শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে প্রাউটের আহ্বান

লেখক
প্রভাত খাঁ

মানুষ নিছক উদর সর্বস্ব জীব বিশেষ নয়৷ মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম প্রাণী৷ কারণ একমাত্র মানুষই পারে এই বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য জানতে৷ তার সূক্ষ্মতম মানসিক বিকাশের মাধ্যমে৷ অন্য কোন প্রাণীর সেই সামর্থ নেই৷ তবে সঞ্চর ও প্রতিসঞ্চর ধারার মাধ্যমে যে সৃষ্টি প্রবাহ চলে তার প্রথম ও শেষ কথা হ’ল--- আমরা যথা হতে আসি তথায় ফিরিয়া যাই৷ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মতম সত্তা থেকে সঞ্চর ধারার স্থূল থেকে স্থূলতম সত্তায় রূপান্তরিত হয়ে সৃষ্টি চলেছে৷ সেই এক কোষি প্রাণী থেকে আরম্ভ করে এর অগ্রগতি, তাই জীবজন্তু, গাছপালা থেকে আরম্ভ করে ধীরে ধীরে এই মানুষের সৃষ্টি৷ মানুষ মন প্রধান জীব হিসেবে নিজেকে জানতে চায়৷ আর সেই জানার আকাঙ্খাতে সেই আত্মিক সাধনার মাধ্যমে নিজের জন্মের রহস্য ও সৃষ্টির রহস্যও জানতে সক্ষম হয়৷ এটাই আত্মসাধনা৷ তারই মধ্য দিয়ে সে নিজেকে জানতে পারে৷ এই কারণে মানুষকে দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সাধনা করতে হয়৷ এই তিনটি দিকের উন্নয়নে তাই মানুষকে নজর দিতে হয়৷ সুপ্রাচীনকালে এই ভারতবর্ষের মাটিতে যেসব মনীষীগণ জন্মগ্রহণ করেন তারা এই তিনেরই বিকাশের গুরুত্ব দিতেন৷ দেহের  মাধ্যমে মানুষ কাজ করবে৷ তাই দেহের ক্ষুধা মেটাতে তাদের কাজ করে যেতে হ’ত৷ খাদ্য সংগ্রহে ও বেঁচে থাকার জন্যে কাজ করতে হ’ত৷ বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে হ’ত৷ তাই বলা হয় সংগ্রামই জীবন৷ শুধু বেঁচে থাকাটাই মানুষের জীবন নয়, সেটা হ’ল অনুন্নত প্রাণীদের কাজ৷ মানুষকে মনের ক্ষুধা মেটাতে, আর্থিক ক্ষুধা মেটাতে তার দরকার হ’ত এমন কিছু সূক্ষ্ম বস্তুর যেগুলি খাদ্যদ্রব্য দিয়ে মেটানো যেত না৷  সেগুলি ছিল সঙ্গীত, কাব্য, নাচ, গান, যেগুলি মনের তৃপ্তি দিতে পারে, আর তার চেয়ে সূক্ষ্ম হ’ল আধ্যাত্মিক সাধনা৷ আমি কে? কোথা থেকে এসেছি, সেটা জানা অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভ৷ এই তিনের ক্ষুধা মেটাতে মানুষকে কাজ করে যেতে হয়৷ তিনটে নিয়ে এগোতে হয়৷ তবেই মানুষ মনুষ্যত্ব লাভ করে৷ আত্মজ্ঞান লাভই আসল জ্ঞান লাভ৷ এই যে তিনের পূর্ত্তির অনুশীলন, এটার উপর প্রাচীন ভারতের মুনীঋষিগণ জোর দিতেন৷ তারা সেই পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন৷ এই যে তিনের সাধনা এটা সকলকে অর্থাৎ সকল মানুষকে যারা মানুষের আধার পেয়েছে তাদের করে যেতে হবে৷ সেখানে কোন জাত-পাত, সাদা-কালো, লম্বা-চওড়া কোন ভেদাভেদ নেই৷ উন্নত মেরুদণ্ডী জীব মানুষ  নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই সেই পথ অনুসরণ করে আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে৷ তাই বলা হয় মানব সমাজ এক ও অভিভাজ্য৷ আর এই পথকে লাভ করার অধিকার সকলেরই আছে৷ নারী ও পুরুষের সবাই সেই সুখ ও আনন্দের প্রত্যাশী৷ তিনেরবিকাশেই মানুষ হয়ে ওঠে আদর্শবান মানুষ আর এটাই হ’ল একমাত্র আনন্দ লাভের পথ৷ মানুষ একা বাঁচতে পারে না, তাই সংঘবদ্ধ হয়ে তাকে থাকতে হয়৷ তাই ব্যষ্টি ও সমষ্টি দুইয়েরই অতি প্রয়োজন৷ সমষ্টিবদ্ধ হয়ে চলতে সমাজ গড়তে হয়েছে মানুষকে তাই সমাজকে অস্বীকার করার উপায় নেই৷ মানুষ এই পৃথিবীর গ্রহের অধিবাসী৷ সকলের অধিকার আছে বেঁচে থাকার৷ তাই কেউ যাতে বঞ্চিত না হয় সেটা দেখার ভার সমাজের৷ তাই সমাজের সার্বিক কল্যাণ সমবেতভাবে মানুষকে করতে হবে৷ আজ অত্যাধুনিক যুগে আমরা বাস করছি৷ সকলকে নিয়ে চলতে হবে৷ শোষণ করা অপরাধ৷ সবাই জানে, কিন্তু শোষণই বেশী হচ্ছে এই মাটির পৃথিবীতে৷ বঞ্চণার শিকার কোটি কোটি মানুষ,মুষ্টিমেয় ভোগ করছে বেশী করে৷ এরই অবসান ঘটান সৎ নীতিবাদীদের কাজ৷ সংগচ্ছধবং মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে চলতে হবে৷ প্রতিটি অঞ্চলকে শোষণমুক্ত করতে হবে৷ আজকের বৃহৎ পরিবার পৃথিবীকে এক বৃহৎ পরিবারে অর্থাৎ সমাজে পরিণত করাটাই হ’ল মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ মানুষের পবিত্রতম ব্রত ও কর্ম৷ বাঁচো ও অন্যকে বাঁচতে দাও---এটাই হোক পৃথিবীর মানব সমাজের কেমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য৷ এই মানুষ সমাজের বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে লড়াই করে আজ এসে পৌঁছেছে বর্তমান অবস্থায়৷ আজও কিন্তু সেই শোষণ চলছে৷ মানুষ মারার জন্যে ভয়ঙ্কর অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছে এই মাটির বুকে৷ কিন্তু কোটি কোটি মানুষ অসহায় ও অভুক্ত হয়ে আছে৷ প্রতিটি মানুষ জন্মেছে অধ্যাত্ম জীব হিসাবে৷ তাই আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে৷ আর সেই পরিবেশ এসেছিলেন সদাশিব ও শ্রীকৃষ্ণ আরও অনেকে৷ অন্যান্য দেশে অনেকই আসেন মানব সমাজের কল্যাণে৷ বিভিন্ন সময় যারা মানব কল্যাণে আসেন ও কাজ করে যান, তাদের কথা কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী লোভী ব্যাষ্টি অস্বীকার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে পৃথিবীতে  লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে গেছে৷ লোভের বশবর্তী হয়ে জীবজন্তু গাছপালা ধবংস করেছে৷ গত শতাব্দীতে এই পৃথিবী দেখেছে পরপর দুটো ভয়ঙ্কর বিশ্বযুদ্ধ৷ তাতে সবাই বুঝেছে যুদ্ধ নয় শান্তি চাই৷ কিন্তু শান্তি কি এসেছে? কেন এর উত্তর খুঁজেপেতে হবে৷ সকলকে, এড়িয়ে গেলে চলবে  না৷ এই পৃথিবীকে রক্ষার জন্যে মহাসম্ভূতি পরমারাধ্য বাবা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আবির্ভাব ঘটেছে৷ মানবতা রক্ষার জন্যে আর পরমপুরুষের সৃষ্টিকে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি নীরবে কাজ করে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে৷ তিনি রেখে গেছেন তাঁর মহান দর্শন, আনন্দমার্গ, আর্থিক ও সামাজিক তত্ত্ব প্রাউট৷ তাকে বাস্তবায়িত করবে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ৷

বর্তমান পৃথিবীতে আজ চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট ও সামাজিক অবক্ষয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে অর্ধমৃত হয়ে ধুঁকছে৷ অন্যদিকে বেশ কিছু স্বার্থান্বেষী সন্ত্রাসবাদী কিছু রাষ্ট্র শক্তির ইন্ধনে সমস্যা-সঙ্কুল পৃথিবীতে সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে৷ আজকের পৃথিবী দিশেহারা ও পথভ্রষ্ট৷ অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা সম্মুখে সমস্যা সমাধানের পথ দেখেও বেশ কিছু স্বার্থান্বেষী এড়িয়ে যাচ্ছে৷ এর একটাই কারণ তারা তাদের অন্ধ আত্ম অহঙ্কারে মত্ত৷ কিন্তু মহাকাল তার কাজ করে যাবেন বিশ্বের কল্যাণে৷

আনন্দমার্গ দর্শনের একটি বিশেষ তত্ত্ব হ’ল যাকে বলা হয় প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব---প্রাউট দর্শন৷ অভাব যার দ্বারা মিটে যায় তাকেই আমরা বলি অর্থ৷ আমাদের তিনটি মূল অভাব দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক---এই তিনটি অভাব মেটায় অর্থাৎ ক্ষুধা মেটায় প্রাউট দশনতত্ত্ব৷ জাগতিক, অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথ প্রদর্শন করেছে প্রাউট৷ মানসিক সমস্যা সমাধানের পথ দেখিয়েছে প্রাউট৷ আর আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রের অভাব পূরণের পথ নির্দেশনা দেখিয়েছেন প্রাউট৷ তাই এই দর্শনের অনুগামীরা প্রাউটিষ্ট হিসেবে পরিচিত৷

স্মরণে রাখা দরকার যেটা তা হ’ল ব্যষ্টিকে বাদ দিয়ে সমষ্টি হয় না, আর সমষ্টিকে বাদ দিয়ে ব্যষ্টি বাঁচে না৷ তাই সমাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই প্রাউটের মতে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে বৃহতের সঙ্গে মিশতে হবে এটাই বিধিলিপি৷ নদী সমুদ্রে মিশবে৷ ক্ষুদ্র বৃহতের সঙ্গে মিশে বৃহৎ হবে৷ দৈহিক, মানসিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিক প্রগতির মাধ্যমে মানব সমাজ এইভাবে এগিয়ে গিয়ে নিয়ে যাবে৷  যে সংঘ তারই নাম প্রাউটিষ্ট ইয়ূনিবার্সাল৷ এটি মহান বিশ্বৈকতাবোধে, উদ্বুদ্ধ সকল সঙ্কীর্ণতামুক্ত এক মানবতাবাদী সংঘটন৷

ধনতন্ত্রের সীমা স্থূল জাগতিক সম্পদের মধ্যেই আবদ্ধ৷ ‘শোষণের ওপর সমৃদ্ধি’ এই লক্ষ্যই হ’ল ধনতান্ত্রিক নীতির  সারকথা৷ মানুষকে উৎপাদনের অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ তাই শ্রমিক শোষিত হয়৷ প্রাউট  শ্রমিককে উৎপাদনের অন্যতম অংশীদারহিসেবে মান্যতা দেয়৷ তাই সেখানে শ্রমিক দাবী আদায়ে বন্ধ ডাকে না ও উৎপাদন ব্যাহত করে না৷ উৎপাদন বৃদ্ধি ও নিজে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজে অংশ নেয়৷ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের ও বণ্টনে সমবায় প্রথাই হবে অর্থনৈতিক সামাজিকরণের লক্ষ্য৷ সমাজতন্ত্রই হ’ল গণতন্ত্রের সার্থকতার চাবিকাঠি৷ ধনতন্ত্র তাই বর্তমানে গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করে রক্তশূন্য করে ছাড়ছে৷ সরকার ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে যেগুলি মূল উপাদান সেগুলি লাভও নয় আর লোকসানও নয় এই আদর্শের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদনের যোগানের ব্যবস্থায় থাকবেন৷ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে ও বণ্টনে সমবায় পদ্ধতি সমাজের প্রধান ভূমিকায় থাকবে৷ এই ভোগ্যপণ্য উৎপাদন হবে ব্লকভিত্তিক ছোট মাঝারি কলকারখানার মধ্যে দিয়ে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে৷ কেন্দ্রীকরণটা নানা সমস্যা সৃষ্টি করে৷ এতে বাজারে পণ্য যোগান দিতে পরিবহণ খরচ বাড়ে৷ স্মরণে রাখতে হবে অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণই দেশকে অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়৷ তাতে বেকার সমস্যা কমে, মানুষ রুজিরোজগারের পথ পায়৷ ঘরে বসে ভাগ্যান্বেষণে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয় না৷ তাই ছোট ছোটি শিল্প গড়ে তোলা ব্লককেন্দ্রিক অতীব প্রয়োজন৷ ব্লকগুলিকে অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে হবে৷ মোদ্দা কথা হ’ল লাভের আকাঙ্ক্ষাকে সংযত করে সেবার মানসিকতাকে বাড়াতে হবে অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে৷ তবে দেশ বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে, গণতন্ত্র বাঁচবে আর জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে৷ ধনী ও দরিদ্র্যের মধ্যে ফারাক নিয়ন্ত্রিত হবে৷ সংগচ্ছধবং মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হতে হবে সকলকেই---প্রাউট একথা বলে৷

বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে অভাব ঘটেছে সৎ নীতিবাদী দেশসেবকদের৷ অত্যধিক লোভের ও ভোগ বিলাসের মাত্রা বেড়েছে একটি বিশেষ স্তরের মানুষের মধ্যে৷ যারা জীবনকে আত্মকেন্দ্রিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে ব্যষ্টিস্বার্থে সব কিছু গ্রাস করতে চাইছে ও সেটা করেও চলছে৷ এই মানসিকতাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী৷ ‘বাঁচো ও বাঁচতে দাও’ এটাই হোক মানবতাবাদী মানুষের লক্ষ্য৷

এই যে ভয়ঙ্কর মানসিক অধঃপতন সারা পৃথিবীতে, তাকে সংযত করার মহান ব্রত গ্রহণ করতে দলমত নির্বিশেষে যারা সৎ নীতিবাদী মানুষ তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন সমাজ গড়ার কাজে ব্রতী হোন৷