সম্পাদকীয়

আগামী ১০ই মে বৈশাখী পূর্ণিমা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ৯৭তম জন্মতিথি উত্সব আর এই কারণে, এই বৈশাখী পূর্ণিমার এই পুণ্যতিথিটি আনন্দমার্গের অনুগামীদের কাছে আনন্দপূর্ণিমারূপে পরিচিত৷ মানবসমাজে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী অবদান কীতা আমাদের জানতে হবে৷ তবে আমরা এই আনন্দপূর্ণিমার তাত্পর্য উপলব্ধি করতে পারব৷

আজকে মানুষের দিশাহারা অবস্থা৷ সর্বক্ষেত্রেইকি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে, কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কি রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে, কি শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রেমানুষ আজ লক্ষ্যহীন ভাবে অন্ধকারে পথ হাতড়ানোর মত বিশৃঙ্খলভাবে এদিক ওদিক ছুটে চলেছে৷ ফলে মানুষ ক্রমশঃ অন্ধকার থেকে অধিকতর অন্ধকারের দিকে ছুটে চলেছে৷ আলোর সন্ধান পাচ্ছে না৷ আপাত সুখ, আপাত লোভনীয়, আপাত আকর্ষণীয়ের পেছনে ছুটে ছুটে মানুষ আজ ক্লান্ত৷ চিন্তাশীল মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, আমরা কোথায় চলেছি? এ তো আমরা ক্রমশঃ সর্বনাশের দিকেধ্বংসের দিকে ছুটে চলেছি৷ কিন্তু প্রকৃত পথটা কী? তা কেউ ঠিক বুঝতে পারছেন না৷

এই পরিস্থিতিতে মানুষের প্রয়োজন বুঝেমানুষের অভাব বুঝে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এমন একটা দর্শনএমন একটা জীবনাদর্শ দিয়েছেনযা মানুষকে জীবনের তথা সমাজের সর্বক্ষেত্রেই সার্থকতার রাস্তা দেখিয়ে দেয়৷

হ্যাঁ, সর্বক্ষেত্রেইআধ্যাত্মিক থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই তিনি সর্বপ্রকার সমস্যার সমাধানের পথ দেখিয়েছেন৷ এটা সাধারণ মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আদর্শকে মনোযোগ দিয়ে অনুধাবন করলে এই কথার সারবত্তা সবাই উপলব্ধি করতে পারবেন৷ এই জিনিসটাকে একটা স্থূল উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে গেলে বলতে হয়, এ যেন এমন একটা বড় রেল জংশনযেখান থেকে সব জায়গারই গাড়ী পাওয়া যাবে৷ আমি অতি সংক্ষেপে সেই জিনিসটাই তুলে ধরতে চাই৷ প্রথমে আসি ধর্মের ক্ষেত্রে বা বলা যায় আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে৷

বর্তমানে ধর্মের নামে রয়েছে নানান সাম্প্রদায়িক বিভেদ, জাতপাতের বিভেদ, ধর্মের নামে এক সম্প্রদায়ের প্রতি আর এক সম্প্রদায়ের ঘৃণাবিদ্বেষ, তাকে কেন্দ্র করে দেশের মধ্যে ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক কত সংঘর্ষ, কত না যুদ্ধবিগ্রহ চলেছে৷ জাতের নামে বজ্জাতিদেখে প্রতিটি উদার সংবেদনশীল মানুষ আজ অত্যন্ত ব্যথিত৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এক্ষেত্রে বলেছেন, সমস্ত মানুষের ধর্ম এক৷ ইংরেজীতে যাকে রেলিজন (Religiono) বলা হচ্ছে, তা প্রকৃতপক্ষে ধর্ম নয় মতবাদ’–‘মজ্ঝব৷ ধর্মের প্রকৃত অর্থ সত্তাগত বৈশিষ্ট্য(self characteristics)৷ বিশ্বের সমস্ত আগুনের যেমন একই ধর্মপ্রজ্জ্বলন ক্ষমতা, তেমনি বিশ্বের সমস্ত মানুষেরও এক ধর্ম, একটাই তার সত্তাগত বৈশিষ্ট্য৷ আর তা হল মানব মনের অসীম আকাঙক্ষা৷ অর্থাত্ মানুষের মন অন্যান্য জীবজন্তুর মত কেবল সীমিত ভোগ্যবস্তুতে সন্তুষ্ট নয়, তার চাহিদা অসীম৷ আর কোনো জাগতিক ভোগ্য বস্তু অসীম নয়, অসীম একমাত্র এক অনাদি অনন্ত চৈতন্যঘন আনন্দঘন পরমব্রহ্ম৷ এই অসীমের অনুসন্ধানই মানুষের ধর্ম৷ এটা সমস্ত মানুষেরই ধর্ম৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘মানুষের ক্ষুধা অনন্ত৷ এই অনন্ত ক্ষুধাকে সে যদি জাগতিক ভোগ্যবস্তুর দিকে ছুটিয়ে দেয় তাহলে মানুষে মানুষে সংঘর্ষ বাধবেই, কারণ জাগতিক সম্পদ সীমিত৷ একজনের প্রাচুর্য ঘটলে অন্যের অভাব দেখা দেবে৷ মানুষের এই ক্ষুধা মানস তথা অধ্যাত্ম সম্পদেই মেটাতে হবে৷ ব্রহ্ম অকৃপণভাবে অনন্ত মানস তথা অধ্যাত্ম সম্পদ মানুষের সামনে সাজিয়ে রেখেছেন৷ মানুষকে এই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে হবে৷তিনি আরও বলেছেন, ‘একতা ও সুবুদ্ধি মানুষকে সার্থকতার পথে নিয়ে যায়৷ এই শুভবুদ্ধি জাগাতে গেলে দর্শনের মোটা মোটা বই পড়ে কোনো কাজ হবে না, এজন্যে ব্যষ্টিগত জীবনে যমনিয়মের অনুশীলন করতে হবে৷ ঐক্য স্থাপনা করতে গেলে এমনই একটি আদর্শকে বেছে নিতে হবে  দৈশিক, কালিক বা পাত্রিক ভেদ যাকে প্রভাবিত করতে পারবে না৷ তাই ভূমাআদর্শকেই, ব্রাহ্মী আদর্শকেই জীবনের ধ্রুবতারা রূপে গ্রহণ করতে হবে৷ যারা যমনিয়মে প্রতিষ্ঠিতযারা ভূমাভাবের সাধক তারাই সদ্বিপ্র৷ মানুষের প্রতিনিধিত্ব কেবল তারাই করবে, নিঃস্বার্থভাবে জীবসেবা কেবল তারাই করতে পারে৷....’’

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী যে আনন্দমার্গ দর্শনতথা জীবনাদর্শ দিয়েছেনএটা সেই ভূমা আদর্শ যা বিশ্বের সমস্ত মানুষকে এক সূত্রে গ্রথিত করবে, সবাইকে এক আনন্দপথে পরিচালিত করবে৷  আর এর যে অনুশীলনের দিক তাই মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগিয়ে তুলবে৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘‘সকল মানুষের এক জাত’’, ‘‘প্রত্যেক মানুষেরই সমান অধিকার,’’ ‘‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই,’’ ‘‘মানুষকে শোষণ করা চলবে না,’’ ‘‘ধর্মের নামে ভণ্ডামী চলবে না৷’’

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী একদিকে যেমন ধর্মের ক্ষেত্রে সমস্ত ভেদাভেদ ও বিভ্রান্তি দূর করে সমস্ত মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে উদার আধ্যাত্মিক আদর্শ ও সর্বকুসংস্কারমুক্ত অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনা পদ্ধতি দিয়েছেন তেমনি অন্যদিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে নব্যমানবতাবাদ ভিত্তিক নূতন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে মানুষকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বাত্মক মুক্তি পথের পথ নির্দেশনা দিয়েছেন৷ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি পাঁচ সহস্রাধিক প্রভাত সঙ্গীতরচনা করে ও তাতে নিজেই সুর দিয়েছেন৷ এই প্রভাত সঙ্গীতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে রবীন্দ্রভারতী ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও তিরুপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন আচার্য ডঃ রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, ‘‘প্রভাত সঙ্গীত অনুধ্যান করলে আমরা প্রকৃত সংস্কৃতির সূর্যালোকের প্রকাশ ঘটাতে পারব আর তার সে৷ শাশ্বত মূল্যবোধ, নৈতিক মূল্যবোধ, আধ্য্যাত্মিক মূল্যবোধ সব কিছুরই আমরা পুনর্জাগরণ ঘটাতে পারব৷’’

সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আজ যে আদর্শগত চরম শূন্যতা বিরাজ করছে সেখানেও সেই অভাব পূর্ণ করতে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী, (যাঁর লৌকিক নাম শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) মানবসমাজকে উপহার দিয়েছেন এক যুগান্তকারী সমাজ দর্শন প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’–সংক্ষেপে প্রাউট৷ এই প্রাউটআজ বিশেষ করে বিশ্বের বিশেষ করে বিদ্বত্মহলে এক প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছে৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ডঃ দিলীপ হালদার তাঁর সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘‘বর্তমানে ক্যাপিট্যালিজম্ ও কম্যুনিজম্কোনটাই আজকের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারছে না৷ মানুষ নূতন অর্থনৈতিক তত্ত্ব খুঁজছে, অথচ পাচ্ছে না৷ কি ক্যাপিট্যালিজ্ম্, কি কম্যুনিজ্ম্, কি সোস্যালিজম্,–সবেতেই অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন হয়ে যাচ্ছে তাই একটা বিকল্প ব্যবস্থার প্রয়োজনের কথা সবাই ভাবছেন৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার এই বিকল্প ব্যবস্থা দিয়েছেন৷’’

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আদর্শের বিভিন্ন দিককে সংগ্রথিত করে অতি সংক্ষেপে তাঁর ভাষাতেই বলা যায় ঃ ‘‘আমি চাই প্রতিটি মানুষ জীবনের ন্যুনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির গ্যারাণ্ঢী পাক৷ প্রতিটি মানুষ তার মানসিক ক্ষেত্রের সমস্ত সম্ভাবনার বিকাশের পূর্ণ সুযোগ পাক৷ প্রতিটি মানুষ শাশ্বত সত্য উপলব্ধির সমান সুযোগ পাক ও বিশ্বের সকল উত্কর্ষ ও গৌরবের অধিকারী হোক৷ প্রতিটি মানুষ সেই শাশ্বত অনন্ত সত্তার দিকে এগিয়ে চলুক৷’’

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এই সর্বানুসূ্যত আদর্শ আজকের বিশ্বের সমস্ত সমস্যারই সমাধানের অভ্রান্ত পথের নির্দেশনা দিচ্ছে৷ সেই দিক থেকে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী শুভজন্মতিথি –‘আনন্দপূর্ণিমাএক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে মানুষের সামনে হাজির হয়েছে৷ এই তাৎপর্য যত গভীরভাবে আমরা উপলব্ধি করার চেষ্টা করবততই আমাদের কল্যাণ- বিশ্বের কল্যাণ সাধিত হবে৷