পুঁজিবাদকে  জিইয়ে রেখে দারিদ্র দূরীকরণ হল জংয়ের ওপর রংয়ের প্রলেপ

লেখক
শ্রী শঙ্কর দাশ

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা৷ আপনার নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা এমনই একটা সময়ে হল, যার  মাত্র দিন কয়েক আগে ভারতবর্ষের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহজী পশ্চিমবাংলায় এসে বলে গেলেন বাঙালী কোন পুরস্কারই পায় না৷  আপনার এই নোবেল বিজয়ের ঘোষণা ওনার গালে কষে একটা চপেটাঘাত দিয়ে দিল৷ ওনারা যে বরাবরই বাঙালীর গৌরব গাঁথায় জ্বলে পুড়ে মরেন, হিংসায় জ্বলেন, তা আরো একবার প্রমাণিত হ’ল৷ আপনাকে নিয়ে  তিন তিন জন বাঙালী অর্থনীতিতে  নোবেল পুরস্কার  এনে দিয়ে বাঙালী জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন৷ সত্যদ্রষ্টা ঋষি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ভবিষ্যতবাণী

‘‘অতীতে যাহার হয়েছে সূচনা

               সে ঘটনা হবে হবে

বিশ্বভূবন ভরিবে আবার

               বাঙালীর গৌরবে’’

সত্য হতে চলেছে৷

               অতুল প্রসাদ সেন বলেছেন,

‘‘ভারত আবার জগৎ সভায়

               শ্রেষ্ঠ আসন লবে৷’’

আর শ্রেষ্ঠ আসনটি ভারতকে অবশ্যই বাঙালী জাতিই এনে দেবে৷ সত্যদ্রষ্টা ঋষি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তো  বলেই রেখেছেন ---

‘‘বাঙলার ছেলে জিনিবে ভুবন

জড়মুখী নয়, হরিমুখী করি মন৷’’

একজন  বাঙালী হিসেবে আমি গর্বিত৷

বর্তমান লেখাটি পড়ে বলে বসবেন, বাঙালীর স্বভাবই হল কাঁকড়ার মতো৷ কাউকে কেবল টেনে হিঁচড়ে নীচে নামিয়ে দেওয়া৷ কারোর উত্থানে কেবল সমালোচনা করা৷ এখনও তো পুরস্কারটি  হাতে  আসেনি, তার আগেই সমালোচনা শুরু হয়ে গেল৷ তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, এই সমালোচনা করার গুণ যদি একমাত্র বাঙালী জাতিরই থেকে থাকে, তবে  বলব, সমালোচনার  করার এই মহৎ গুণই বাঙালী জাতিকে মহান বানিয়েছে৷ এই মহান গুণই বাঙালী জাতিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতির আসনে উন্নীত করেছে৷ কারণ, একের সমালোচনা অন্যের বৌদ্ধিক উৎকর্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে৷ তাই এই সমালোচনাকে আমি একটা নিছক সমালোচনা বলে মেনে নিতে রাজী নই৷ এই সমালোচনাকে আমি ‘সংঘর্ষ ও সংসক্তি বলেই সম্মান দিতে রাজী৷ যে জাতির মধ্যে সমালোচনার  মতো ‘সংঘর্ষ ও সংসক্তি’’ নেই, সেই জাতি উন্নত জাতি হতে পারে না৷ এই ‘সংঘর্ষ’ ও সংসক্তি’’ই বাঙালী জাতিকে সংশ্লেষণের পথ দেখাচ্ছে৷ এই সংশ্লেষণের পথই বাঙালী জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা এনে দিয়েছে, দিচ্ছে ও ভবিষ্যতে আরও ব্যাপকভাবে এনে দেবে৷ এব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ চিত্ত৷ তাই বর্তমান লেখাটি নিছক সমালোচনা হিসেবে কেউ যেন না দেখেন -এই আমার  বিনীত অনুরোধ৷

আপনারা  অনেকেই ইতোমধ্যে  জেনে গেছেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্র্য দূরীকরণের নোতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন৷ হ্যাঁ, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যাই হল দারিদ্র্য৷ এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আজকের ভারতে প্রায় বিশ কোটি মানুষ অনাহারে থাকে৷ যারা ভারতের অর্থনীতির সামান্যতমও খবর রাখেন, তারা  কালাহাণ্ডি নাম অবশ্যই জানেন৷ শুধু বাঁচার তাগিদে সেখানকার মানুষ ঘাস শুকিয়ে ছাতু করে রুটি বানিয়ে খেতে বাধ্য থাকেন৷ পশ্চিমবঙ্গের  পুরুলিয়া  জেলার মানুষ বছরে  পাঁচ মাস ঘাসের বীজ খেয়ে বেঁচে থাকেন৷ আফ্রিকার  অধিকাংশ অঞ্চলের মানুষ ইঁদুর খেয়ে জীবনধারণ করেন ৷ টিউনিশির জেলের ভিতরে জায়গার তুলনায় বহুগুণ বেশী কয়েদী থাকায় ও খাদ্যের পরিমাণ অতি সামান্য হওয়ায় কয়েকজন মিলে একজনকে মেরে মানুষের কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকছেন৷ ভাবা যায়, কী দুর্বিষহ পরিস্থিতি! নোবেল পুরস্কারে ভূষিত অর্থনীতিবিদ ডঃ অমর্ত্য সেন তাঁর ‘‘জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি’’ সপ্তম খণ্ডে বিশ্বাব্যাপী খাদ্যাভাবজনিত অপুষ্টির চিত্র তুলে ধরেছেন৷ বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক সরণী তুলে ধরেছেন৷ তিনি নোবেল পেয়েছেন ১৯৯৮ সালে৷ সুদীর্ঘ এতো বছরেও কি বিশ্বব্যাপী অপুষ্টি দূর করা গেল না? না,যায়নি, বরং অনাহার, অর্ধাহার ও অপুষ্টির পরিমাণ বেড়েই চলেছে৷ নোবেল পুরস্কার  পাওয়ার মতো অর্থনীতিবিদগণের চিন্তা ভাবনাও  কি তাহলে  বিশ্বব্যাপী অনাহার দূর করতে পারছে না? তাহলে বছর বছর ঘটা করে এতো মূল্যাবান পুরষ্কারে ভূষিত  করার সার্থকতা কোথায়? প্রশ্ণ আছে, উত্তর নেই৷ অভিজিৎ বিনায়ক  বন্দ্যোপাধ্যায়ের দারিদ্র্য দূরীকরণের নোতুন দৃষ্টিভঙ্গি কি দারিদ্র্য দূর করতে সমর্থ হবে! আমি জোর দিয়েই বলতে পারি, না৷ একদমই না৷ এই কথাটাকেই অনেকে আমাকে কাঁকড়ার  জাতি বলে গাল দিতে পারেন৷ তা দিন৷

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, তাঁর থিউরি কীভাবে  বাস্তবায়িত হবে তিনি জানেন না৷ অমর্ত্য সেনও দিল্লীতে সাংবাদিকের এক প্রশ্ণের জবাবে এই  একই উত্তর দিয়েছিলেন৷

গতকাল (১৪/১০/২০১৯) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের ডুবন্ত অর্থনীতিকে বাঁচানোর  জন্যে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন ,  (India should tax the riches and wealthy and more)৷ এই কথাটিই  আমাকে বর্তমান লেখাটি লিখতে বাধ্য করল৷ তাঁর এই প্রস্তাবটি সরাসরি পুঁজিপতিদের শোষণকে আরও বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে৷ কীভাবে, বিশ্লেষণ করি৷

একথা কেউ মানুন, বা না মানুন, কিন্তু দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট যে, কোন ধনী (শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরাই মূলতঃ ধনী) ও কোনো সরকারী কর্মচারী কখনই কোনো ট্যাক্স দেন না৷ বাহ্যতঃ দেখা যায় তারাই  ট্যাক্স দিয়ে থাকেন, কিন্তু বাস্তবটা হ’ল তাদের প্রদেয  ট্যাক্সের টাকার সবটাই আসে জনসাধারণের কাছ থেকে৷ শিল্পপতি তার উৎপাদিত দ্রব্যের গায়ে যে মূল্য নির্ধারণ করেন, তাতে তার অধিক লাভের পরে বিভিন্ন ট্যাক্স যেমন, শিল্প-লাইসেন্স, উৎপাদন ট্যাক্স, সেইল ট্যাক্স, রোড ট্যাক্স, সেস ট্যাক্স আরও বহুরকমের ট্যাক্সের  টাকাও  দ্রব্যমূল্যে ধার্য্য করে রাখেন৷ ভোক্তা তথা সাধারণ জনগণ যখন সেই দ্রব্য ক্রয় করেন, তখন এই বহু রকমের ট্যাক্সের টাকাটা দিয়ে ক্রয় করেন৷ অর্থাৎ শিল্পপতিদের বিভিন্নরকম ট্যাক্সের দায়ভার সরাসরি ভোক্তা তথা সাধারণ জনগণের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হয়৷ ঠিক তেমনি একজন ব্যবসায়ীও তাই করেন৷ দ্রব্যের মূল্য যতই বাড়ুক না কেনো, তার লাভে কোন কমতি হয় না (যদি বিক্রির   পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে)৷ বরং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে তার লাভ বেড়েই থাকে৷ এখানেও কোপ পড়ল সেই ভোক্তার ঘাড়েই৷ আর রইল বাকী, সরকারী অনুৎপাদন সংস্থার কর্মচারীদের দেওয়া ট্যাক্সের কথা৷ যেহেতু সরকারী কর্মচারীদের বেতনটা আসে ভোক্তারূপী সাধারণ জনগণের দ্রব্যক্রয়ের মাধ্যমে ট্যাক্সের টাকা থেকে, তাই তারা বেতন  থেকে ট্যাক্স হিসেবে যে টাকাটা দিয়ে থাকেন সেটাও সরাসরি জনগণের টাকা৷

এবার দেখুন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাব অনুসারে ধনী ও বিত্তশালীদের থেকে ভারত সরকার ট্যাক্স নেওয়া বাড়িয়ে দেন, তবে ধনী ও বিত্তশালী নামান্তরে শিল্পপতিগণ তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যও বাড়িয়ে দেবেন৷  আর এই রাম-দায়ের  কোপটা সরাসরি জনগণের ঘাড়েই পড়বে৷ এমনিতেই মন্দার কারণে ও দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকার কারণে সাধারণ মানুষের  হাতে টাকা এক মারাত্মকভাবে কম আসছে,তার ওপর এই প্রস্তাব দারিদ্র্য দূরীকরণ নয়, দারিদ্র্যকে আরও সুস্বাগতম জানাবে৷ এই প্রস্তাব পুঁজিবাদী শোষণকে আরও বাহবা দেওয়ার সামিল৷ সংশ্লেষাত্মক স্পষ্ট কথাটি হল, পুঁজিবাদকে জিইয়ে রেখে দারিদ্র্য দূরীকরণ যেমন করা যায় না, তেমনি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি  শব্দ ব্যয় করলে ‘‘নোবেল’’ পুরষ্কারও পাওয়া যায় না৷ এক কথায়, পুঁজিবাদকে জিইয়ে রেখে দারিদ্র্য দূরীকরণ হল, ‘জংয়ের ওপর রংয়ের প্রলেপ দেওয়া৷