স্বাধীনতার চুয়াত্তরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

২০২০ সালের ১৫ই আগষ্ট আমরা ভারতবাসী হিসেবে ভারতবর্ষের ৭৪তম স্বাধীনতা দিবস পালন করলাম পৃথিবীর ইতিহাসে, বিশেষতঃ ভারতবর্ষের ইতিহাসে আগষ্ট মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস ৬ই আগষ্ট,হিরোশিমা দিবস, ৯ই আগষ্ট নাগাসাকি দিবস ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন দিবস যার লক্ষ্য ছিল বিদেশী ব্রিটিশ বিতাড়ন ১৫ই আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস ও ঋষি অরবিন্দ ঘোষের জন্মদিন,যিনি একাধারে বিপ্লবী দেশপ্রেমিক ও দার্শনিক ১৮ই আগষ্ট দেশপ্রেমের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার সূত্রে চূড়ান্ত অন্তর্ধান দিবস, যার পরবর্তী অধ্যায়ে নেতাজী সম্পর্কে অন্য কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সরকারি প্রামাণ্য তথ্য প্রকাশিত হয়নি---এইগুলি হলো আগষ্ট মাসের অনেক  উল্লেখযোগ্য দিনগুলির মধ্যে অন্যতম অবশ্য এই বৎসর ৫ইআগষ্ট দিনটি নবতম সংযোজন এইদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রমোদী মহোদয় অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ কার্যের শিলান্যাস করেন  ও রামমন্দির নির্মাণ আন্দোলনকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমতুল্য হিসেবে বর্ণনা করেন ৫ই আগষ্ট শ্রীযুক্ত মোদীর মন্তব্য,--- স্বাধীনতা আন্দোলনে কয়েক প্রজন্ম নিজেদের সবকিছু সমর্পণ করেছিল ১৫ই আগষ্ট সেই তপস্যা, লাখো বলিদানের প্রতীক ঠিক একইভাবে  রামমন্দিরের জন্য কয়েক শতাব্দী ধরে, কয়েক প্রজন্ম অবিরাম  একনিষ্ঠ চেষ্টা করেছেন আজকের দিন সেই তপস্যা,ত্যাগ ও সংকল্পের প্রতীক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদী আরও বলেন--- এই মন্দির শাশ্বত আস্থা ও সংস্কৃতির আধুনিক প্রতীক হবে

১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি থেকে কার্যকর ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী---ভারতবর্ষ সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র,যার লক্ষ্য এই রাষ্ট্রের সকল নাগরিকই যাতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় চিন্তা, মতপ্রকাশের, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার  স্বাধীনতা সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা নিশ্চিতভাবে লাভ করেন আর সকলের মধ্যে সৌভাত্র প্রসারিত হয় ব্যষ্টির মর্যাদা তথা জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুনিশ্চিত হয় এইরকম একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী, যিনি ভারতীয় সংবিধানকে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার শপথ গ্রহণ করেছেন, তিনি শুধুমাত্র একটি ধর্মমতাবলম্বী মানুষজনের পৌরাণিক কাহিনী বর্ণিত কাল্পনিক উপাস্য দেবতার  কোনরকম প্রামাণ্য তথ্যবিহীন জন্মস্থানে মন্দির নির্মাণের শিলান্যাশ করতে দেশের করোনা মহামারী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এগিয়ে এলেন ও রামমন্দির নির্মাণ আন্দোলনকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে একই বন্ধনীতে আবদ্ধ করলেন অবশ্য বিশেষজ্ঞগণের মতে, এটি শ্রীযুক্ত মোদীর অত্যন্ত সুচিন্তিত পদক্ষেপ তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হলেও আগামী দিনের বিভিন্ন বিধানসভা নির্র্বচন, বিশেষতঃ পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটব্যাঙ্কের সমর্থন লাভের আশায় মোদিজীর এই সিদ্ধান্ত

অযোধ্যায় মন্দির নির্র্মণে তিন-চার বছর লাগবে আর এই সময়কালে সমস্ত নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার দলের ব্যাপক কুশলী প্রচারের ফলে বোটযন্ত্রে এর সুফল পাওয়া যাবে এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে সোমনাথ মন্দিরের উদ্বোধনের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীযুক্ত জহরলাল নেহেরু নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র মোদীর সেসব বালাই নেই তার কাছে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি ও নির্বাচন-যুদ্ধে জয়লাভই একমাত্র লক্ষ্য

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রামমন্দির আন্দোলনকে  ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশে বসিয়ে দেওয়ার মধ্যেও এক সুচতুর কৌশল নিহিত রয়েছে তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি সেই দলের অগ্রজ জনসংঘ বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ইত্যাদি দলের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন অবদানই নেই বরং বিভিন্ন সময় সেই সব দলের  নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ সম্পর্কে বিকৃত তথ্য ও মন্তব্য প্রকাশ করেছেন বর্তমান সরকারের আমলে ভারতে দেশপ্রেম  ও জাতীয়তাবাদের নতুন নতুন সংজ্ঞা নিরূপণ করা হচ্ছে সেই ধারা অব্যাহত রেখে শ্রীযুক্ত মোদী সুকৌশলে রামমন্দির আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সমার্থক বর্ণনা করে দেশপ্রেমের মর্যাদা দিতে উদ্যোগী হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রচেষ্টা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সর্বস্বত্যাগ, ইংরেজ  শাসকদের অত্যাচার-নিপীড়ন যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে মরণপণ লড়াই দেশমাতৃকার মুক্তির জন্যে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার যে মহান কঠোর ব্রত ---এগুলোকে লঘু করে দেখার ও দেখানোর অপপ্রয়াস মাত্র এই অসম্মানসূচক বালখিল্য ক্ষমার অযোগ্য সচেতন দেশবাসী সময়মত অবশ্যই এই ধৃষ্টতার উপযুক্ত জবাব দেবেন মহাকাল ও ইতিহাস কখনো কাউকে ছেড়ে দেয় না--- সত্যের  আলোকে সবকিছুরই যথাযথ বিচার হবে, হবেই ঐক্য-সংহতি, সম্প্রীতি মিলনের  ঐতিহ্যই ভারতীয় সংস্কৃতির প্রকৃত শক্তি, ভারতাত্মার সম্যক পরিচিতি এর বিপ্রতীপের যে কোন অপচেষ্টাই ভারতমাতার বুকে ছুরিকাঘাতের সমান আর এই সব অপরাধীরা যত ক্ষমতাশালী বা শক্তিধরই হোক না কেন, ইতিহাসের আদালতে তাদের যথোপযুক্ত বিচার ও শাস্তিবিধান হবেই হবে (ক্রমশ)