‘স্বপ্ণ, নিদ্রা, স্বাভাবিক মৃত্যু ও অপঘাত মৃত্যু’’

লেখক
সমরেন্দ্রনাথ ভৌমিক

মানব শরীর হ’ল একটা জৈব যন্ত্র (Humanbody is a biological machine)৷ এই জৈব যন্ত্রে সমাবেশ  ঘটছে ৬টি চক্রের ও পাঁচটি কোষের৷ এই ৫টি কোষ হ’ল--- কামময় কোষ, মনোময় কোষ, অতিমানস কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ ও হিরন্ময় কোষ৷

কামময় কোষ হ’ল প্রথমস্তর৷ এই কোষের অধিষ্ঠান হ’ল মূলাধার চক্র৷ মনোময় কোষের অধিষ্ঠান স্বাধিষ্ঠান চক্র, অতিমানস কোষের অধিষ্ঠান হ’ল মনিপুরচক্র৷ বিজ্ঞানময় কোষের অধিষ্ঠান হ’ল অনাহত চক্র৷ হিরন্ময় কোষের অধিষ্ঠান হ’ল বিশুদ্ধ চক্র৷ কামময় কোষকে জীবের স্থূল মন বলে৷ মনোময় কোষকে জীবের সুক্ষ্ম মন বলে৷  আর অতিমানস, বিজ্ঞানময় ও হিরন্ময় কোষ তিনটিকে একত্রে জীবের কারণ মন বলে৷

কামময় কোষের কাজ হ’ল জীবের কামনা,বাসনা প্রভৃতি ত্রিয়াগুলি এই কোষের দ্বারা সাধিত হয়৷ মনোময় কোষে মননক্রিয়া, সুখ-দুঃখের অনুভূতিও নানান ধরনের চিন্তাগুলি এই কোষের  দ্বারা  সাধিত হয়৷ কারণ-মন হ’ল সর্বজ্ঞ৷ ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানা তথ্যের নির্দ্দেশ এই কোষেই সম্পাদিত হয়৷

জাগ্রত অবস্থায় মানুষের  মধ্যে ইচ্ছাশক্তি কাজ  ক’রে থাকে৷  এখন কামময় কোষ কাজের পর ক্লান্ত হ’য়ে পড়ে৷ এই অবস্থায়  কামময় কোষ বিশ্রাম নেয়৷ এর অর্থ হ’ল কামময় কোষের যা কাজ  অর্থাৎ কামনা -বাসনার তাড়না আর মনের মধ্যে কাজ করে না, ফলে মানুষ তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আসে৷ এই অবস্থায় মনোময় কোষ তার কাজ চালিয়ে যায়৷ ফলে এই অবস্থাটা হ’ল স্বাপনিক অবস্থা৷ মনোময় কোষের  কাজ চলে বলেই আমরা এই অবস্থায় স্বপ্ণ দেখি৷

এরপর মনময় কোষও যখন দুর্বল হ’য়ে তার কাজ বন্ধ করে দেয় তখনই শুরু হয় সুষুপ্তি বা নিদ্রা৷ সুতরাং নিদ্রিত অবস্থায় কারণ-মন কাজ চালিয়ে যেতে থাকে৷ এখন কামময় ও মনোময় কোষ আমাদের  মস্তিষ্ক brain) সাপেক্ষে কাজ করে অর্থাৎ এদের ক্রিয়াগুলি মস্তিষ্কে অনুভূত হয়৷ কিন্তু কারণ মন  মস্তিষ্ক নিরপেক্ষ অর্থাৎ মস্তিষ্ক ছাড়াই কারন-মন কাজ করতে পারে৷ এই কারণেই কারন-মনের ক্রিয়াকলাপ মস্তিষ্ক দ্বারা  অনুভব করা যায় না৷ সুতরাং পূর্ননিদ্রার সময় কারন-মন জাগ্রত  প্রহরীর মত দেহ রক্ষা করে৷ এই অবস্থায় প্রাণবায়ু বা প্রাণশক্তিও তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে৷

প্রানবায়ু হ’ল দশটি৷ এর মধ্যে পাঁচটি অন্তর্বায়ু ও ৫টি বহির্বায়ু৷ পাঁচটি অন্তর্বায়ু হ’ল--- (১) প্রাণবায়ু (২) অপ্রাণ বায়ু (৩) সমান বায়ু (৪) উদান বায়ু ও (৫) ব্যান বায়ু৷ এখন, প্রাণবায়ুর  কাজ হ’ল নাভির উপরে বক্ষমধ্যে  আর নাভির নীচে পাকস্থলী, লিভার, কিডনি প্রভৃতি যন্ত্রগুলির কাজ সচল রাখা হ’ল আপ্রাণ বায়ুর কাজ৷ উদান বায়ু কন্ঠ দেশে থেকে স্বরযন্ত্রের কাজকে অর্থাৎ কথা বলার শক্তি যোগাচ্ছে  আর ব্যান বায়ু মাথা  হ’তে পা পর্যন্ত  দেহের তরল অংশকে  প্রবাহমান রাখে৷ সমান বায়ুর কাজ হ’ল প্রাণবায়ু ও অপ্রাণ বায়ুকে নিয়ে সমতা ঘটিয়ে দেহ যন্ত্রকে সচল রাখে৷ ঘুমন্ত অবস্থায়  ইচ্ছাশক্তি  কাজ করে না, ফলে ঘুমন্ত অবস্থায় এই সমতা রক্ষার  কাজ সমান বায়ু একাই চালিয়ে যেতে থাকে৷  কিন্তু ঘুমন্ত  অবস্থায় সমান বায়ু বেশীক্ষণ কাজ করতে পারে না৷ সমান বায়ু, দুর্বল ও ক্ষীণ হ’য়ে পড়তে থাকে৷ এরফলে নিদ্রা  ভেঙে যায়৷ কিন্তু নিদ্রার সময় যদি শরীরের ভিতর কোন গুরুতর ব্যাধি  কিংবা মনে প্রচণ্ড আঘাত  থাকে তবে নিদ্রা আর ভাঙে না৷ এই সময় শ্বাস জোরে জোরে বইতে থাকে৷ শ্বাস জোরে জোরে বইতে থাকাটাকে বলা হয় নাভিশ্বাস Naval breadth)৷  এখন, সমান বায়ু  ক্ষীণ হওয়ার জন্য উদান বায়ুর কাজ হচ্ছে কন্ঠের  স্বরকে নিয়ন্ত্রণ করা৷ সুতরাং উদান বায়ু কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় ঐ সময় মানুষ ঠিক মত কথা বলতে পারে না৷ এই সময়কার মনের ব্যাথা, বেদনা প্রভৃতি পীড়ণের কথা স্পষ্ট করে  বলতে পারে না, কথা এড়িয়ে যায়৷ গলায় ঘড়্ ঘড়্ ক’রে  এক ধরনের  শব্দ উঠতে থাকে৷ উদান বায়ুর  সঙ্গে  ব্যান বায়ুও ক্ষীণ  হ’য়ে  পড়ে এবং সারা শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়৷ শরীরের এই অবস্থাটাই হ’ল শারীরিক মৃত্যু Physical death) তাহ’লে দেখতে পাচ্ছি,নিদ্রিত অবস্থাটাও একপ্রকার  মৃত্যু, তবে  এটা ক্ষণস্থায়ী মৃত্যু৷

নিদ্রা শেষ হ’লে সমান বায়ু আবার স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে থাকে৷

অপঘাত মৃত্যু

হঠাৎ কোন দুর্ঘটনা ঘটলে অথবা মারণব্যধিতে আক্রান্ত হলে অর্থাৎ যেমন কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হওয়ার কিংবা সর্পাঘাতে বা বিষপানে মৃত্যু হ’লে এধরণের মৃত্যুকে  অপঘাত মৃত্যু বলে৷ এ ধরনের মৃত্যুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে৷ এ ধরনের  ঘটনায়  শরীর বিপর্যস্ত হ’লে প্রাণশক্তি বা প্রাণবায়ু স্তব্ধ বা স্তম্ভিত হ’য়ে যায়৷ এই অবস্থায় প্রাণবায়ু ও অপ্রাণ বায়ু স্তম্ভিত হয়ে যায় অর্থাৎ দেহ ছেড়ে চলে যায় না কিন্তু দেহের মধ্যে এলোপাতাড়ি অবস্থায়  থেকে  যায়৷ এই অবস্থায়  সমানবায়ু  ঐ প্রাণ বায়ু  ও অপ্রাণ বায়ুর মধ্যে  সমতা আনার চেষ্টায় থাকে৷  এই সময়কার অবস্থার প্রাণই হ’ল স্তব্ধ প্রাণ৷ কিছুক্ষণ পরে হয়ত এই স্তব্ধ প্রাণ স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে৷ স্বাভাবিক মৃত্যুতে মৃত্যুর পূর্বে নাভিশ্বাস নির্গত হয়৷ কিন্তু প্রাণবায়ু  স্তম্ভিত হ’লে নাভিশ্বাস হবার সুযোগ থাকে না৷ অথবা তা অল্প সময়  পরেই হয়ে যায়৷ স্তব্ধ প্রাণ দেহটিকে স্বাভাবিক প্রাণে ফিরে আসতে  হয়ত বা অনেক সময়ও লাগে৷ স্তম্ভিত প্রাণ দেহকে যদি উপযুক্ত চিকিৎসা করা যায় তবে স্তম্ভিত প্রাণ ব্যষ্টিটি স্বাভাবিক হয়ে আবার উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্মরত  হয়ে যায়৷ এই জন্য স্তব্ধপ্রাণ ব্যষ্টিকে স্বাভাবিক প্রাণে ফিরিয়ে আনতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত ও উপযুক্ত চিকিৎসকও লাগাতে হবে৷ কিন্তু স্বাভাবিক প্রাণ ফিরে আসর পূর্বেই এরূপ ব্যষ্টিদের তড়িঘড়ি ক’রে দাহ কিংবা প্রোথিত করা উচিত নয় বরং  স্তম্ভিত প্রাণ মানুষটিকে ঐ অবস্থায় দাহ না ক’রে নদীর উন্মুক্ত  পরিবেশে ভেলা যোগে ভাসিয়ে দেওয়াই বাঞ্জনীয়৷ নদীর উন্মুক্ত পরিবেশ স্তম্ভিত প্রাণের হয় বা পুনর্জাগরণ হ’য়ে যেতে পারে ও স্বাভাবিক হ’য়ে যেতে পারে৷ এই কারণে পূর্বে নদীর জলে স্তব্ধ প্রাণ ব্যষ্টিকে ভাসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল৷ এই জন্যই বোধ হয় সর্পাঘাতে  মৃত লক্ষীন্দরকে নদীর জলে কলার ভেলায় ক’রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ এই অবস্থায় দাহ বা কবর দেওয়ার অর্থ হ’ল স্বাভাবিক  মৃত্যুতে যে নাভিশ্বাস ওঠে তা হওয়ার পূর্বেই তাকে দাহ বা কবরে দেওয়া হ’ল৷ এই অবস্থায়  স্তম্ভিত প্রাণ দেহটাকে শেষ করা হলেও  তার প্রাণবায়ু বেঁচে থাকে৷ আপত দৃষ্টিতে মৃত্যু হলেও বাস্তবিকপক্ষে মৃত্যুটা তখনও ঘটেনি৷ তাই এই অবস্থায় স্তম্ভিত প্রাণ দেহকে  দাহ করে ফেললে এই প্রাণের পুনর্জাগরন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ কবর দিলে সে আরও বেদনাদায়ক৷ কারণ, কবর দেওয়ার পর কবরের মধ্যে হয়ত বা অল্পসময় পরে ক্ষনেকের জন্য  স্তম্ভিত প্রাণ জেগে ওঠে৷ তারপর কিছুক্ষণ মাটির  নীচে ছট্ফট্ করে আবার সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে৷ তাই এধরনের স্তম্ভিত প্রাণদেহকে উপযুক্ত চিকিৎসা না করা  পর্যন্ত দাহ কিংবা কবর দেওয়া অথবা অন্য কোন পদ্ধতিতে সৎকার করা বাঞ্ছনীয় নয়৷ এরা অতিরিক্ত আশা, আকাঙ্ক্ষা, আঘাত, তীব্র বেদনা নিয়ে যে প্রাণটা বেরিয়ে যায় ও মানস  দেহ নিয়ে  অশরীরী অবস্থায়  শূন্যে  ঘুরে বেড়ায় আর সহজে এদেরে জন্ম হয় না৷  জন্ম হতে দীর্ঘদিন বিলম্ব হয়৷ এই সমস্ত অশরীরীদের প্রেষিত -মানস বলে৷ এরূপ প্রেষিত -মানসদের নিয়ে ‘বাবা’ প্রচুর গল্প লিখেছেন৷ ‘বাবা’-র লেখা ‘গল্প সঞ্চয়ন’ বইয়ের ৫ম ও ৬ষ্ঠ খণ্ডের অধিকাংশ গল্পগুলি এই অশরীরীদের নিয়ে৷

(পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ভাব ও ভাবাদর্শ গ্রন্থ অবলম্বনে এই প্রবন্ধটি রচিত৷)