শৈব বাংলায় বিকৃত সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে

মানস দেববাংলার কৃষ্টি সভ্যতা সংস্কৃতি আজ চরম সংকটের সম্মুখে৷ বাংলা সালের শেষ মাসের শেষ দিন৷ বছরের এই সময়টা বাংলা উত্তাল থাকে শিবের গাজনে৷ গর্জন শব্দ থেকে গাজন শব্দটা এসেছে৷ বছরের এই সময়টা বাঙলার সাধারণ মানুষ চৈত্র গাজনে মেতে থাকে, কিন্তু এবার বাংলা সালের শেষ দিন বিভিন্নস্থানে অস্ত্রহাতে ডিজে আর রাম রাম (বিকৃত হয়ে কানে বাজছিল ভাম ভাম) চিৎকারে যে লুম্পেন নাচ চলল তা একথায় বলা যায়, বাংলা ভাষা সংস্কৃতির উপর গণধর্ষণ৷ অবাক লাগল যারা এই নৃত্য করল তারা অধিকাংশই ভিনরাজ্যের,দাঁড়িয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল মূলতঃ বাংলা ভাষী মানুষ৷

মনে হয় দেশীয় পুঁজিপতি গোষ্ঠী বাংলা ও বাঙালীকে ধবংস করার যে চক্রান্ত স্বাধীনতার অনেক আগে থেকে নিয়েছে, সেই চক্রান্তের ষোলকলা পূর্ণ হয়ে এল বলে৷ কয়েক বছর আগেও  রাম হনুমান বাঙলা মহাকাব্যের পাতায় সীমাবদ্ধ ছিল৷ বাঙলার সভ্যতা মূলতঃ শৈব তন্ত্র ভিত্তিক সভ্যতা৷ আজ থেকে প্রায় ৭ হাজার বছর আগে সদাশিব আবির্ভূত হয়েছিলেন ভারতে৷ তিনি সভ্যতার জনক ও জাতির পিতা৷ তাঁর সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন, সাধারণ মানুষের কাছে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল৷ তাই শিব ছিলেন সর্বসাধারণের প্রাণের দেবতা৷ শৈব প্রভাবেই বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ চেতনায় ভারতের অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে অনেক এগিয়ে যা পুঁজিপতি শাসকগোষ্ঠীর মোটেই কাম্য নয়৷ কারণ শৈব প্রভাবে সমাজ চেতনা সম্পন্ন জনগণকে শোষণ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে৷ তাই তারা শিবকে সরিয়ে মহাকাব্যের দুই চরিত্র রাম হনুমানকে সামনে এনেছেন, তাই রাম মূলতঃ দেশীয় পুঁজিপতিদের দেবতা৷ তারা উত্তর ও পশ্চিমভারতে রামকে জনপ্রিয়তার আসনে বসাতে পারলেও দক্ষিণপূর্ব ভারতে  রামের অনুপ্রবেশ ঘটেনি৷ দক্ষিণভারতে সম্ভব না হলেও  আজ পূর্বভারতে  অনেকেই সফল হয়েছে৷ এর পেছনে  রাজ্য সরকারেরও কিছুটা অবদান আছে৷ তারা বিজেপিকে রুখতে রামের পাল্টা রাম পূজোতেই মেতেছে৷ এতে বিজেপির পথ আরও সুগম হয়েছে৷ আমার মনে হয় রামকে ছেড়ে শাসকদলের নেতারা যদি শিবকে ধরে গাজন উৎসবে মাততেন তাতে বিজেপির মতো তীব্র বাঙালী বিদ্বেষী ও হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীর প্রতিভু  দলকে  রোখা অনেক সহজ হতো৷ তা না করে  যেভাবে শাসকদল  রাম পূজা ও হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মেতেছে তাতে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিকৃত সংস্কৃতির স্রোত প্রবেশের পথ পেল৷ সবচেয়ে করুণ অবস্থা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালীর, তারা যেন মুক বধির হয়ে গেছিল৷

পরম শ্রদ্ধেয় দার্শনিক ঋষি শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার  বাংলার দুরাবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনটি প্রশ্ণ তুলেছিলেন৷ সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় ছিল প্রশ্ণগুলি আমি সেভাবেই লিখছি, শব্দগত ও ব্যাকারণগত ভুল থাকলে সে ত্রুটি আমারই৷

প্রশ্ণ তিনটি এইরকম---‘‘কথং দলিত সি’’? ‘‘কথং মুকাসি’’? ‘‘কথং ক্রন্দ্রসি’’? মাতো বঙ্গভূমি৷ কেন তুমি শোষিত? কেন তুমি বোবা? কেন তুমি কাঁদছ? মা আমার বাংলাভূমি৷ কথাগুলোর তাৎপর্য সেদিন বুঝিনি৷ আজ বর্ষশেষের বিকেলে সারা বাঙলা জুড়ে যে উদ্যাম নাচ ও রাম রাম চিৎকার, অপরদিকে বাঙালীকে নীরব দর্শক দেখে উপরের প্রশ্ণগুলি মনে এল৷ প্রশ্ণগুলিতো শুধু বাঙলা মাকে নয়৷ দেশ মাতৃকাতো একটি ভৌগোলিক সীমামাত্র৷ পূর্বে আরাকান থেকে পশ্চিমে পরেশনাথ পাহাড়, উত্তরে হিমালয়ে  ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে মাটির মানুষের কাছে প্রশ্ণগুলি৷ তাদের চোখের সামনে তারই ভাষা-সংস্কৃতির ওপর এই নির্যাতনে নীরব দর্শক হয়ে থেকে গেল৷ এই অবস্থা বেশীদিন চলতে দিলে বাঙালীর অস্তিত্বই বিপন্ন হবে৷ বাঙালী কোনদিনই রামভক্ত ছিল না৷  বাঙলার প্রতি গ্রামে আজও শিবমন্দিরই অবস্থিত৷ তবু সেই বাঙলায় ভিনরাজ্য থেকে রাম কালচার অনুপ্রবেশ করিয়ে  বাংলা ভাষাকৃষ্টি-সংস্কৃতিকে ধবংস করার এ এক বিরাট চক্রান্ত৷ অবিলম্বে  রাম নামের এই বিকৃত সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে না পারলে বাংলাভাষা কৃষ্টি-সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়বে৷