স্বাধীনতা--- এ কেমন স্বাধীনতা!

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

ভারতের স্বাধীনতা সত্তর বছরে পদার্পণ করল৷ হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি তার সামগ্রিক সুফল এই সত্তর বছরেও প্রকৃত অর্থে উপলব্ধ হয়নি৷ এখনও দেশের অধিকাংশ মানুষ সুশিক্ষিত হয়ে ওঠেনি৷ যদিও বিভিন্ন ভাবে সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করারও ছোটদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্যে দ্বিপ্রাহরিক খাদ্য, শিক্ষা সংক্রান্ত কিছু সুযোগ সুবিধা ইত্যাদির মাধ্যমে বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা চলছে৷ কিন্তু সমগ্র দেশের এক ও অভিন্ন সু-সংহত প্রকল্প না থাকার ফলে সেই প্রয়াস সাফল্যমণ্ডিত হচ্ছে না৷ শুধু তাই নয়, এখনও গ্রামে গঞ্জে প্রান্তিক মানুষজন বিশ্বাস করেন, একটি শিশুর যেমন খাওয়ার জন্য একটি মুখ আছে তেমনি কাজ করার জন্য  দুটি হাতও আছে৷ ফলে বাল্যাবস্থাতেই একটূ শক্তিসঞ্চয় করে পরিশ্রম করার উপযুক্ত হলেই ক্ষেতে, খামারে, দোকান বাজারে, খাবারের দোকানে, বিভিন্ন ছোট ছোট কলকারখানায় তারা রুজি রোজগারের আশায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে৷

সরকারী ভাবে যতই শিশু-শ্রম নিরোধক আইন বলবৎ থাকুক না কেন পারিবারিক ও আস্তিত্ত্বিক প্রয়োজনে শৈশবের শিক্ষা, চপলতা, কমনীয়তা সবই হারিয়ে যাচ্ছে৷ পরবর্তীকালে তারা বিবিধ মারণ রোগের শিকারও হচ্ছে৷ সামগ্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে যতদিন না সাধারণ মানুষেরআর্থিক সঙ্গতি ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির রসদ সকলের আয়ত্তের মধ্যে আসবে ততদিন এই শিশু-শ্রম ও অশিক্ষার অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতি মুক্ত হতে পারবে না৷ শুধুমাত্র দারিদ্র সীমারেখা নির্দ্ধারণের নূ্যনতম আয়ের হেরফের ও মাথাপিছু আয় per-capita income) দিয়ে দেশের নাগরিকগণের দুঃখ-দুর্দশার নিরসন সম্ভব নয়৷

দেশের কতিপয় ব্যষ্টি বা গোষ্ঠীর হাতে শতকরা আশি শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত ও কোটি কোটি মানুষ বেকারত্ব, অর্ধবেকারত্ব, সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করলে সমাজের অসাম্য দূর করা কখনই সম্ভব নয়৷ ধনতন্ত্র বা সাম্যবাদ কোনটাই দেশের মানুষকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না৷ কেবলG.D.P বা সামগ্রিক সম্পদ দিয়ে দেশের মানুষের সুখ-সাচ্ছন্দ্যের বিচার করা যাবে না৷ সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের লাঘব করতে গেলে বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিসঙ্গত সম্পদ বণ্টন ও প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের সার্থক প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিটি ব্যষ্টির ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে ও জীবনধারণের নূ্যনতম প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷

দ্বিতীয়তঃ এই সত্তর বছরের স্বাধীনতার পরও দেশের মানুষ ধর্ম-ইজম্-জাত-পাতের বিষম অভিশাপ ও তৎ সঞ্জাত শিক্ষা, চাকুরী, পদোন্নতি ইত্যাদিতে কোটা সংরক্ষণের বিষবৃক্ষের কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি বরং এই বিষবৃক্ষ ক্রমশঃ সমাজের সর্বস্তরে এক বিরাট মহীরুহের আকার ধারণ করেছে৷ সংরক্ষণ একমাত্র সর্বনিম্ন শতাংশে হওয়া উচিত৷ কিন্তু বর্তমানে তা ৫০ শতাংশের দোড়গোড়ায় উপনীত৷ দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাগণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই অভিশাপকে বয়ে নিয়ে চলেছেন ও সমাজের সর্বাত্মক সর্বনাশ সাধন করছেন৷ এর ফলস্বরূপ দেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটিতে মেতে উঠেছে ও বহু নিরীহ মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করেছে৷ রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়ে মুষ্টিমেয় অপরিণামদর্শী নেতৃবৃন্দ দেশকে চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে৷

তৃতীয়তঃ স্বাধীনতার জন্যে হাজার হাজার দেশপ্রেমিকের আত্মবলিদান সত্ত্বেও তৎকালীন কতিপয় স্বার্থান্বেষী, ও অপরিণত বুদ্ধি, বিচক্ষণতাহীন নেতৃবর্গের কু-বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের কারণে দেশভাগের বিনিময়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়৷ যার কুফল সমগ্র দেশ বিশেষতঃ পঞ্জাব ও বাঙলা বহন করে চলেছে৷ লক্ষ লক্ষ মানুষের কান্না, মৃত্যু, নির্যাতন, নিপীড়ন, সহায়-সম্বলহীনতায় সমগ্র দেশের আকাশ বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে যার কবল থেকে আজও দেশ মুক্ত হতে পারেনি৷ আজ সত্তর বছর পরেও বহু মানুষ নিজ ঘরে পরবাসী হয়ে রয়েছেন৷ মানুষকে মানুষ রূপে বিচার না করে কেবলমাত্র রাজনীতির দাবার বোড়ে হিসাবে দেখার বিষময় ফল ক্রমশ সমগ্র দেশকে গ্রাস করে চলেছে৷ দিকে দিকে জেগে উঠেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, দুষৃকতি সমৃদ্ধ সংঘটন দেখা যাচ্ছে নারকীয় হত্যালীলা, খুন-জখম, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে হানাহানি, নারী জাতির অমর্যাদা ইত্যাদি৷ প্রতিদিন সংবাদপত্রে , টিভি.তে বিভিন্ন রকম অসামাজিক, অনভিপ্রেত কাণ্ডকারখানারসংব, প্রতিবেদন মুদ্রিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে, যা অসুস্থ সামাজিক প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলে৷

প্রকৃতপক্ষে মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখে ভোগবাদী জীবনের উপকরণ হিসেবে দেখার কুফল আজ আমাদের সামনে পরিস্ফূট৷ এই অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জীবনচর্চায় এক বলিষ্ঠ পরিবর্তন আনতেই হবে৷ আর তা করতে হলে গ্রহণ করতে হবে এক সর্বানুসূ্যত আদর্শ যা মানুষকে শেখাবে নব্যমানবতাবাদ ও বিশ্বৈকতাবাদের মন্ত্র৷  মনে রাখতে হবে বিশ্বপিতা সকলের পিতা৷ সমগ্র বিশ্বই মানুষের বাসস্থান ও বিশ্বের সমগ্র সম্পদে সকলের সমান অধিকার৷ একথাও স্মরণে রাখতে হবে যে, বিশ্বের সম্পদ বিশাল হলেও সীমিত৷ কিন্তু মানুষের আকাঙ্খা অসীম৷ এই অসীম চাওয়াকে অনন্ত আধ্যাত্মিক জগতে পরিচালিত করেই অনন্ত চাওয়ার পরিতৃপ্তি সম্ভব৷ আর ভৌতিক সম্পদকে সকলে মিলেমিশে ভোগ করে নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির ব্যবস্থা করতে হবে৷ একমাত্র এই ভাবাদর্শের মাধ্যমেই মানুষের ভৌতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক প্রগতি সম্ভব ও সত্যিকারের মানব সমাজ তখনই গড়ে উঠবে৷ এই জীবনাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সকলে মিলে সার্বিকভাবে প্রয়াসী হতে পারলেই স্বাধীনতার প্রকৃত পরিপূর্ণতা সম্ভব৷ নান্যপন্থা বিদ্যতে অয়নায়৷