পশ্চিম রাঢ়ের রাজনৈতিক–সামাজিক প্রেক্ষাপট

লেখক
সমীর সিংহ

(৫) বিহারের জাতীয় কংগ্রেসের নীতিই ছিল বাঙালী বিদ্বেষ৷ কংগ্রেসের নেতা রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে ‘‘বিহার কমিটি’’ তৈরী হয়েছিল৷ রাঢ়ের বাঙলা সুক্লগুলি ধ্বংস করাই ছিল এই কমিটির যেন প্রধান কাজ৷ ভদ্রলোকের মুখোশধারী শয়তানদের বাঙলার দাবীকে নস্যাৎ করার চক্রান্তও এ প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে বলা প্রয়োজন৷

১৯৩৪ সালে বিহার ও ওড়িশাকে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় আর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় রাঢ়ের দুটি খনিজ সম্পদ পূর্ণ এলাকা খরসোয়ান ও সরাইকেলাকে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়৷ রাঢ় বাঙলার মানুষেরা এই দুটি এলাকাকে বাঙলার সঙ্গে যুক্ত করার জন্যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন৷ কিন্তু বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণ সিং গুলি চালিয়ে সেই আন্দোলন দমন করেছিলেন৷ গুলিতে বহু স্থানীয় লোক নিহত হয়েছিলেন৷ অন্যদিকে  – বাঙালী অধ্যুষিত মানভূম, ধলভূম, সিংভূম, রাঁচী ও হাজারীবাগ – এই পাঁচটি জেলাকে ১৯৩৪ সালেই বিহারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ ১৯৪৮ সালে ছোটনাগপুরের বাঙালীরা কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘লোকসেবক সঙঘ’ গঠন করেন ও মানভূম জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ক্রমাগত আন্দোলন চালাতে থাকেন৷ ১৯৫২ সালের নির্বাচনে ‘লোকসেবক সঙঘ’ বিধানসভায় ১০টি আসন ও লোকসভায় ২ টি আসন লাভ করে৷ নির্বাচনে সাফল্যের পর লোকসেবক সঙেঘর এক হাজার কর্মী মানভূম থেকে পদব্রজে কলকাতায় আগমন করেন ও তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানান৷ মানভূমের অধিবাসীদের শতকরা ৯৭ জন বাঙালী৷ এই দাবী উত্তরোত্তর তীব্র হয়ে উঠল৷ ১৯৫৫ সালে হূদয়নাথ কুঞ্জরু, পানিকর ও ফজল আলীকে নিয়ে সীমানা কমিশন বসল৷ সীমানা কমিশনের সামনে কু–পরিকল্পনা মাফিক ভুল মানচিত্র ও বিকৃত তথ্য আর সেই সঙ্গে কয়েকজন মহিলাকে ডানদিক দিয়ে ঘুরিয়ে শাড়ি পরিয়ে সীমানা কমিশনের সামনে অবাঙালী বলে দেখানো হল৷ ভদ্রলোকের মুখোশধারী কেন্দ্রীয় শয়তানেরা এই ভাবে মানভূমের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্তির দাবীকে বাতিল করে দিলেন৷ মানভূম জেলায় ছিল দুটি মহকুমা পুরুলিয়া ও গোবিন্দপুর৷ কৃষিজ ও খনিজ সম্পদহীন অঞ্চল বিবেচনা করে ও আন্দোলনের তীব্রতাকে স্মরণ করে পুরুলিয়া মহকুমার কিছু অংশ ছেঁটে নিয়ে সীমানা কমিশন অবশিষ্ট পুরুলিয়াকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করলেন আর গোবিন্দপুর মহকুমার সঙ্গে অন্য অংশগুলি জুড়ে ধানবাদ নাম দিয়ে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন৷ বর্তমানে পুরুলিয়া হল পশ্চিমবঙ্গের একটি স্বতন্ত্র জেলা৷

মানভূম ছাড়াও ধলভূম, সিংহভূম, রাঁচী ও হাজারীবাগ জেলাকেও স্থানীয় অধিবাসীরা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্তির দাবী জানান৷ ওই সব জেলার ৮৫ শতাংশ অধিবাসী বাঙালী (দ্রষ্টব্য ১৯৫১ সালের আদম সুমারীর রিপোর্ট)৷ এই দাবী নিয়ে ‘ধলভূম মুক্তি সমিতি’ গঠিত হয়েছিল৷ ‘ধলভূম মুক্তি সমিতি’ কর্তৃক ধলভূমের বঙ্গভুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কিশোরী মোহন মুখোপাধ্যায়৷ ‘ধলভূম মুক্তি সমিতি’র ১৭৫ জন সদস্য ধলভূম থেকে পদব্রজে কলকাতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের কাছে স্মারক লিপি পেশ করেন৷ কিন্তু বিকৃত তথ্যের ভিত্তিতে সীমানা কমিশন সে দাবীও নস্যাৎ করলেন৷ এরপরে ১৯৫৬ সালে বাংলার সীমানা সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে ‘সিলেক্ট কমিটি’ গঠিত হল৷ সিলেক্ট কমিটিতে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহেরু, বিদান রায়, শ্রীকৃষ্ণ সিং, হূদয়নাথ কুঞ্জরু ও পানিক্কর৷ এই কমিটির কাছেও পূর্ব পরিকল্পনা ও চক্রান্ত মাফিক বিকৃত তথ্য ও মানচিত্র পরিবেশন করা হয়েছিল৷ ধলভূমের বঙ্গভুক্তির ব্যাপারে নেহেরু নিজেই আপত্তি তুললেন৷ তিনি বললেন ধলভূমের খনিজ সম্পদগুলি টাটা কোম্পানীর সঙ্গে থাকা দরকার৷ ধলভূম খনিজ সম্পদে ভরপুর৷ পটমদা, চাণ্ডিল, ইচাগড়, চন্দনকেয়ারীর কয়লা খনি বিখ্যাত৷ এর মধ্যে আছে যাদুগড়িয়ার ইউরেনিয়ামের খনি, মোসাবনীর তামার খনি ও জামশেদপুরের শিল্পনগরী৷ ধলভূমের অধিবাসীদের শতকরা ৮৮ জন বাঙালী ও মাতৃভাষা বাংলা (দ্রষ্টব্য ঃ ১৯৩১ সালের সেন্সর রিপোর্ট) কিন্তু বাঙলার দাবীকে সিলেক্ট কমিটিও নস্যাৎ করে দিলেন৷ ধলভূমের সঙ্গে সিংহভূমের বঙ্গভুক্তির দাবী বাতিল করা হল৷ অথচ সিংহভূম জেলার শতকরা ৯৬ জন অধিবাসীই বাঙালী৷ ভাষা–জনসংখ্যা–লোকা সব দিক থেকেই সিংহভূম হাজার হাজার বছর ধরে বাঙলার নিজস্ব ভৌগোলিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত৷

 রাঢ়বাসীদের দুর্বিসহ জীবন যন্ত্রণা

দেখা যাচ্ছে রাঢ়কে ধ্বংস করার চক্রান্ত আজকের নয়, আর সে চক্রান্ত আজও চলছে৷ রাঢ়ের যে এলাকা বিশেষ করে ঝাড়খন্ডে ও ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত ওই এলাকার  রাঢ়বাসীরা রাজনৈতিক–সামাজিক শোষণে জেরবার হয়ে নিশ্চিত অবলুপ্তির পথে চলেছে৷ মাতৃভাষা বাংলা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংসৃক্তি লুপ্ত হতে চলেছে, স্থানীয় কর্মকেন্দ্রে রাঢ়ের সন্তানদের চাকরী নেই, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম নথিভুক্ত হয় না কোন বাঙালীর৷ ব্যবসা–বাণিজ্যে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ, শহরাঞ্চলের বাড়ীগুলো ভয় দেখিয়ে দখল করা হচ্ছে, এক কথায় নিজ ভূমে রাঢ়বাসী আজ ‘বিদেশী’৷ প্রকৃতির অফুরন্ত ভাণ্ডার রােে রয়েছে তবু রাঢ়ের মানুষ পেট ভরে পুষ্টিকর খাদ্য খেতে পায় না৷ সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ় আজ অনাহারে জীর্ণ, দুর্দৈবে দীর্ণ, যুগোপযোগী চেতনার অভাবে প্রসুপ্ত৷ এ এক হূদয়বিদারক দৃশ্য৷

আমাদের আবেদন

এমতাবস্থায় পশ্চিম রাঢ়ের আপামর জনসাধারণের কাছে আমাদের আবেদন, আপনারা ধীর মস্তিষ্কে চিন্তা করে দেখুন, বাঙলা মায়ের সন্তান হয়ে আপনারা কী চান? মাতৃভাষা, সংসৃক্তি, মহান ঐতিহ্য, মাথা তুলে বাঁচার অধিকার সবকিছু হারিয়ে কি নিশ্চিহ্ণ হয়ে যেতে চান? তা না হলে ন্যায্য স্বাধিকারের দাবী নিয়ে আজ সবাইকে মাথা তুলে দাঁড়াবে হবে৷

দুঃখের বিষয় বাংলার ভাষা, সংসৃক্তি, ঐতিহ্য নিয়ে একমাত্র ‘আমরা বাঙালী’ দল ছাড়া কোনো দলই ভাবছে না৷ পশ্চিম রাঢ় সহ সারা বাঙালীস্তানেই বাঙালীদের কারুণ দুর্দশা৷ খোদ পঃবাংলার রাজধানী কলকাতা সহ সমস্ত শিল্পাঞ্চলটিকে নিয়ে কেন্দ্র–শাসিত অঞ্চল তৈরী সম্পর্কে হিন্দী–সাম্রাজ্যবাদীদে পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে৷  পঃবাঙলার উত্তরে দার্জিলিং জেলাটিকে বাঙলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিদেশী গোর্খাদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বহু দিনের৷ উত্তরখন্ড রাজ্য গঠনেরও চক্রান্ত চলছে৷ অসমে দীর্ঘকাল ধরে লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে নিজ বাসভূমিতে ‘ডি–ভোটার’ (সন্দেহজনক নাগরিক) বানিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চলছে৷ সম্প্রতি অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এন.আর.সি) নবীকরণের নামে অসেেমর স্থায়ী বাসিন্দা ৪০ লক্ষ বাঙালীকে ‘বিদেশী’ বলে চিহ্ণিত করার ষড়যন্ত্র চলছে৷

সর্বত্রই বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে শোষক পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র সুস্পষ্ট৷ চৈতন্যদেব, রাজা রামমোহন, রামকৃষ্ণ–বিবেকানন্দ্, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজীর বাঙলা ও বাঙালীকে বাঁচাতে আজ সমস্ত বাঙালীদের ঐকবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে৷ মহান ঐতিহ্যপূর্ণ বাঙালীজাতিই পারে বিশ্বমানবতাকে বাঁচাতে৷ তাই বিশ্বমানবতাকে বাঁচানোর তাগিদেই আজ বাঙলা ও বাঙালীকে বাঁচাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে৷