পুঁজিবাদী আগ্রাসন ও নিপীড়িত-মানবতার মুক্তির পথ

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈঠকের আগে বিশ্ববিখ্যাত আন্তর্জাতিক অধিকার রক্ষা সংঘটন ‘অক্সফ্যাম’ বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক  চেহারা নিয়ে একটি তথ্যনির্ভর সমীক্ষা প্রকাশ করেছে৷ ওই সমীক্ষায় ভারতসহ সারা বিশ্বের  ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে---তা এককথায় বিস্ময়জনক৷ বিস্ময়জনক হলেও ধ্রুবসত্য৷

ওই সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়েছে, ভারতের ১শতাংশ বিত্তবানের হাতে রয়েছে দেশে ৫১.৫৩ শতাংশ সম্পদ৷ ১০ শতাংশ বণিক শ্রেণীর হাতে রয়েছে দেশের ৭৭ শতাংশের বেশি সম্পদ৷ অপরদিকে ৬০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের হাতে আছে  মোট জাতীয় সম্পদের  মাত্র ৪.৮ শতাংশ৷ ওই সমীক্ষা থেকে  আরও জানা গেছে, ভারতের ১শতাংশ বিত্তবানের দৈনিক আয় ২২০০ কোটি  টাকা৷ গত বছর ভারতের ১ শতাংশ  বিত্তবানের  সম্পদ বেড়েছে ৩৯ শতাংশ৷ অথচ, এ দেশের  সবচেয়ে  গরীব ৫০ শতাংশ  মানুষের  রোজগার কমেছে ১১ শতাংশ৷ অর্থাৎ ধনীদের আয় ক্রমাগত বিস্ময়কর হারে লাফিয়ে  লাফিয়ে  বেড়ে  চলেছে৷ আর দরিদ্রতম মানুষদের  আয় ক্রমশই হ্রাস পেয়ে  চলেছে৷

অর্থাৎ দেশের যা সম্পদ তা ক্রমবর্দ্ধিত হারে  পুঁজিপতি শ্রেণীর  কুক্ষিগত হচ্ছে৷ কেন এমনটা হচ্ছে? স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও কেন দেশের জনসাধারণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে? দেশের প্রতিটি সম্পদেই তো সমস্ত  মানুষের যৌথ অধিকার  রয়েছে৷ তাহলে কেন তারা এই অধিকার  থেকে বঞ্চিত?

১৯৪৭ সালে ভারতের  আপামর জনসাধারণ যে স্বাধীনতা  পেয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে পূর্ণ স্বাধীনতা নয়, কেবলমাত্র খণ্ডিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা৷ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পায়নি৷ দেশের অর্থনৈতিক শক্তি  পুঁজিপতিশ্রেণীর হাতে আগেও যেমন কুক্ষিগত ছিল, স্বাধীনতার পরেও তাই হয়েছে৷ বড় জোর বলা যায়, স্বাধীনতার  পর শাসকগোষ্ঠীর সহায়তায় শ্বেত পুঁজিপতিদের স্থান পূর্ণভাবে না হলেও  আংশিকভাবে দখল  করেছে৷ বাদামী (দেশীয়) পুঁজিপতিগোষ্ঠী৷  আর সেই  পুঁজিপতিগোষ্ঠী তাদের বিপুল অর্থশক্তির সহায়তায় বিভিন্ন প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলও সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করেছে৷ টাকা দিয়ে বিভিন্ন নেতাকে বশ  করেছে ও অবাধে  তাদের শোষণনীতি চালিয়ে যাচ্ছে৷ পুঁজিপতি অর্থনীতির  মূলকথা তো এইটাই৷ শিল্প-ব্যবস্থা-বাণিজ্য কুক্ষিগত করে ক্রমবর্ধমান মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের পুঁজি বৃদ্ধি করা৷ তার ফলে একদিকে যেমন পুঁজিপতিদের সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ অন্যদিকে স্বাভাভিকভাবে জনসাধারণের সম্পদের পরিমাণ  হ্রাসপাচ্ছে৷  পুঁজিপতিরা কৌশলগতভাবে নিজেরা ও শাসকবর্গের মাধ্যমে  বিভিন্ন সময়ে  বিভিন্নভাবে  দান-ধ্যানের মধ্যদিয়ে  জনগণের  ক্ষোভ প্রশমিত  করে যাচ্ছে৷  এতে তাদের শোষণ-যন্ত্র চালু রাখতে বিশেষ সুবিধা৷

যে মার্কসবাদ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে অনবরত  শ্লোগান দিতে থাকে, সেই মার্কসবাদেও অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণের পথই অনুসরণ করা হয়৷ এখানেও জমি-জায়গা, কৃষিশিল্প-বাণিজ্যের মালিকানা রাষ্ট্রের নামে সরকারের হাতে বর্র্তয়৷ আর সরকারের বেনামীতে তা শাসকদলের কুক্ষিগত হয়৷ এইভাবে  সর্বসাধারণের  হাতে আর অর্থনৈতিক  অধিকার  থাকে না৷ তারা কেবল  মজদুররূপে পরিগণিত হয়৷ এই কারণে মার্কসবাদী অর্থনীতিকে  বলা হয় রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ (ষ্টেট ক্যাপিটালিজম্)৷ জনগণ একইভাবে বঞ্চনার  শিকার হয়ে থাকে৷ উদ্ভব হয় নোতুন এক শ্রেণীর  পুঁজিপতি গোষ্ঠীর---শাসনক্ষমতা যাদের হাতে  রয়েছে৷

আর ভারতের মাকর্সবাদীরা তো অন্যান্য পুঁজিবাদী রাজনৈতিক  দলগুলির মতো পুঁজিপতিদের  হাতেরই পুতুল৷ পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে অতি সুষ্পষ্টভাবে তার পরিচয় পাওয়া গেছে৷

তাহলে জনগণের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা আসবে কী করে? নিপীড়িত মানবতার মুক্তি কোনপথে? হ্যাঁ,যুগের প্রয়োজনে  আজ সেই পথেরই নির্দেশনা দিয়েছেন মহান্ দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার -তাঁর প্রবর্তিত ‘প্রাউট’ দর্শনের মাধ্যমে৷ প্রাউট চায় জনগণের অর্থনৈতিক  স্বাধীনতা --- অর্থনৈতিক গণতন্ত্র৷

তাই প্রাউটের পঞ্চমূল উপযোগনীতির প্রথম নীতিই হ’লঃ কোনও ব্যষ্টিকেই সামবায়িক  সংস্থার সুস্পষ্ট  অনুমতি  বা অনুমোদন  ছাড়া  কোনও  ভৌতিক  সম্পদ Physical Properties) সঞ্চয় করতে দেওয়া হবে না৷ প্রয়োজনাতিরিক্তভাব  বিপুল সম্পদ সঞ্চয় করতে কাউকে দেওয়া যাবে না৷ তবে মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মানুষের  অধিকারহরণ  করা তো চলবেই না, বরং  মানুষকে এক্ষেত্রে বিকাশের পূর্ণ সহায়তা করা হবে৷ দ্বিতীয় মূল উপযোগ নীতিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের যাবতীয় জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক  সম্ভাবনার সর্বাধিক উপযোগ ও যুক্তিসঙ্গত  বন্টন করতে হবে৷ তৃতীয় উপযোগনীতিতে  বলা হয়েছে, সমাজের  প্রতিটি মানুষের  মধ্যে যে শারীরিক, মানসিক  ও আধ্যাত্মিক  সম্ভাবনা রয়েছে  তার বিকাশ  ঘটিয়ে  সমাজের  সামূহিক বিকাশের  কাজে লাগাতে  হবে৷ ....এইভাবে প্রাউটে বিশ্বের  সমূহ সম্পদের সাহায্যে সমস্ত মানুষেরই  শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণকে নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে৷ আর প্রাউটের এই মূলনীতিকে  বাস্তবায়িত করার জন্যে এখানে  সমাজের  প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের  গ্যারান্টি নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে৷ তার সঙ্গে সঙ্গে এও বলা হয়েছে দান খয়রাতের  মাধ্যমে নয়, প্রতিটি মানুষকে এজন্যে উপযুক্ত ক্রয়ক্ষমতা Purchasing capacity) দিতে হবে৷ তারজন্যে প্রাউটের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ব্লকভিত্তিক  পরিকল্পনায়, সসন্তুলিত অর্থনীতি  ও  স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷

তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় পুঁজিবাদ নয়, মাকর্সবাদও নয়, নিপীড়িত মানবতার মুক্তির  পথ একমাত্র ‘প্রাউট’৷ এই প্রাউটকে  জানুন, প্রাউটের  বার্র্ত প্রতিটি  মানুষের  কাছে পৌঁছে দিন৷ প্রাউটের নীতিকে  বাস্তবায়িত করে’ আদর্শ সর্বাত্মক শোষণমুক্ত মানব সমাজ গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত করুণ৷ কারণ এছাড়া কোনও পথ নেই৷