শিক্ষার বাণিজ্যকরণের সর্বত্র প্রতিবাদ হওয়া উচিত

লেখক
বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়

প্রথমেই বিভিন্ন বোর্ডের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায়  সবের্র্বচ্চ নম্বর প্রাপ্ত মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি। তাদের প্রতি রইল আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও আশীর্বাদ ভবিষ্যৎ জীবনে তারা আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে দেশ ও দেশবাসীর  কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করবে এই কামনাই  করি। ছাত্রছাত্রীদের নম্বর  দেখে বুঝতে পারছি না এরকম ঢালাও নম্বর দেওয়ার নির্দেশ কী বোর্ডের তরফে ছিল, নাকি, স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র বা তাদের মেধার কারণে  পেয়েছে! আশা করি মূল্যায়ণ সঠিকভাবেই হয়েছে এখনকার যুগের ছেলে মেয়েরা আমাদের সময়ের থেকে অনেক বিষয়েই এগিয়ে গেছে, এটা সত্য, তবে যেভাবে গত কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্ন বোর্ডের মধ্যে নম্বর দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। তাতে আগামী দিনে উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০০ নম্বর এর মধ্যে ৫০০ পেলেও অবাক হব না।

বেসরকারী ও হাতে গোনা কিছু বিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কেমন ধরনের পড়াশোনা চলছে। তার যে খবর অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রায়ই পাই তার সাথে এই ফলাফলকে কিছুতেই মেলাতে পারছি না। তাঁদের অভিমত বিদ্যালয় নয়, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই এখন গৃহশিক্ষক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ।  এজন্য কেবলমাত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকেই আমি দায়ী করতে চাই না, নজরদারিসহ পুরো পরীক্ষা ব্যবস্থাটার মধ্যেই গলদ আছে ।

মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের একটা অংশ জীবনে সাফল্যলাভ করে হয়তো অনেকে উচ্চপদেও আসীন হচ্ছে, কিন্তু মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে অধিক নম্বর পাওয়া অনেক ছাত্র ছাত্রীই পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যাচ্ছে। কেন এমন ঘটছে এ বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। শিক্ষান্তে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক ভালো নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রী ভবিষ্যৎ জীবনে গভীর হতাশার স্বীকার হচ্ছে। তাই তো পিএইচডি করে ও ৪থ শ্রেণীর কর্মচারী পদে আবেদন করছে! উচ্চ ডিগ্রী ধারী বহু ছাত্র ছাত্রী বেকার হয়ে বসে।।

প্রথম থেকেই ছাত্র ছাত্রীদের বেশি নম্বর পাওয়ার পেছনে ছুটতে বাধ্য করিয়েছে অভিভাবকদের এক বিরাট অংশ। কোনো বিষয়ের উপর দক্ষতা কতটা হোলো বা লেখার ক্ষমতা তার তৈরি হোলো কিনা সে বিষয়ে শিক্ষকগণের এক বিরাট অংশ যেমন দায়ী, তেমনি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না অভিভাবকেরাও। পরবর্তী ক্লাসে বা কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য বর্তমান নিয়মানুযায়ী বেশি নম্বর পাওয়া জরুরি, এটা যেমন সত্যি তেমনি বিষয়ের গভীরতা বা লেখার ক্ষমতা তৈরি না হওয়ার বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অনেক ভালো ছেলে মেয়ে হোঁচট খাচ্ছে। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রশ্ণের ধরণ  পাল্টে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বেশি নম্বর তোলার সুবিধা করে আখেরে কী তাদের কোনো লাভ হচ্ছে। উল্টে ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি অভিভাবকেরাও গভীর দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কোনো শুভবুদ্ধি সম্পন্ন, বিবেকবান মানুষ আগামী দিনের ভবিষ্যৎ এই উজ্জ্বল মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে নীরব  থাকতে পারেন না । শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত সকলেরই মনে হয় এবার ভাববার সময় এসেছে । প্রকৃত শিক্ষাবিদগণ সব মোহ, লোভ, পদের আশা ছেড়ে আমার, আপনার  বাড়ির  ছেলে মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবুন কীভাবে তাদের প্রকৃত শিক্ষায়  শিক্ষিত করে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে দেশ ও দশের কল্যাণ কর্মে নিয়োজিত করতে পারব ও সকলের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব ।

মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার আদর্শ সমাজ নির্র্মণে তাই  শিক্ষার ওপর অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন । মূল্যবোধ সম্পন্ন,সৎ,নীতিবান মানুষ ব্যতিরেকে সমাজের কোনো ক্ষেত্রেই উন্নতি সম্ভব নয়, তিনি বলেছেন, সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে--- তাকেই বিদ্যা শিক্ষা বলা হবে যা মানুষকে সর্বক্ষেত্রে বিমুক্তির পথ দেখাবে । তিনি বলেছেন, মানুষের জীবন ত্রিস্তরীয়--- ভৌতিক (ফিজিক্যাল), মানসিক ও আত্মিক তাই সেটাই প্রকৃত শিক্ষা । যা মানুষকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক--- সমস্ত ক্ষেত্রেই সমস্ত বাধা বিপত্তির উপলখণ্ডকে সরিয়ে তার সার্বিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে ।

সেজন্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নীতিশিক্ষা তথা চরিত্র নির্র্মণের শিক্ষাটা অত্যন্ত জরুরী । যুগান্তকারী প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শিক্ষার মূলনীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এও বলেছেন, শিক্ষানীতির ভিত্তি হওয়া উচিত নব্যমানবতাবাদ, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ, পশুপক্ষী-তরুলতা সবার প্রতি ভালবাসা ও দায়িত্ববোধের জাগরণ ।  শিক্ষার মধ্যে যেন কোনও প্রকার  জাত-পাত সম্প্রদায়বোধের ছিটেফোঁটাও না থাকে । তিনি আরও বলেছেন, প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা ও পাশ্চাত্ত্যের বিজ্ঞান---এই দুয়ের সমন্বয় ঘটাতে হবে । আধ্যাত্মিকতার নামে যেন কোনোপ্রকার অযৌক্তিক কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও সংকীর্ণ ভাবধারাকে প্রশ্রয় না দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান মোদি সরকারের ঘোষিত শিক্ষানীতির মধ্যে এই এই মানুষ তৈরীর শিক্ষার কোনো প্রতিশ্রুতি নেই ।

বৃত্তিমুখী শিক্ষার  নামে মোদি সরকার যে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তাকে করপোরেট শিক্ষা ছাড়া অন্য কিছু বলা যাবে না । মানুষের মধ্যে  মহৎ আদর্শ ও উন্নত সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ না ঘটিয়ে,  মানবমনের সুকুমার বৃত্তিগুলিকে ধবংস করে যান্ত্রিক রোবট তৈরীর এই যে পরিকল্পনা, পঁুজিপতিশ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধিটাই এর লক্ষ্য ।

ছাত্র-ছাত্রাদের মধ্যে বৃত্তিশিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য । কিন্তু তাদের মনের বিকাশের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে পঁুজিপতিদের পছন্দমত প্রযুক্তিশিক্ষা পঁুজিবাদী শোষণের ভিতই শক্ত করবে।

প্রধানমন্ত্রী যদি যথার্থই শিক্ষার সংস্কার চাইতেন, তাহলে দল-মতের ঊধের্ব উঠে সমস্ত দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ্দের সঙ্গে পরামর্শ করে, সমস্ত রাজ্য সরকার গুলির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেই নূতন শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করা উচিত ছিল । শিক্ষার মত এতবড় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এভাবে একতরফা নীতি ঘোষণা করা হঠকারিতার নামান্তর জাতীয় শিক্ষানীতির নামে শিক্ষার এই সংকোচন ও বাণিজ্যকরণের সর্বত্র প্রতিবাদ হওয়া উচিত ।