শ্রাবণী পূণির্র্মর ঐতিহাসিক আহ্বান

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

আগমী ৭ই আগষ্ট শ্রাবণী পূর্ণিমা, যাকে রাখীপূর্ণিমাও বলা হয়--- এর এক বিশেষ মহত্ত্ব আছে৷ কথিত আছে, এই শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথিতে মানব সভ্যতার আদিগুরু সদাশিব আজ থেকে  ৭ হাজার বৎসর পূর্বেপ্রথম ধর্মপ্রচার শুরু করেছিলেন৷ তাছাড়া প্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষে এদিনটি রাখী বন্ধন রূপেও পালিত হয়ে আসছে৷ এদিন বোনেরা ভাইয়ের হাতে রাখী পরিয়ে দেয়৷ ভাইয়েরাও বোনেদের সুরক্ষার দায়িত্ব উপলদ্ধি করেন৷ সে কারণে এই উৎসব সারা ভারতে ‘রক্ষা-বন্ধন’ উৎসব হিসেবেও পরিচিত৷

কথিত আছে, শ্রীকৃষ্ণ এদিন শিশুপাল বধ করেছিলেন৷ এই সময় কৃষ্ণের একটি আঙ্গুল কিছুটা কেটে যায়৷ দ্রৌপদী তখন নিজের শাড়ী ছিঁড়ে কৃষ্ণের আঙ্গুলে বেঁধে দেন ও তাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়৷ তখন শ্রীকৃষ্ণও  অঙ্গীকার করেন, তিনি দ্রৌপদীর সমস্ত সংকটকালে সহায়তা করবেন৷ পাশাখেলায় দুঃশাসন দুর্র্যেধনের আদেশে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে চেষ্টা করে৷  কিন্তু যতই বস্ত্র আকর্ষণ করুক না কেন, দ্রৌপদীর অঙ্গের বস্ত্রও শেষ হয় না৷  কৃষ্ণ অলক্ষ্যে এইভাবে দ্রৌপদীর মান রক্ষা করেন৷

ভারতের ইতিহাসেও  এই  রাখী পূর্ণিমার  বিশেষ গুরুত্ব আছে৷ কথিত আছে, দিল্লির বাদশা হুমায়ূন যখন চিতোর আক্রমণে যান, চিতোরের বিধবা রাণী কর্ণবতী দেখলেন আর চিতোর রক্ষা করা  সম্ভব নয়, তখন তিনি দূত মারফৎ হুমায়ুনের কাছে রাখী পাঠিয়ে তাঁকে ভাই হিসেবে বরণ করেন৷ হুমায়ুনও তখন এই ঘটনায় অভিভূত হয়ে সৈন্য সামন্ত নিয়ে ফিরে যান৷

আধুনিক যুগে, ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজত্বের সময় বড়লাট লর্ড কার্জন বাঙলাকে সরাসরি দ্বিখন্ডিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন৷ তখন সারা বাঙলা জুড়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছিল৷ সে সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার হাতে রাখী পরিয়ে দিয়ে বাঙলার সমস্ত মানুষকে ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার  আহ্বান জানিয়েছিলেন৷

এ প্রসঙ্গ টেনে আমরাও বলতে চাই, আজও যখন পশ্চিমবাঙলার উত্তর থেকে দক্ষিণে বাঙলাভাগের চক্রান্ত চলছে, বাঙালী জনগোষ্ঠীর সম্প্রীতি ও সংহতি দৃঢ় করে বাঙলাভাগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সমস্ত বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্ববান জানাই শ্রাবণী পূর্ণিমার পূণ্যতিথিতে৷

শ্রাবণী পূর্ণিমার আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা হ’ল, আনন্দমার্গের প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ১৯৩৯ সালের এই শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথিতে , যখন তাঁর বয়স  মাত্র ১৮ বছর, প্রথম গুরুরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন৷ সে সময় তিনি প্রকৃত পক্ষে আনন্দমূর্ত্তিজীরূপে পরিচিত হননি৷ বিদ্যাসাগর কলেজে পড়তেন ৷ থাকতেন বাগবাজারে মামার বাড়ীতে৷ তখন কাশীমিত্র ঘাট এলাকা আজকের মত জনাকীর্ণ ছিল না৷ এই নির্জন এলাকায় সান্ধ্যভ্রমণের সময় ‘প্রভাতরঞ্জন(শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী লৌকিক পিতৃদত্ত নাম) কালী ডাকাত নামে পরিচিত এক ভয়ঙ্কর ডাকাতের সাক্ষাতে আসেন৷ সেই সময় তিনি কালীডাকাতের  জীবনে পরিবর্তন এনে তাঁকে দীক্ষা দিয়েছিলেন৷ তারপর সেই দুর্র্দন্ত কালীডাকাত ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে সাধকে রূপান্তরিত হন৷ ও পরে কালিকানন্দ নামে সন্ন্যাস দীক্ষা নেন৷

পরবর্তী কালে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী জানিয়েছিলেন এই শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথিতেই তিনি  তাঁর দর্শন তথা সংস্থার ‘আনন্দমার্গ’ নামকরণ করেছিলেন৷

এই জিনিসটা লক্ষণীয়, শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী গুরুরূপে  আত্মপ্রকাশ  করে প্রথম দীক্ষা দিলেন একজন ‘ডাকাতকে’৷ মনে  হয়, আজকের এই বিপথগামী সমাজেরই  প্রতীক এই ডাকাত৷ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর আবির্ভাবের  মূল কারণ আজকের এই বিপথগামী মানবসমাজের পরিবর্তন৷ এই কারণে তাঁর দর্শন সর্র্বনুসূ্যত দর্শন অর্র্থৎ  তাঁর দর্শনে ধর্ম, শিক্ষা, সমাজ, অর্থনীতি সমস্ত কিছুই অঙ্গীভূত হয়েছে৷ সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধানেরই তিনি পথ দেখিয়েছেন৷

তাই তিনি ‘‘আমি চাই প্রতিটি মানুষ জীবনের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির গ্যারান্টী পাক ৷ প্রতিটি মানুষ তার মানসিক ক্ষেত্রের সমস্ত সম্ভাবনার পূর্ণ সুযোগ পাক৷ প্রতিটি মানুষ শাশ্বত সত্য উপলব্ধির সমান সুযোগ পাক ও বিশ্বের সকল উৎকর্ষ ও গৌরবের অধিকারী হোক৷ প্রতিটি মানুষ সেই শাশ্বত অনন্ত সত্তার দিকে এগিয়ে চলুক’ তাই আসুন, এই পুণ্যতিথিকে স্মরণ করে বিশ্বের সমস্ত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর মহান আদর্শকে অনুসরণ করে  সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত সর্বাঙ্গসুন্দর সমাজ রচনা করি৷