প্রসঙ্গ ঃ নারী নির্যাতন

নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে হলে প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাত রঞ্জন সরকারের দু’টো কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছি৷

একটা হ’ল ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা’ (co-ordinated  co-operation), যার একটি কথা হ’ল ‘অন্তরের আগ্রহ ও বাহ্যিক চাপ’ (Internal urge and external pressure)

প্রথম কথাটা বললুম, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ–সহযো’৷ প্রবক্তার নিজের ভাবনা ‘ কো–র্ডিনেটেড্ কো–পারেশান’৷ এটা কেবল সমাজের নারী–পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়, সমাজের সর্বক্ষেত্রেই যেখানে অনেককে নিয়ে আমাদের পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়, সেখানেই এই ‘কো–র্ডিনেটেড্  কো–পারেশান’–টা একান্ত প্রয়োজন৷ এর অভাব হলে অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও অশান্তি দানা বাঁধবেই৷

কো–পারেশান বা সহযোগিতা দু’ধরণের হতে পারে৷  একটা হ’ল প্রভু–ভৃত্য সম্পর্ক সুলভ সহযোগিতা (sub-ordinated co-operation) আর একটা হ’ল বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা (co-ordinated co-operation) প্রথমটিতে কেউ প্রভু, কেউ ভৃত্য৷ এই প্রভু –ভৃত্যের মধ্যেকার সহযোগিতায় একদল মানুষ অন্যদল মানুষের অধীনতায় একক বা মিলিতভাবে কাজ করে৷ পক্ষান্তরে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মানুষদের মধ্যে থাকবে সমানাধিকার, সমান মানবিক মর্যাদা ও সমান মানবিক অধিকার৷ এই সহযোগিতা সম্পূর্ণ স্বাধীন মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধা আর কল্যাণের ভিত্তিতে আধারিত৷

বর্তমান সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী–পুরুষের ক্ষেত্রে এই sub-ordinated co-operationটাই চলছে৷ যদিও পারিবারিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীর ত্যাগ ও নিষ্ঠা পুরুষের চেয়ে কম তো নয়ই, বরং অনেক বেশি, তবু জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনতা, অধিকার সঙ্কুচিত করে রাখা হয়েছে৷ নারীদের যেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হয়৷ আর তাই নারীরা সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবহেলিতা, নির্যাতিতা, শোষিতা৷ এই কারণে সমাজের বহু ক্ষেত্রে কন্যাভ্রূণ হত্যা ঘটনা ঘটে৷ কন্যা সন্তান জন্মালে তার প্রতি পুত্র সন্তানের তুলনায় অবহেলা করা হয়৷ তাদের পড়াশুনার ব্যাপারে বাবা–মা–র আগ্রহ কম থাকে৷ সামান্য কিছু পড়াশোনা করানোর পর বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন৷ তার ওপর তো পণপ্রথার খাঁড়া ঝুলছে তাই আর্থিক অভাবের দরুণ অনেক মেয়ের সহজে বিয়েই হয় না৷ বিয়ের পর পণকে কেন্দ্র করে বা অন্যান্য নানান্ কারণে নব বধূর ওপর শ্বশুর বাড়ীর লোকের অত্যাচার৷ কখনও এই অত্যাচার বধূহত্যার রূপ নেয়৷ কখনও বা বধূকে বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করতে হয়৷ তারপর নারী বিধবা হলে তার ওপর নানান্ সামাজিক বিধি নিষেধের জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দেওয়া হয়৷ পুরুষ বিপত্নীক হলে কিন্তু সে ধরণের কোনো কিছু পুরুষের ওপর চাপানো হয় না৷ এইভাবে বর্তমানে সামাজিককাঠামোতে মেয়েদের নানান্ভাবে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়৷

অপহরণ, ধর্ষণ – এ সমস্ত জঘন্য ক্রিয়াকলাপও আছে৷ এটা বর্তমান সভ্য সমাজের লজ্জা৷ স্বাভাবিকভাবে সমাজের অগ্রগতির পথে এটা অন্তরায়৷

কিন্তু কেন এই নির্যাতন, শোষণ, অবদমন? এর অন্যতম মূল কারণ হ’ল সামাজিক কুসংস্কার ও ভাবজড়তা (ডগ্মা)৷ দ্বিতীয় কারণ, নারীর অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা, তৃতীয় কারণ জড়বাদ তথা পশ্চিমী ভোগবাদী মানসিকতার জোয়ার৷  চতুর্থ কারণ, এই ভোগবাদী মানসিকতাকে বাড়িয়ে তুলছে বর্তমান কর্পোরেট দুনিয়া৷ তাঁদের দৌলতেই আজকে গণমাধ্যমগুলিতে নগ্ণ নারীদেহের বিজ্ঞাপন যা তাদের মুনাফা বৃদ্ধির কলাকৌশল৷ আজকের দূরদর্শন প্রভৃতিতে প্রদর্শিত সিরিয়্যাল ও সিনেমা এই ভোগবাদী মানসিকতার দৃষ্টিকোণ থেকেই বানানো হয়৷ এখানেও লক্ষ্য লাভের অঙ্ক বৃদ্ধি৷

উপরিলিখিত সমস্ত কারণগুলির বিরুদ্ধে আজ দরকার আপোষহীন সংগ্রাম৷ জড়বাদ তথা পুঁজিবাদী শোষণের এই ছলাকলা থেকে সমাজকে যদি না বাঁচানো হয়, তাহলে গোষ্ঠী মানুষের সমাজটাই ধ্বংস হয়ে যাবে, মনুষ্যত্বের লেশমাত্র থাকবে না৷ চলবে শুধু পাশবিকতার পিশাচ নৃত্য৷ সেটাকে মানুষের সমাজ না বলে বরং পশুর সমাজ বলাটাই অধিকতর যুক্তিপূর্ণ৷

না, আমরা মানুষ, মানুষের সমাজকে বাঁচাতে হবে, মনুষ্যত্বর উৎকর্ষ ঘটাতে হবে৷ আর তা করতে হবে মানুষদের মধ্যে ‘ইন্টারনাল আর্জ’ তৈরী করে৷ যথার্থ নৈতিক শিক্ষা তথা আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যমেই মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে৷ এমনি করে মানুষের ভেতর থেকে শুচি–শুভ্র হওয়ার , অন্তরের মধ্যে সত্য–শিব–সুন্দরের প্রকাশ ঘটাবার অনুশীলন চাই৷ কেবল লম্বা লম্বা ভাষণের ফুলঝুরিতে এ কাজ হবে না৷

আর চাই, ‘এক্সটারন্যাল প্রেসার’ অর্থাৎ প্রশাসনিক ও সামাজিক চাপ৷ কেবল কাগজে কলমে আইন থাকলেই হবে না৷ প্রশাসনকে তৎপর হয়ে সমস্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর শাস্তি দিতে হবে৷ ঢ়িলেঢ়ালা প্রশাসনে চলবে না৷ প্রয়োজনবোধে আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে সমাজে শুচিতা বজায় রাখতে হবে  নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সবার ওপরই অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার নির্মূল করতে হবে৷

একদিকে সৎ শিক্ষা, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়ে মানুষের মনের পরিবর্তন ঘটাতে হবে, অন্যদিকে যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে৷ এটাই ‘ইন্টারন্যাল আর্জ এ্যাণ্ড এক্সটারন্যাল প্রেসার’৷ এছাড়া সমাজকে শোধন করার অন্য কোন পথ নেই৷