স্বাধীনতার বলি বাঙলা ও বাঙালী

লেখক
সত্যসন্ধ দেব

১৫ আগষ্ট৷ প্রতিটি ভারতবাসীর  জন্যে আনন্দের  দিন কারণ এদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে দেশ  মুক্ত হয়েছিল৷ ভারতের স্বাধীনতার জন্যে সংঘটিত ভাবে প্রথম প্রবল আন্দোলন শুরু হয়েছিল  এই বাঙলায়৷ শ্রী অরবিন্দের নেতৃত্বে ইংরেজ শাসকের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবকে উপলক্ষ্য করে ব্রিটিশ বিরোধী সেই আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিৎ৷ ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের  উদ্দেশ্যে বোমা মারতে গিয়ে  শহীদ হন ক্ষুদিরাম  ও প্রফুল্লচাকী ৷ সেদিন  ওই গাড়ীতে  কিংসফোর্ড ছিলেন না৷ তাই তিনি বেঁচে গেলেন৷ বোমা মেরে  দুই বিপ্লবী পালিয়ে যান৷ ঘটনাটি ঘটে ১৯০৮ সালের ৩০ শে  এপ্রিল৷ প্রফুল্ল চাকীকে যখন পুলিশ ধরতে  যায়,  তখন তিনি নিজের  রিভলবার  দিয়ে ‘আত্মহত্যা করে শহীদ হয়ে যান৷  ক্ষুদিরামের  হাত থেকে রিভলভার  পড়ে যাওয়ায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে৷ ক্ষুদিরাম  কিংসফোর্ডের বদলে ভুল করে  দুই ইংরেজ রমণীকে বোমা মেরে হত্যার দায় আদালতে স্বীকার করেন৷ বিচারে তাঁর  ফাঁসীর হুকুম হয়৷ ১৯০৮ সালের ১১ই আগষ্ট দেশের কনিষ্ঠতম শহীদ  ক্ষুদিরামের  ফাঁসী হয়৷  বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সেই বিপ্লবে অনেকের ফাঁসী, অনেকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও অনেকের দীপান্তর হয়৷ তারপর থেকে বাঙলায় বাঘাযতীনের নেতৃত্বে, মাষ্টারদা  সূর্যসেনের নেতৃত্বে ও এইভাবে অনেকেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকের  বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশের  স্বাধীনতা আনয়নের জন্যে জীবনপণ করেছিলেন৷  দলে দলে জীবন উৎসর্গ করেছেন৷  বাঙালীর গৌরব নেতাজী সুভাষচন্দ্রের বীরত্বের কাহিনী কে না জানে!

ব্রিটিশ শাসককে ভারতের মাটি থেকে তাড়াতে সব চেয়ে বেশী রক্ত দিয়েছে এই বাঙলার মানুষ৷  বাঙালীর বীরত্বকে ব্রিটিশ চরমভাবে ভয় করতো৷ তাই বাঙালী জাতিকে খন্ড বিখন্ড করে, এই বাঙালী জাতিকে দুর্বল করার কূটকৌশল প্রথমে ইংরেজরাই নেয়৷  তারপর ভারত স্বাধীন হয়৷  স্বাধীন ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারও  ইংরেজ শাসকের সেই ট্র্যাডিসন মেনে চলে  ও বাঙালী জাতিকে খন্ড-বিখন্ড করে দুর্বল করার  সেই কৌশলী নীতি অনুসরণ করে৷

স্বাধীনতার সময়, পঞ্জাব ও বাঙলা এই দুটি রাজ্য বিভক্ত হয়৷ পশ্চিম পঞ্জাব পড়ে পাকিস্তানে আর পূর্ব পঞ্জাব পড়ে ভারতে৷ স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দ্রুততার সঙ্গে লোক বিনিময়ের  কাজ শেষ করা হয়৷ পাকিস্তানের  হিন্দুরা  নিরাপত্তার কারণে চলে আসে ভারতে৷  এখানকার বহু মুসলমানও পাকিস্তানে চলে যায়৷  পশ্চিম পঞ্জাব থেকে যে সব পঞ্জাবী ভারতে চলে আসে তাদের অর্থনৈতিক  পুনর্বাসনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন  করা হয়৷

কিন্তু বাঙলার ক্ষেত্রে ওপার বাঙলা থেকে যারা অত্যাচারিত হয়ে এপার বাঙলায় বা অসম , ত্রিপুরা প্রভৃতি উত্তর পূর্র্বঞ্চলের রাজ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়, তাদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থাই হ’ল না৷ উদ্বাস্তু হয়ে তাদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জীবন ধারণের  জন্যে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়৷ দলে দলে তাদের দন্ডকারণ্যের জঙ্গলে  ও নানান উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়৷

এছাড়াও , বাঙলার বহু অংশকে পাশ্ববর্তী রাজ্য অসম, বিহার, ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত ক’রে বাঙালীদের অবশিষ্ট নিজস্ব বাসভূমিরূপে চিহ্ণিত পশ্চিম বাঙলার এলাকাকে আরও ক্ষুদ্র ক’রে দেওয়া হ’ল৷

তারফলে, ছিন্নমূল যে বাঙালীরা বিভিন্ন রাজ্যের উদ্বাস্তু শিবিরে  বাঁচার জন্যে সংগ্রাম করছে, তারা  ছাড়াও পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলিতেও স্থায়ীভাবে বসবাসকারী  বাঙালীদের নিজভূমে পরবাসী হয়ে বাস করতে  বাধ্য হতে হচ্ছে৷  যেমন, প্রাক্তন বিহার বর্তমান ঝাড়খন্ডের  অন্তর্ভুক্ত বাঙলার  নিজস্ব এলাকার আদি বাসিন্দা  বাঙালীদের  মাতৃভাষা বাঙলা কেড়ে নেওয়া হ’ল৷ আগে যারা বাঙলা স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ পেত, যে সব এলাকায় আগে সরকারী কাজকর্ম বাংলায় হ’ত --- এখন সেই বাংলাকে উৎখাত করে জোর করে হিন্দি চালানো হচ্ছে৷ বিহারের অবশিষ্ট এলাকার বাঙালীদেরও সেই অবস্থা৷ যেমন বিহারের কাটিহার, কিষাণগঞ্জ প্রভৃতি জেলা পুরোপুরি বাঙালী অধ্যুষিত  হলেও সেগুলি  বিহারের সঙ্গে  যুক্ত করার ফলে  ওখানকার  বাঙালীরা মাতৃভাষা থেকে যেমন  বঞ্চিত  তেমনি  চাকুরী-চাকুরীর ক্ষেত্রেও চরম বঞ্চনার  শিকার৷

ইংরেজ  শাসক আগেই  তাদের শাসনকার্যের  সুবিধার  অজুহাতে গোয়ালপাড়া, শ্রীহট্ট প্রভৃতি সহ বাঙলার  বিস্তীর্ণ এলাকাকে অসমের সঙ্গে যুক্ত করে৷ এরপর  ভারত ভাগের সময়ও বাঙলার বহু এলাকা অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়৷ তারপর স্বাভাবিকভাবে  স্বাধীনতার পর  উদ্বাস্তু  হয়েও অনেকে অসম-ত্রিপুরায়  চলে আসে৷ সরকারের ঘোষিত নীতি অনুসারে  তারা তো বটেই  এর পরেও যারা সাম্রদায়িক অত্যাচারের কারণে ভারতে চলে আসতে বাধ্য  হয়েছে, সবাই আইনত ভারতীয় নাগরিক৷ এখানে স্বাধীনভাবে জীবিকালাভের অধিকার অনস্বীকার্য৷ কিন্তু অসমে, ত্রিপুরায়, মিজোরামে বার বার  বাঙলীদের ‘বিদেশী’ আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর অকথ্য নির্র্যতন ও হত্যাও করা হয়েছে ও আজও হচ্ছে৷ পশ্চিম বাঙলার  বাঙালী  বুদ্ধিজীবীরা ও বাঙালী নেতারা ও দিল্লিতে কেন্দ্রীয় শাসক দলে নির্বাচিত সাংসদ বা মন্ত্রীরাও এর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেন না৷

আজও অসমে, ত্রিপুরা, মিজোরাম, বিহার, ঝাড়খন্ড, ওড়িশায় বাঙালীদের দুর্দশার অন্ত নেই৷

এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজ সমস্ত বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করা উচিত৷  তাছাড়া, আবার দার্জিলিং-এও ‘গোর্খাল্যান্ড’ আন্দোলনের নামে বাঙলা ভাগের জঘন্য চক্রান্ত চলছে৷ এই চক্রান্তে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকদলেরও  মদত আছে৷

আজ বাঙালীদের এই দু:সময়ে সমস্ত বাঙালীদের সব রকমের বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে সমস্ত অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করতে হবে৷  আর বাঙলা ভাগ নয়, বরং খন্ড-বিখন্ড  বাঙলাকে সংযুক্ত করে বাঙালী জাতির হৃতগৌরব  ফিরিয়ে আনতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে৷