সংহতি ও সমৃদ্ধির ভারত

লেখক
এইচ.এন. মাহাতো

ভারতীয় বলতে আমরা বুঝি কোন একটি জাতিগত সাদৃশ্য বা কোন একটি ধর্মীয় মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত জনগোষ্ঠী নয়৷ ভাষাগত ও সাংসৃকতিকগত ভাবে ৪৪টি জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভারত ভূমি৷

পৃথিবীর সকল কিছু সৃষ্টির পিছনে কয়েকটি মৌলিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে তৈরী হয়েছে এই মানব জনগোষ্ঠী৷ পৃথিবীতে আগে বা পরে কে এসেছে সেটা বিচার্য নয়৷ মানব সভ্যতার বিকাশ কোথা থেকে সূত্রপাত সেটাই হলো বড় কথা৷ প্রাগৈতিহাসিকরা স্বীকার করেছে একটি সভ্যতা তৈরী হওয়ায় মূল চাবিকাঠি হলো জলের উৎস অঞ্চল৷ কারণ জলের আরেক নাম-ই জীবন৷ তাই মানুষ  জলকে জীবন সঙ্গী করে, জলকে নানা কাজে ব্যবহারের জন্যে গড়ে তুলেছে নগর, বন্দর, আগুনের আবিষ্কারের সঙ্গে নগ্ণতা থেকে মুক্ত হতে বসনের মানে পোষাকের ব্যবস্থা, কৃষির জন্য হাল আবিষ্কার, বনের পশু পাখীকে ভালোবেসে তাকে নানা কাজে লাগানো, অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে সঙ্গে বড়ো পশু পাখীদের সঙ্গে লড়াই করতে অস্ত্র আবিষ্কার, সবশেষে মানব সমাজের প্রগতিকে  এগিয়ে নিয়ে যেতে চাকার আবিষ্কার৷ আর এই সকল কিছু আবিষ্কারের উৎসস্থল হিসেবে প্রাগৈতিহাসিকবিদরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন সেই জায়গাটি হলো বাঙালীস্থানের রাঢ় অঞ্চল৷ আজ বাঙালীদের কাছে গর্বের  বিষয় দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার পৃথিবীর ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন’’ সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়৷’’ তিনি তাঁর বইটিতে লিখেছেন সারা পৃথিবীর উৎসস্থল রাঢ় হলেও বহিরাগত ও অন্তরগত মানবরূপী দানবের শোষণের যাঁতাকলে রাঢ়ের মানুষ আজ হীনমন্যতায় মেরুদণ্ডহীন ধবংসের স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ একে রক্ষা করতে হলে সারা পৃথিবীর মানুষকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে৷ তিনি আরো বলেছেন---রাঢ় বাঁচলে বাঙালীস্তান বাঁচবে, বাঙালীস্তান বাঁচলে ভারত বাঁচবে আর ভারত বাঁচলে বিশ্ব বাঁচবে  কিন্তু কেন?

সারা পৃথিবীতে সভ্যতার বিকাশের দুটি আধ্যাত্মিক সংসৃকতির অবদান অনস্বীকার্য, এক তন্ত্রের অন্তর নিহিত ধর্মবোধ,দুই-বৈদিক  মতবাদ যাহা বর্হীমূখী মতবাদ৷ আর এই দুটোর মধ্যে মূল তফাত হলো তন্ত্র সাধনার দ্বারা মানুষের মধ্যে বিশ্বপ্রেম, বিশ্বভাতৃত্ববোধ তৎসহ মানুষ পশুপাখী, গাছপালা, স্থাবরজঙ্গম সবকিছুই ঈশ্বরের সৃষ্ট জগৎ এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে সারা পৃথিবীকে বাঁচাতে এক ছাতার তলে আনে৷ ধর্ম জীবের অন্তর নিহিত সত্তা৷ তাই তন্ত্র  সাধকেরা বহিরঙ্গের কোন বুজরুকিকে বিশ্বাস করে না৷ মানব সমাজকে এক ছাতার  তলে এনে বিশ্বপরিগঠন করাটাই তাদের স্বভাব৷ তন্ত্র সাধকরা সনাতন বা ভাগবত ধর্মের ওপর নির্ভরশীল বা বিশ্বাসী৷ অন্যদিকে বৈদিক মতাবলম্বীরা সমাজে জাত-পাতের  বা ধর্মীয় মতবাদের নামে উঁচু নিচু ভাবনায় মানুষে মানুষে  বিভেদের প্রাচীর তৈরী করে রক্তের হোলিতে বিশ্বাস করে৷ ভারতে  এই বৈদিক মতবাদ অনেক আগে থেকে সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও ১৩৫০/১৪০০ বছর আগে শঙ্করাচার্যের সময় থেকে এর বিস্তৃতি লাভ করে৷ কারণ বাঙালীস্তানের জনগণের মধ্যে বিমিশ্রিত সংসৃকতির প্রভাব থাকাতে বাঙালীরা তন্ত্রের মতবাদে বিশ্বাসী ছিল৷ শঙ্করাচার্য যখন দেখলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর মতবাদ প্রভাব বিস্তার করতে পারছেনা, তখন রাজশক্তি করায়ত্ব করে বলপূর্বক বৈদিক মতবাদকে বাঙালীস্তানে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে৷ পরবর্তী অবস্থায় রাজা শশাঙ্কের আমলে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে বাঙালীস্তানে শুরু হয় কৌলিন্য প্রথা৷ বাঙালীর জনজীবনে জাতপাত, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের বিভাজনের নামে শুরু হলো ভাতৃঘাতী এক নব্যসমাজ ব্যবস্থা৷ এর থেকে মুক্তি পেতে সারা ভারতে তথা বাঙালীস্তানে তৈরী হলো এক নবজাগরণ বা রেনেসাঁ৷ সেই সময় বৈদিক মতবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে জন্ম নিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,মাইকেল মধুসুদন দত্ত, ডিরোজিও আরো অনেকে৷ আমরা দেখেছি বাঙালী বারবার মারখেয়েও ঈশ্বর প্রদত্ত মানবিক শক্তিধারী সমাজকে পরিবর্তন করতে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন৷ এর পিছনে রয়েছে বাঙালীস্তানের উবর্বর মাটি৷ এই মাটিতে মূলতঃ তিনটি সভ্যতার বিমিশ্রণ ঘটেছে৷ গঙ্গার অববাহিকা ধরে আর্য সভ্যতা, ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় রয়েছে মঙ্গোলীয় সভ্যতা ও রাঢ়ের দামোদর, কংসাবতী, শিলাই সুবর্ণরেখা ইত্যাদির অববাহিকা ধরে অষ্ট্রিক/দ্রাবিড় সভ্যতা৷ আর এই তিনটি সভ্যতাই মিলেছে বাঙালীস্তান ব-দ্বীপ অঞ্চলে৷ নদীমাতৃক দেশে এই ত্রিধারার ফলে বিমিশ্রিত সংসৃকতির প্রভাব এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তন্ত্রের প্রভাবে অন্তর নির্হিত ধর্মবোধ ও আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা, সামাজিকতা, বিশ্বৈকতাবাদ, অন্যকে আপন করার মানসিকতা, সরলতা, সহনশীলতা,তেজস্বীকতা,সেবা,ত্যাগের ভাবনা,পরিবর্তন মানসিকতা,উচ্চ মননশীলতা, সঙ্গীত চর্চায়, সাহিত্যে ও শিল্পকলায় সৃজনশীলতা, বিজ্ঞানচর্র্চয়, বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা ও চেতনায় একরোখা মনোভাব,ব্যবসা-বানিজ্যে বিশ্ব জয়, কর্মক্ষমতা  ইত্যাদি ইত্যাদি ভালো গুনগুলো ভারত সরকার তথা বিশ্বের যে কোনো শোষক নেতৃত্বের কাছে ঈর্ষার কারণ৷

প্রায় ৩০০০/৩৫০০ বছরের পুরোনো বিমিশ্রিত সভ্যতার  এই জাতিটি আজ এত কিছু থাকার পরও বহিরাগত ও আভ্যন্তরীণ শোষক  তৎসহ  পুঁজিবাদী, মাকর্সবাদী রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদীদের শোষণ ও হিংস্র দমন-পীড়ন মূলক মনোভাবের দাবানলে আজ হীনমন্যতায় মেরুদণ্ডহীন হয়ে  পড়েছে৷ এরপরেও ভারতের সরকার বাঙালী জাতিসত্তাকে এত ভয় কেন? কেননা বাঙালী জাতি একটি ঘুমন্ত আগ্ণেয়গিরি, যেকোনো মুহূর্তে এর ভেতরের বৈপ্লবিক চেতনা শোষনের দাবানলকে চুরমার করতে পারে৷ কবির ভাষায় ‘বাংলা মাটি দুর্জয় ঘাঁটি জেনে নিন দুর্বৃত্ত৷ এই জন্যই ভারত সরকারের একমাত্র মূলমন্ত্র৷ ভারতের বাঙালী জাতিসত্তাকে রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রহীনে পরিনত করা৷

এই কাজে তারা সাময়িকভাবে সফল হলেও এর সুদূরপ্রসারী ফল মারাত্মক হবে৷ বহিরাগত হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী শোষক জানে না এর জন্য তাদের কী কী মূল্য খোয়াতে হবে৷ ভারত সরকারের উগ্র বাঙালী বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ভারতবর্ষকে সোভিয়েত পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে৷ ভারতের সংহতি তখনই সুদৃঢ় হবে যখন ভারতের ৪৪টি জনগোষ্ঠী ভাষা কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে৷ তাই অহেতুক জাতিবিদ্বেষ ত্যাগ করে ভারতের ৪৪টি জাতিগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে সংহতি ও সমৃদ্ধির ভারত গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ হউক৷ পথ তৈরী আছে, শুধু এগিয়ে চলার অপেক্ষা৷