প্রতিবাদের এই পরানুকরণ ভঙ্গিমা বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ নয়

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

প্রাউট প্রবক্তা শ্রদ্ধেয় দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর যুগান্তকারী প্রাউট তত্ত্বে শোষণের কয়েকটি পর্যায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফ্যাসিষ্ট শোষণ সম্পর্কে বলেছেন---‘ফ্যাসিষ্টদের ক্রুরদৃষ্টি যে জনগোষ্ঠীর ওপর নিবদ্ধ হবে সেই জনগোষ্ঠীকে তারা প্রথমেই চেষ্টা করবে তাদের নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে উৎখাত করতে৷ স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশীয় ফ্যাসিষ্ট শোষকদের ক্রুরদৃষ্টির শিকার বাঙালী জনগোষ্ঠী৷ তাই আজ বাঙলার সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রেই অবক্ষয়৷

একটা জনগোষ্টীকে মাথা উঁচু করে চলতে শেখায়, শোষণ, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা করে প্রতিবাদ করতে অনুপ্রেরণা দেয় তার ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি৷ শুধু তাই নয়, তার সভ্যতার মাপকাঠিও সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশকে মানদণ্ড ধরে নির্ধারণ করা হয়৷ মানব জীবনের বহুমুখী অভিব্যক্তির সমাহার হ’ল সংস্কৃতি৷ আর সভ্যতা হ’ল---‘জীবনের বিভিন্ন অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে যেখানে সংযম রয়েছে, যৌক্তিকতার অভিপ্রকাশ ঘটেছে তাই হচ্ছে সভ্যতা৷’ প্রসঙ্গটা তোলার কারণ বঙ্গ রাজনীতিতে আন্দোলনের নামে বাম-ডান-রাম সব পক্ষই বাঙলার নিজস্ব উন্নত সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে অন্যের অতি নিম্নমানের সংস্কৃতিকে আন্দোলনের, প্রতিবাদের হাতিয়ার করেছে৷ যাদবপুর থেকে জে.এন.ইউ, কলকাতা থেকে দিল্লী সব পক্ষই প্রতিবাদের অঙ্গ ভঙ্গিমায় যে কদর্য রূপ ব্যক্ত করে তার পরতে পরতে আদর্শহীনতার, অশ্লীলতার, কুৎসিৎ আচরণের পরিচয় বহন করে৷ প্রতিবাদের নামে এই কুৎসিৎ অঙ্গভঙ্গী ছাত্র-ছাত্রা ও যুব সমাজের মধ্যেই বেশী পরিলক্ষিত হয়৷

আসলে এই সব আন্দোলন যারা পরিচালিত করছে, সে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধেই হোক আর শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন দাবীদাওয়ার ভিত্তিতেই হোক, তাদের না আছে কোন উচ্চ আদর্শ, না আছে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, না আছে মহৎ লক্ষ্য৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাতের পুতুল হয়ে তাদের অঙ্গুলীহেলনে নাচতে থাকে ওই সব ছাত্রযুবারা৷ রাজনৈতিক দলগুলোরও টিঁকি বাঁধা আছে দেশীয় ফ্যাসীষ্ট শোষকদের হাতে৷ তারা যেমনটি করে টিঁকিটি নাড়ায় নেতারা তেমনটি করে নাচতে থাকে ও তাদের অনুগামীদের সেই ভাবেই নাচায়৷

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় একমাত্র সুভাষচন্দ্র বোস দেশীয় ফ্যাসিষ্ট শোষক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন৷ তাই সেদিন কংগ্রেস, কমিউনিষ্ট, আর এস এস---সমাজবাদী হিন্দুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষবাদী একযোগে সুভাষচন্দ্রের বিরোধিতা করেছিল৷ এই সব দলগুলির রাজনৈতিক রং ভিন্ন হলেও নেতারা সবাই ছিল ফ্যাসিষ্ট শোষকের অর্থে পালিত৷ তাই মুখে সমাজতন্ত্রের বুলি কপচালেও সুভাষচন্দ্রের পাশে থাকেনি  কমিউনিষ্টরা৷ বরং অতি কদর্যভাবে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে রাম-ডান-বাম সব পক্ষই৷

রাজনীতির এই কদর্য সংস্কৃতি আজ বাঙলা তথা ভারতকে গ্রাস করেছে৷ তাই প্রতিবাদের নামে কদর্য শারীরিক অঙ্গভঙ্গী করা, তালি দিয়ে অশ্লীল নাচ, কুৎসিৎ ভাষা ব্যবহার করা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে---যা সম্পূর্ণ বঙ্গ সংস্কৃতির বিপরীত৷ পরাধীন ভারতবর্ষে হিন্দী বলয়ে এই ধরণের রাজনৈতিক অসংস্কৃতি পরিলক্ষিত হলেও বাঙলায় কখনও তা হয়নি৷ দেশবন্ধু সুভাষচন্দ্রের মত নেতাদের সঙ্গে অন্য নেতাদের মতপার্থক্য হলেও কখনও মনমালিন্য হয়নি৷ পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার আসন থেকেও কেউ কখনও সরে যায়নি৷ মিটিং মিছিলেও কোনরকম কদর্য অঙ্গভঙ্গিমা দেখা যেত না৷

সেদিন রাজনীতি ছিল উচ্চ আদর্শে প্রতিষ্ঠিত স্বার্থ শূন্য৷ দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণই ছিল নেতাদের মূল লক্ষ্য৷ আজকের নেতারা সেই আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত৷ ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তারা পুঁজিবাদের দাসত্বও করে৷ অনুগামীদেরও সেই ভাবে গড়ে তোলে৷ এই লক্ষ্যে তারা শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনকেই বেছে নিয়েছে কারণ ছাত্র মস্তিষ্কই হচ্ছে মন মত করে গড়ে তোলার উপযুক্ত আধার৷ তাই যাদবপুর থেকে জওহর- লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিবাদ আন্দোলনের ভঙ্গিমায় রাম-বাম-ডান সব পক্ষই এক পক্ষ৷ কারণ এদের সবাই দেশীয় ফ্যাসিষ্ট শোষকদের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত থাকে৷ তাই এই সব তথাকথিত রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংঘটনের দ্বারা বাঙলার কোন কল্যাণ সম্ভব নয়৷ বঙ্গ সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে বাঙলার উন্নয়নের কথা চিন্তা করা বাতুলতা মাত্র৷

প্রত্যেক জনগোষ্ঠীরই সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশের নিজস্ব রীতিনীতি আছে, আদব-কায়দা আছে যা সেই জনগোষ্ঠীর সভ্যতার মানদণ্ড ঠিক করে দেয়৷ এদিক দিয়ে বাঙলার সভ্যতা যে খুবই উন্নত তা বিস্তৃত বলার প্রয়োজন নেই৷ কিন্তু আজ সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন যে কদর্য রূপ নিচ্ছে, কুৎসিৎ ভঙ্গীর প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে বাঙলার কোন্ কল্যাণ নিহিত আছে তা নেতারাই বলতে পারেন৷ কিন্তু আন্দোলনের এই কদর্য রূপ বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ নয়৷

আজকে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বাম কংগ্রেসের আন্দোলনের নৈতিক অধিকার নেই৷ বিশেষ করে বাঙলায়৷ স্বাধীনতার পর ৫৫ বছরের বেশী সময় দিল্লীতে শাসন ক্ষমতায়ছিল কংগ্রেস, ৬৫ বছর পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও বামেরা শাসন করেছে৷ দেশভাগের পর দিল্লীর কংগ্রেস সরকার ১৯৪৯ সালের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত পঞ্জাবী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সুসম্পন্ন করলেও রাজনীতির স্বার্থে বাঙালী উদ্বাস্তু সমস্যা জিইয়ে রাখে৷ ৬৫ বছর ধরে বাম-কংগ্রেস বাঙালী উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনীতির খেলাই খেলেছে তাদের সমস্যার কোন সমাধান করেনি৷ আজ দিল্লীর শাসক আপামর বাঙালী জনগোষ্ঠীকে উদ্বাস্তু অনুপ্রবেশকারী বানানোর যে ষড়যন্ত্র করেছে তদ্ধার দায় বাম কংগ্রেস অস্বীকার করতে পারে না৷ কারণ সামান্য সদিচ্ছা থাকলে পঞ্জাবীদের মত বাঙালী উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান বিজেপি উত্থানের অনেক আগেই হয়ে যেত৷

ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই যাদের রাজনীতির লক্ষ্য, জনগণ ও তার ভাষা, কৃষ্টি সংস্কৃতির কোন মূল্যই থাকে না ওই সব রাজনীতিবিদদের কাছে, ফ্যাসিষ্ট শোষকদের তুষ্ট করে তাদের উচ্ছিষ্টে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় তাদের জীবন কেটে যায়৷

নাগরিক সংশোধনী আইন কখনই মানা সম্ভব নয়৷ কারণ এই আইন বাঙালীর মধ্যে বিভাজনকে চিরস্থায়ী করে দেবে৷ আন্দোলনের নামে কদর্য অশ্লীল ভাবভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশও সহ্য করা যায় না৷ তাই বাম কংগ্রেসের আন্দোলনে সামিল হওয়াও সম্ভব নয়৷ সি.এ.এ. নয়, এন.আর.সি. নয়, এন.পি.আর.ও নয়, বঙ্গসংস্কৃতির বিসর্জনও নয়৷ বাঙালীকে তার পথ ঠিক করতে হবে বাংলা ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির ঐতিহ্য বজায় রেখে৷ তবেই বাঙলা বাঁচবে, বাঙালী বাঁচবে৷