রাষ্ট্রহীন নাগরিক---অমানবিক রাষ্ট্র

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

গিলোটিন, গ্যাস চেম্বার নরহত্যার নানা নৃশংস পদ্ধতি ইতিহাসে উল্লেখ আছে৷ কিন্তু মানুষকে এমন তিলে তিলে দগ্ধে দগ্ধে মারা এও তো কম নৃশংস নয়৷ কার দোষ আর কে বলি হচ্ছে! সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মধ্যযুগীয় বর্বরতার চেয়ে এ কম কীসে? অসহায় মানুষগুলোর কি দোষ! দোষ যদি কারো হয় সে তো রাষ্ট্রের কর্ণধারদের৷ ক্ষমতার লিপ্সা, সাম্প্রদায়িক জিঘাংসা, অপরিণামদর্শী দিশাহীন নেতৃত্ব, বিভেদ, সংঘাত আর দায়ী দেশভাগ৷ তবু সেই নেতৃত্বকে কোন জবাব দিতে হয়নি৷ কোনও প্রমাণ দাখিল করতে হয়নি৷ নিস্ব হয়ে আদালতের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াতে হয়নি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায়৷

একটা চেকপোষ্ট আর একটা ভিত্তি বর্ষ ঠিক করে দেবে কে কোন্ পারের? তাতেও তো শেষ নয়৷ নাগরিকত্বহীন করতে আরও অনেক অমানবিক উপায় নেওয়া হয়েছে৷ সেই যাঁতাকলে পড়ে কোথাও পিতামাতা নাগরিক তো সন্তান বিদেশী৷ আবার উল্টোটাও হয়েছে৷ এমনও নজির কম নয়, যেখানে পূর্বপুরুষ দেশের জন্যে সংগ্রাম করতে করতে মৃত্যুবরণ করেছে, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, সেনা অফিসার আর তারও উত্তরপুরুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে যায় অমানবিক আইনের প্যাঁচে৷ সব খবর খবরে আসে না৷ কত জন আত্মহত্যা করল, কত সব হারিয়ে নিঃস্ব হ’ল, শুধুমাত্র রাষ্ট্রের নাগরিক হবার আশাকে বুকে নিয়ে৷ তার খবর কে রাখে! আত্মসুখ সর্বস্ব মানুষ নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত৷ তাই ১৯ লাখের জ্বালার মাঝে মিষ্টি বিতরণের নাগরিকের অভাব হয় না৷

জ্বালার মাঝেও আশার কথা ১২০ দিন সময় আছে---ট্রাইব্যুনালে যাও, সেখানে না হলে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট তো আছে৷ পোড়া কপাল! বোটের (ভোট) হিসাব ছাড়া রাষ্ট্রের কর্ণধাররা রাষ্ট্রবাসীর (নাগরিক হোক বা না হোক) কোনও খোঁজই রাখে না---ভাবতে কষ্ট হয় রাষ্ট্র নেতারা কি শুধুই অজ্ঞ? না, তারা চরম অমানবিক৷ ১৯ লাখের ক’জনের পক্ষে সম্ভব যে ট্রাইব্যুনালে যাবে? হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার আর্থিক ক্ষমতা কি তাদের আছে? গিয়েই বা কি হবে? নতুন করে তো আর প্রমাণ করার কিছু নেই?

গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত যন্ত্রণা৷ যখন মনে হয় এন আর সি-র কোপটা শুধু কি একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্যে? সেই জনগোষ্ঠী---দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের বলিদান, অবদান প্রশ্ণাতীতভাবে অনেক অনেক বেশী৷ তাই মনে হয় কোপটা বিদেশীদের ওপর, নাকি একটি জনগোষ্টীর ওপর! সে কী শুধু বাঙালী বলে? স্বদেশী-বিদেশী চিহ্ণিতকরণের প্রক্রিয়াতেও কত গলদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ তাই সততই মনে একটা প্রশ্ণ---সরকারের প্রকৃত ইচ্ছাটা কি? দেশকে বিদেশী মুক্ত করা, না কি অন্য কিছু, অন্য কোনও উদ্দেশ্য! উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয় তবে বিদেশী চিহ্ণিত করতে বা নাগরিকত্ব দিতে এত জটিলতা কেন? এতো গরীব হতচ্ছাড়া মানুষগুলোর ওপর চরম জুলুম৷ যেখানে এক বিদেশী অভিনেত্রী সহজেই নাগরিকত্ব পেয়ে যায়, সেখানে সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে যারা চলে আসতে বাধ্য হয়েছে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে, তাদের প্রতি কেন রাষ্ট্রের এই অমানবিক আচরণ! বিদেশী হোক বা রাষ্ট্রের নাগরিক হোক, অসহায় মানুষগুলোকে চিহ্ণিত করতে কেন এত হয়রানি হতে হচ্ছে৷ কেন তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে গিয়ে নিঃস্ব রিক্ত হতে হচ্ছে৷ সহায় সম্বল যেটুকু আছে সব রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছে জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে? যদি ধরে নিই এরা বিদেশী কিন্তু একটা সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে তারা কি একটু মানবিক ব্যবহার পেতে পারে না! ১৯ লক্ষ মানুষের চোখের সামনে আজ শুধুই এক অজানা অভিশপ্ত অন্ধকার৷ সামনে হিংস্র দুঃসময়ের ছবি, বিভীষিকার পথ৷ তবে মনে রাখতে হবে এ পথ যতই হিংস্র হোক, যতই বিভীষিকাময় হোক উত্তীর্ণ হবার পথও আছে৷ সেই অসহায় রাষ্ট্রহীন মানুষগুলোকে সেই আলোর পথই খুঁজে নিতে হবে৷