শিব, কৃষ্ণ ও রাম

লেখক
আচার্য মোহনানন্দ অবধূত

পরমপুরুষের হাজার হাজার নাম৷ পরমপুরুষ অনন্ত, তাঁর লীলাও অনন্ত আর তাঁর গুণও অনন্ত৷ লোকে সাধারণভাবে বলে যে হরি অনন্ত, হরি কথাও অনন্ত তাঁর অনন্ত গুণাবলীর জন্যে তাঁর অনন্ত নাম৷ এক-একটি নামে তাঁর বিশেষ বিশেষ ভাব নিহিত আছে৷ যেমন পরমপুরুষের এক নাম গোবিন্দ৷ এর মানে হ’ল যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে জানেন, সমগ্র সৃষ্টি যার নখদর্পণে---তিনি হলেন গোবিন্দ৷ তেমনি তাঁর এক নাম মাধব৷ যিনি প্রকৃতির শক্তির স্বামী অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক৷ মা-মানে প্রকৃতিশক্তি আর ধব মানে স্বামী৷ সাধবা মানে যার স্বামী বর্তমান বা জীবিত৷ তেমনি কেশব, মধুসূদন, বাসুদেব প্রভৃতি৷ লোকে শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম জপ বা পাঠ করেন৷ শুধু ওই অষ্টোত্তর হতনাম হয়, হাজার হাজার পরমপুরুষের নাম৷ কৃষ্ণ শব্দের এক অর্থ হ’ল যিনি আছেন বলে’ সমগ্র সৃষ্টি আছে৷ অর্থাৎ আমাদের অস্তিত্ব তাঁর অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল৷ সমগ্র সৃষ্টির পেছনে পরমপুরুষ আছেন৷ এই অর্থে তাঁকে কৃষ্ণ বলা হয়৷ কৃষ্ণ কথার আর এক অর্থ হ’ল যিনি সবাইকে তাঁর দিকে আকর্ষণ করছেন, সমগ্র বিশ্ব তাঁরই আকর্ষণে পরিচালিত হয়ে চলেছে আর সব সত্তা তাঁর আকর্ষণে তাঁর পানে ছুটে চলেছে৷ আবার যে সত্তা সহস্রার চক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত থেকে জৈবী বৃত্তি ও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেন সেই সত্তা হলেন কৃষ্ণ৷

তেমনি শিব কথার এক অর্থ হ’ল কল্যাণ৷ আমরা শিবকে কল্যাণসুন্দরম্ বলে থাকি৷ অর্থাৎ যিনি তাঁর সৃষ্টির সকলের কল্যাণ করে চলেন৷ শিব শব্দের আর এক অর্থ হ’ল চিতিসত্তা৷ ওই চৈতন্য বিকাশের ফলে মানুষ ‘মানুষ’ বলে পরিচিত হয় ও মানুষ জ্ঞান লাভে সমর্থ হয় তেমনি হরি কথার মানে যিনি ভক্তের পাপহরণ করে নেন৷ ভক্তরা তাদের পাপ ভগবানকে দিতে চান না৷ অথচ পাপের বোঝার ফলে ভক্তরা তাদের প্রগতির পথে দ্রুতি পায় না, তাই পরমপুরুষ তাঁর ভক্তের পাপকে চুরি করেন অর্থাৎ হরণ করে নেন, তাই তার আর এক নাম  হরি৷ তেমনি হর শব্দের অর্থ হ’ল---‘হরতি ক্লেশান ইতর্থে হর’ অর্থাৎ পরমপুরুষ তাঁর ভক্তের ক্লেশ, দুঃখাদি হরণ করে নেন বলে তাঁর আর এক নাম হর৷ ‘পরমপুরুষের এক নাম রাম’৷ রাম শব্দের তিন ধরণের ব্যাখ্যা রয়েছে---এক হ’ল ‘রমন্তে যোগিনঃ যস্মিন’ অর্থাৎ অসীম সত্তা আনন্দ দিতে পারেন সেই সত্তা রাম৷ রাম শব্দের দ্বিতীয় অর্থ হ’ল রাতি মহিধরঃ রামঃ৷ বিশ্বের সবচেয়ে প্রোজ্জ্বল সত্তা হলেন রাম৷ রাতির আদ্য অক্ষর ‘রা’ ও মহীধরের আদ্যক্ষর ‘ম’---দুইয়ে মিলে ‘রাম’৷ এই সৌরজগতে আমরা সূর্যের কাছ থেকে রশ্মি পেয়ে থাকি কিন্তু সূর্য শক্তি পেয়ে থাকে কার থেকে?  ---পরমপুরুষের কাছ থেকে৷ ....তাই বলা হয় ‘রাতি মহীধরঃ রামঃ’৷ ‘রাম’ শব্দের তৃতীয় ব্যাখ্যা হ’ল ‘রাবনস্য মরণম্’৷ রাবনস্য মরণমের আদ্যক্ষর ‘রা’ আর মরণের আদ্যক্ষর ‘ম’ মিলে রাম৷ এই রাবণ শব্দের অর্থ কী? রাবণ হচ্ছে পুরান বর্ণিত দশ মস্তক বিশিষ্ট এক কাল্পনিক চরিত্র৷ এই দশটি মাথা হ’ল মানব মনের বহির্মুখী বৃত্তির দ্যোতক---যে বৃত্তিগুলি মানুষের মনকে জড় জগতের দশদিকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়৷ এমন মনকে এই জড়তার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে পরমপুরুষের স্মরণ নিলে মনকে জড়তার হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব৷ মানে রাবণের মৃত্যু৷ তাই যাঁর হাতে রাবণের মৃত্যু তিনি রাম৷ রামায়ণ নামক মহাকাব্যে রূপক হিসাবে এটাই চিত্রিত করা হয়েছে৷ আবার রৌ+ অন করে’ রাবণ শব্দ হচ্ছে---যা জীবের অধোগতি ঘটায়---যা জীবকে নরকের পথে ঠেলে দেয় তাই রাবণ শব্দ৷

কৃষ্ণ ও শিব শব্দের আবার তিনটি দিক---প্রথমতঃ হ’ল দার্শনিক(philosophical) কৃষ্ণ ও দার্শনিক শিব, দ্বিতীয়তঃ জীব বৈজ্ঞানিক(biological) কৃষ্ণ ও শিব তৃতীয়তঃ ---ঐতিহাসিক(historical) কৃষ্ণ ও শিব৷ কৃষ্ণ শব্দটির দার্শনিক দিক হল সেই সত্তা যিনি সবাইকে তাঁর দিকে আকর্ষণ করছেন৷ আর যাঁর জন্যে সব কিছুর অস্তিত্ব৷ শিব শব্দটির দার্শনিক দিক হ’ল পরম চৈতন্য সত্তাত্ত---‘The supreme non attributional entity’৷ কৃষ্ণ শব্দের জীব বৈজ্ঞানিক(biological) দিক হ’ল যিনি সহস্রাচক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে সমস্ত জৈবিক বৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন ও পরিচালিত করছেন৷ এমনি শিব শব্দের জীব বৈজ্ঞানিক দিক হ’ল যে চিতিসত্তা সহস্রার বিন্দুতে অবস্থান করে মনে বৃত্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করছেন৷ ঠিক তেমনি পরমপুরুষকে যখন রাম নামে অভিহিত করা হচ্ছে তখন রাম শব্দের দার্শনিক দিক হ’ল‘রাতি মহিধর রাম’ এই অর্থে তাঁর রাম শব্দের জীব বৈজ্ঞানিক দিক হ’ল---রমন্তে যোগীন যস্মিন৷ আগেই বলেছি শিব কৃষ্ণ ও রাম একই পরমপুরুষের বিভিন্ন নাম৷ কিন্তু সত্তা এক ও একই সত্তারই দুই ভূমিকা৷ এক কৃষ্ণ সত্তা হিসেবে, দুই হ’ল জীবের আত্মা হিসাবে বা অণুচৈতন্য হিসাবে৷

এখন ঐতিহাসিক শিব হলেন তিনি যিনি নররূপে আবির্ভূত অথাঁৎ আপনার আমার মত মানব শরীর নিয়ে জন্মগ্রহণ করে মানব সভ্যতা ও মানব সংস্কৃতিক বিকাশ সাধনে পথ দেখিয়েছেন৷ যিনি আনুমানিক সাত হাজার বছর আগে পৃথিবীতে এসে জীবের কল্যাণ করে গেছেন৷ জীব মানে মানুষ, পশু, উদ্ভিদ সবকে বোঝাচ্ছে৷ রাঢ়ে তাঁরই চরণস্পর্শে প্রথম সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল৷ শিব ছিলেন সভ্যতার জনক৷ শিকবে বাদ দিয়ে মানব সভ্যতা ও মনব সংস্কৃতি দাঁড়াবার ঠাঁই পাবে না৷ কিন্তু মানব সভ্যতা, মানব সংস্কৃতি বাদ দিলে শিব স্বমহিমায় ভাস্বর থাকবেন৷ কিন্তু পরমপুরুষের রাম বলে কোন ঐতিহাসিক চরিত্র নেই৷ আমরা রাম চরিত্র হিসাবে যা জানি ও বলি তা পৌরাণিক রাম চরিত্র৷ অর্থাৎ কল্পিত রাম চরিত্র৷

এখন পুরান কি বা ইতিহাসই বা কী? তা জানলে বোঝা যাবে রাম চরিত্রই বা কী? তৎকদ্ধালীন ভারতীয় প্রথা অনুযায়ী সমগ্র রচনা সাহিত্যকে চার ভাগে ভাগ করা হ’ত---(১) কাব্য, (২) পুরাণ, (৩) ইতিবৃত্ত, (৪) ইতিহাস৷ ইতিহাস কাকে বলে?

‘ধর্মার্থ-কাম-মোক্ষার্থং নীতিবাক্য সমন্বিতম্৷

পুরাবৃত্ত কথাযুক্তম্ ইতিহাস প্রচক্ষতে৷৷’

অর্থাৎ ইতিহাস হ’ল সেই ধরণের রচনা যা পাঠ করলে পাঠক চতুবর্গ ফল---ধর্ম, অর্থ, কম ও মোক্ষ লাভ করেন আর নীতিশাস্ত্রের বিধিনিষেধ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হন৷ কাম মানে জাগতিক ভোগ---ধন, মান, যশ আর বস্ত্রাদি ভোগ ৷ অর্থ মানে মানুষের মনের অভাব পূরণ অর্থাৎ জ্ঞান লাভ করা৷ কোন শব্দের মানেকে আমরা অর্থ বলি৷ অনুপপত্তির পূরণ মানে অর্থ৷ টাকার দ্বারা অভাব পূরণ হয় সেই অর্থে টাকাকেও অর্থ বলি৷ আর ধর্ম হ’ল মানসাধ্যাত্মিম উন্নতি---মনকে প্রসারণ করে’ বৃহৎকে পাবার এষণায় সাধনা করা বা চেষ্টা করা৷ ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মহয়ে যাওয়া হল মোক্ষ৷ এই মোক্ষ প্রাপ্তির পরই মানুষের সকল দুঃখ-কষ্ট-ক্লেশের নিবৃতি হয়৷ ইতিহাস তাকেই বলা যা পাঠে এই চতুবর্গ ফল লাভ হওয়া যায়৷ মহাভারত ইতিহাস পর্যায়ভুক্ত৷ তেমনি ভাগবৎ অর্থাৎ কৃষ্ণ চরিত্র, শিবের জীবনী, চৈতন্য চরিতামৃত আদি ইতিহাস পর্যায়ভুক্ত৷ এই অর্থে ইতিহাসের কোন ইংরাজী প্রতিশব্দ নেই৷ ইংরাজীতে আমরাযাকেHistory বলি তার পর্যায়বাচক শব্দ হ’ল ইতিবৃত্ত বা পুরা কথা বা পুরাবৃত্ত এ হ’ল নানান ঘটনাবলীর ধারাবাহিক বিবরণ মাত্র৷ তবে ইতিহাস কথার যে অংশটুকুতে শিক্ষাগত মূল্য আছে সেই অংশটুকুকে ইতিহাস বলা যেতে পারে৷  পুরান(mythology) হ’ল কল্পিত ঘটনা৷ কিন্তু পুরানের ঘটনাবলী কল্পিত অর্থাৎ বাস্তব না হয়েও সমাজে এর শিক্ষাগত মূল্য খুব বেশী৷ যেমন নীতিগল্প বা পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলি কল্পিত কিন্তু শিশুদের কাছে নীতিগত শিক্ষার মূল্য খুব বেশী রয়েছে৷ তেমনি মানব জীবনের চতুবর্ণ ও নীতিগত দিকগুলি নিয়ে যে কল্পিত চরত্র এগুলি সমাজের মানুসের কাছে শিক্ষাগত মূল্য যথেষ্ট রয়েছে৷ এই হিসাবে ‘রামায়ণ’ একখানি পুরান৷ বেদব্যাস লোকশিক্ষার জন্যে আঠেরটি পুরান রচনা করেছিলেন৷ নানান উপাখ্যান রচনার মাধ্যমে বেদব্যাস জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন৷ তিনি জনসাধারণকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে পরোপকারের দ্বারা পূর্ণার্জন হয়৷ আর অপরের ক্ষতি করলে মানুষ পাপগ্রস্ত হয়৷

‘অষ্টাদশ পুরাণেষু ব্যাসস্য বচনাদ্বয়ম৷

পরোপকারায় পূণ্যায় পাপায় পরপীড়ণম্৷৷’

রাম কোন বাস্তব চরিত্র নয়৷ রাম কল্পিত চরিত্র৷ একজন আদর্শ মানুষ কেমন হতে তারই কল্পিত চরিত্র ও সেই চরিত্রের যথাযথ রূপ দেবার প্রথম চেষ্টা করেছিলেন মহর্ষি বাল্মীকি৷ বাল্মীকি থেকে বেশী চেষ্টা করেছিলেন মোগল যুবের কবি তুলসীদাস৷ তাঁর‘ অবষি’ ভাষায় লেখা ‘রামচরিতমানস’ পুস্তকে৷ তবে এ রামচরিত্রর সম্পূর্ণ রামায়ণ নয়৷ মহর্ষি তুলসীদাস মনে মনে রামের কথা যেমন ভেবেছিলেন সেই রকমই লিখেছিলেন৷ অর্থাৎ তুলসীদাসের মানস পটভূমিতে যে রামের চরিত্র তৈরী করলেন তার নাম ‘রামচরিতমানস৷’ বলা হয় রাম জন্মের ষাট হাজার বচর পূর্বে রামায়ণ রচিত হয়েছিল৷ মানে রাম চরিত্র কল্পিত চরিত্র৷ কিন্তু এই কল্পিত চরিত্র তথা রামায়ণ গাঁথা মানুষকে যুগ যুগ ধরে প্রেরণা যুগিয়েছে আদর্শ মানুষ হবার৷ আদর্শ শাসন ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত তা রামের রাজত্বে দেখানো হয়েছে৷ রাম ছিলেন আদর্শ মানব চরিত্র৷ লক্ষণ চরিত্র, ভরতের চরিত্র মানুষকে শিক্ষা দেয় ত্যাগ ও আদর্শ ভ্রাতৃ চরিত্রের৷ সীতার চরিত্র শিক্ষা ন্দোয় আদর্শ নারী চরিত্রের৷ সেই জন্যে দেখি বাঙলার জনসাধারণ শিক্ষিত হবার, নীতিবান মানুষ হবার জন্যে নিয়ম করে কবি কৃতিত্তবাসের বাংলা অনুবাদের রামায়ণ নিয়মিত পাঠ বা নারী পুরুষ নির্বিশেষে রামায়ণ কথা আগ্রহের সঙ্গে শুনতো ও প্রেরণা লাভ করত৷ বর্তমানে নতুন করে বাইরে থেকে ‘শ্রীরাম’, ‘শ্রীরাম’ বঙ্গে আমদানি যারা করছেন তারা কি বলতে চাইছে বাঙালী রামচরিত্র জানে বা বোঝে না বা অজ্ঞ--- বাঙালী জাতিকে অপমানিত করা ছাড়া আর কিছু নয়৷ বরং যারা ‘শ্রীরাম’ আমদানি করছে তারাই রামচরিত্র কি আর পুরাণ সাহিত্য কি তা জানে না, কারণ তারা বিশ্বাস করে যে রাম নামে মহাদেবতা সত্যিকারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু ঘটনা তো তা নয়৷ সমগ্র সৃষ্টি সৃষ্ট হয়েছে ব্রহ্ম থেকে---তিনি স্রষ্টা ও উপাদান কারণও অর্থাৎ সৃষ্ট জগতের যাহা কিছু সব কিছুর মূল উপাদান ব্রহ্ম নিজে থেকে৷ এই ব্রহ্মের তিন অবস্থা৷ সগুণ, নির্গুণ ও তারকব্রহ্ম৷ শিব ও শক্তির মিলিত রূপ হ’ল ব্রহ্ম৷ এখানে শক্তি মানে প্রকৃতি, যা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের সমাহার৷ যেখানে প্রকৃতি ক্রিয়াশীল নয় অর্থাৎ ঘুমন্ত ব্রহ্মের সেই অবস্থাকে বলা হয় র্নুিণ বা অক্ষরব্রহ্ম আর সগুণ ব্রহ্ম বা খরব্রহ্ম হ’ল যা প্রকৃতির গুণত্রয়ের বন্ধনের আওতায়৷ এই সগুণ নির্গুণের বা খর ও অক্ষরের মধ্যে সেতু রূপে যে ব্রহ্মের অবস্থা তা হ’ল তারকব্রহ্ম বা নিরক্ষর ব্রহ্ম৷ গীতাতে ইনাকে উত্তমপুরুষ বলে অভিহিত করা হয়েছে৷ এই তারকব্রহ্ম বা নিরক্ষর ব্রহ্ম মায়াতীত হয়ে মায়াধীষ আর সগুণ ব্রহ্ম অর্থাৎ খরব্রহ্ম মায়াধীন৷ আর নির্গুণ ব্রহ্ম বা অক্ষর ব্রহ্ম ক্রিয়াহীন৷ তাই এই তারকব্রহ্ম বা নিরক্ষর ব্রহ্ম খর বা অক্ষর ব্রহ্মের থেকে শ্রেষ্ট বা উত্তম৷ ইনিই একমাত্র মায়াবদ্ধ মানুষের মুক্তিদাতা তথা মোক্ষদাতা৷ ইনি পুরুষোত্তম নামে খ্যাত৷ ইনি তাঁর সৃষ্ট জীবের কল্যাণের জন্যে তাদের বিকাশের পথনির্দেশনা ও প্রেরণা দেওয়ার জন্যে মানব শরীরে আবির্ভূত হন৷ আর সাধুজনদের রক্ষা ও দুষৃকতিকারীদের বিনাশ করে’ ধর্ম সংস্থাপন করে যান৷ ইতিই সৃষ্ট কর্তা ও একমাত্র গুরু বা আদিগুরু৷ মানব দেহে এরই আবির্ভাবকে বলা হয় মহাসম্ভূতি৷ তারকব্রহ্মের মহাসম্ভূতি আজ থেকে সাত হাজার বছর আগে সদাশিব রূপে আবির্ভাব হয়েছিল৷ আর আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে কৃষ্ণরূপে আবির্ভাব হয়েছিল৷ শিব আর কৃষ্ণ একই সত্তা ছিলেন৷ উভয়েই ছিলেন মহাসম্ভূতি৷ শিব যখন এসেছিলেন তখন সভ্যতা ও সামাজিকতা বলতে কিছু ছিল না৷ শিবের সময়টা চিল ভারতের দ্বন্দ্বাত্মক পরিবেশ---আর্য, অষ্ট্রিক, মোঙ্গল গোষ্ঠীদের সংঘাতময় পরিবেশ৷ শিব এসে জিও সেণ্টিমেণ্ট ও সোসিও সেণ্টিমেণ্টকে চূণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে এক সংমিশ্রণ মানব গোষ্ঠী গড়ে তোলেন৷ মানুষের মনের বিকাশের জন্যে ও মনের স্থল বৃত্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে তন্ত্রযোগ প্রর্ত্তন করেন ও মানুষেরমধ্যে ধর্মবোধ জাগিয়ে তোলেন৷ সঙ্গীত শাস্ত্রের প্রবর্ত্তন করেন৷ বিবাহ প্রথা প্রবর্ত্তন করে সমাজ গঠনের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেন৷ বৈদ্যক শাস্ত্র অর্থাৎ চিকিৎসা শাস্ত্রের বিধিবদ্ধ রূপ দান করেন৷ অর্থাৎ মানব জীবনে প্রগতি ও বাঁচার জন্যে যা যা প্রয়োজন তা তিনি বিধান দেন৷ ফলে সে যুগে স্থূল মানস সম্পন্ন লোকগুলো  সদাশিব প্রবর্ত্তিত সুন্দর একটা জীবন শৈলী মেনে বাস করতে শিখল৷

কৃষ্ণ যখন মহাসম্ভূতিরূপে আবির্ভূত হলেন তখন ভারতবর্ষ ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল আর রাজ্যগুলি প্রায়ই পরস্পর যুদ্ধে বিগ্রহে লিপ্ত থেকে নিজের রাজ্য সীমানাকে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করত৷ তৎকালীন সমাজে কোন যৌথ মনোভাব ছিল না৷ অবশ্য সে যুগের জনসাধারণ ভগবান সদাশিবের শিল্প, কলা, সঙ্গীত নৃত্যাদি হুবহু অনুসরণ করে চলত  শিব প্রদত জীবনাদর্শ সকলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে চলত৷ শ্রীকৃষ্মর ছোট ছোট ভারত (রাজ্য)কে এক করে মহাভারত গড়ার পরিকল্পনা করেন আর মহাভারতের যুদ্ধের অনুষ্ঠান শেষে মহাভারত গড়ে ওঠে ও রাজ্যে রাজ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকা রোধ হয়ে যায়৷ সামাজিক ক্ষেত্রে পরস্পরের সঙ্গে যৌথ মনোভাব গড়ে ওঠে৷ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে শিব প্রবর্ত্তিত সব ব্যবস্থাকে রেখে সংযোজন করেন প্রপত্তিবাদ যা শরণাগতি আর জ্ঞানকর্ম ও ভক্তিতত্ত্ব৷ এখন মহাসম্ভূতি রূপে শিব ও কৃষ্ণ হলেন মানব জীবনের বৈয়ষ্টিক সত্তা৷ এই বৈষ্টিক সত্তা হলেন মানুষের ইষ্ট৷ এই ইষ্টের সঙ্গে মানুষের ভালবাসার সম্পর্ক, সুখ, দুঃখ, কান্না, হাসি প্রভৃতির ভাবনার সম্পর্ক যা নিবৈযষ্টিক সত্তার ক্ষেত্রে থাকে না৷ ভক্ত মানুষের, সাধকের আকুতি হ’ল তার যে আদর্শ, নির্বৈষ্টিক সত্তা থাকে ব্যষ্টিগত ভাবে পেতে---তাঁর সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলতে, তার রূপ প্রত্যক্ষ করতে, তাঁর কণ্ঠের বাণী শুনতে৷ তাই ভক্ত মানুষের মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্যে সেই তারকব্রহ্ম তথা পুরুষোত্তম পাঞ্চভৌতিক শরীর ধারণ করে নরাধামে অবর্তীণ হন৷ এইটাকে শাস্ত্রে বলা হয় পুরুষোত্তমের শ্রেষ্ঠ লীলা অর্থাৎ ভগবানের নরলীলাই সর্বোত্তম৷ (ক্রমশঃ)