভবুদ্ধি মানুষের সমবেত প্রচেষ্টা ও বিজ্ঞানের যথাযত ব্যবহারই এই বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে৷ নোতুবা বিজ্ঞানের বড়াই ও বিত্তশালীর অহংকার ধূলায় মিশিয়ে দিয়ে মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভবিষ্যৎবাণী সত্য হয়ে উঠবে৷ তিনি বলেছিলেন---‘‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কী দিয়ে হবে তা আমি বলতে পারব না৷ তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে লাঠি ও পাথর দিয়ে৷  অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্কর পরিণতির পর মানুষ পিছিয়ে যাবে প্রস্তর যুগের শুরুতে৷

বিজ্ঞানের সৌজন্যে তথাকথিত সভ্যতা ও পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সমাজের তথাকথিত উঁচুতলার মানুষ দেখেছে তা অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে মহান বিজ্ঞানীর এই ভবিষ্যৎবাণী৷ প্রকৃতির ওপর আধিপত্যের অপচেষ্টায় সভ্যতার বিপদ ঘনিয়ে আসছে, সঙ্গে তথাকথিত  ধর্মীয় মতবাদের ধবজাধারীদের গো-বিষ্ঠার বিধান সভ্যতাকে আরও হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাবে৷

এই অভূতপূর্ব বিপর্যয়ে মানুষের সামনে পথ কি? মানুষ যদি এখনো সজাগ ও সচেতন না হয়ে তবে শুধু কোভিড-১৯ নয় আরও  কত মারণ বাইরাস ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ডেকে আনবে বিজ্ঞানের এই বৈভব! মানুষ কি তবে বিজ্ঞানের চর্চা বন্ধ করে দিয়ে অন্ধকারময় অরণ্যের পর্ণ কুটিরে ফিরে যাবে! এ সম্পর্কে মহান দার্শনিক  ধর্মগুরু, আনন্দমার্গ দর্শনের প্রবক্তা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর বাণী স্মর্তব্য৷ তিনি বলেছেন---‘‘ বিজ্ঞান মানুষের শত্রু নয়৷ মানুষের শত্রু অবিদ্যা৷ সর্বদা কড়া নজর রেখো৷ যেন বিজ্ঞান চর্চা যারা যম-নিয়মে প্রতিষ্ঠিত কেবল তাদের হাতেই থাকে৷’’

অর্থাৎ বিজ্ঞানের চর্চা ও  আধ্যাত্মিক অনুশীলন যেন  পাশাপাশি চলতে থাকে৷ তবেই সব অন্ধকার দুর করে জ্বলে উঠবে নব চেতনার আলো৷ সূচনা হবে মানবজাতির  গৌরবময় অধ্যায় নতুবা প্রকৃতির রুদ্ররোষে ও দানবীয় শক্তির দুর্বুদ্ধিতে মহা বিপর্যয় ঘনিয়ে আসবে৷